মীর আব্দুল হালিম: বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ মালিক ও শ্রমিকের মধ্যে সম্পর্ক নির্ধারণ এবং উভয় পক্ষের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বর্ণনা করেছে যা প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে মালিক এবং শ্রমিক ব্যবহার করতে পারে। করোনা ভাইরাস মহামারী ২০১৯-২০ এর পরিপ্রেক্ষিতে বহুসংখ্যক শিল্প/কারখানা বন্ধ করা হচ্ছে বা প্রায় ৮০-৯০ ভাগ শিল্প/কারখানায় লে অফ বা সামরিক কর্মবিরতি ঘোষণা করা হয়েছে। তৈরি পোশাকশিল্পে প্রায় চার হাজারেরও অধিক শিল্প/কারখানায় ত্রিশ লক্ষেরও বেশি শ্রমিক কর্মে নিয়োজিত আছে। বিষয়টি নিয়ে শ্রমিকদের মাঝে নানারকম উৎকণ্ঠা কাজ করছে, সাময়িক কর্মবিরতির ফলে অনেকেই তাদের প্রাপ্য অধিকার নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন, তাদের মাঝে ছাঁটাই হওয়া কিংবা একই কারখানায় পুনরায় তারা নিয়োগ পেতে পারে কিনা এ নিয়েও রয়েছে নানা রকম জল্পনা কল্পনা। তাই সহজভাবে বাংলাদেশ শ্রম আইন অনুসারে এ বিষয়টির ওপর আলোচনা করা হলো।
সাময়িক কর্মবিরতি:
লে অফ (Layoff) বা সাময়িক কর্মবিরতি বলতে সাধারণত বোঝায়, নিয়োগকর্তা কর্তৃক ইতিমধ্যে নিয়োগকৃত কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের কর্মে যোগদান সাময়িকভাবে অস্বীকার করা। বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ অনুসারে লে অফ অর্থ- ” কয়লা, শক্তি বা কাচামালের স্বল্পতা অথবা মাল জমিয়া থাকা অথবা যন্ত্রপাতি বা কল-কব্জা বিকল বা ভাঙ্গিয়া যাওয়ার কারণে কোন শ্রমিককে কাজ দিতে মালিকের ব্যর্থতা, অস্বীকৃতি বা অক্ষমতা। খবরে প্রকাশ ৪০ ভাগ পোশাক কারখানায় লে অফের নোটিশ দেয়া হয়েছে।
ক্ষতিপূরণের অধিকার:
উক্ত আইনে লে-অফকৃত (laid-off workers) শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণের অধিকার (right for compensation) সম্পর্ক বিশেষ ভাবে বলা হয়েছে, যে ক্ষেত্রে বদলী বা সাময়িক শ্রমিক নন এমন কোন শ্রমিককে যার নাম কোন প্রতিষ্ঠানের মাস্টার রোলে অন্তর্ভুক্ত আছে এবং যিনি মালিকের অধীন কমপক্ষে এক বছর চাকুরি সম্পন্ন করেছেন, লে অফ করা হয়, তা হলে, মালিক তাকে, সাপ্তাহিক ছুটির দিন ছাড়া তার লে-অফের সমস্ত দিনের ক্ষতিপূরণ প্রদান করবেন উল্লেখিত ক্ষতিপূরণের পরিমাণ হবে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকের মোট মূল মজুরি, মহার্ঘ ভাতা এবং এড-হক বা অন্তবর্তী মজুরী, যদি থাকে, এর অর্ধেক এবং তাকে লে-অফ করা না হলে তিনি যে আবাসিক ভাতা পেতেন তার সম্পূর্ণের সমান। আলোচ্য ধারা বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে লে-অফ কৃত শ্রমিকের ক্ষতিপূরণের পরিমাণ বস্তুত লে-অফ না হলে তার যে উপার্জন হতো তার -অর্ধেক। বদলী শ্রমিকরাও এই ধারায় ক্ষতিপূরণের সুবিধা পেতে পারে যদি তাদের নাম প্রতিষ্ঠানের মাস্টার রোলে থাকে এবং লে-অফের পূর্বের এক বছর তারা নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে সেই প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করে থাকে। উল্লেখ্য যে, লে – অফ কৃত কোন শ্রমিকের ক্ষতিপূরণ অনির্দিষ্টকালের জন্য দেয়া হবে না। আইন অনুসারে, মালিক এবং শ্রমিকের মধ্যে ভিন্নরূপ কোনো চুক্তি না থাকলে কোনো শ্রমিক এই আইনের অধীন কোন পঞ্জিকা বৎসরে সর্বোচ্চ ৪৫ দিনের সময়ের জন্য ক্ষতিপূরণ পাবেন। যেসব শ্রমিকের চাকরির বয়স এক বছরের কম, তাঁরা লে-অফ কালীন কোনো মজুরি পাবেন না। অন্যরা কেবল মূল মজুরির অর্ধেক ও বাড়ি ভাড়া পাবেন। অন্য কোনো ভাতা পাবেন না।
যাইহোক এই আইন শ্রমিক বান্ধব এবং শ্রমিক কল্যাণমূলক যেমন বর্ণনা করা হয়েছে যদি কোন পঞ্জিকা বৎসরে কোন শ্রমিককে অবিচ্ছিন্নভাবে বা বিচ্ছিন্নভাবে ৪৫ দিনের অধিক সময়ের জন্য নিয়োগ করা হয় এবং উক্ত ৪৫ দিনের পর লে অফের সময় যদি আরও ১৫ দিন বা তদূর্ধ্ব হয়,তা হলে উক্ত শ্রমিককে, শ্রমিক এবং মালিকের মধ্যে ভিন্নরূপ কোনো চুক্তি না থাকলে, পরবর্তী প্রত্যেক ১৫ দিন বা তদূর্ধ্ব দিন সমূহের লে অফের জন্য ক্ষতিপূরণ প্রদান করিতে হইবে। উল্লেখিত ক্ষতিপূরণের পরিমাণ হবে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকের মোট মজুরি, মহার্ঘভাতা এবং অ্যাড হক বা অন্তর্বর্তী মজুরি, যদি থাকে, এর এক চতুর্থাংশ এবং যদি আবাসিক ভাতা থাকে তার সম্পূর্ণের সমান । কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবশ্য লে অফকৃত শ্রমিক গণ কোন ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারবেন না। এমনই একটি ক্ষেত্র হল যদি কোন শ্রমিক একই প্রতিষ্ঠানে বা একই মালিকের অধীনে একই শহরে বা গ্রামে অথবা ৮ কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে অবস্থিত ভিন্ন কোন প্রতিষ্ঠানে, -‘দক্ষতা, পূর্ব অভিজ্ঞতার’- প্রয়োজন নেই এরূপ কোন বিকল্প পদে একই মজুরিতে কাজ গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন অর্থাৎ বিকল্প পদে কাজ করতে অস্বীকার করলে শ্রমিক ক্ষতিপূরণ দাবী করতে পারবেন না।
মাস্টাররোল সংরক্ষণ:
শ্রম আইন অনুসারে কোন প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকগনকে লে অফ করা সত্ত্বেও নিয়োগকর্তাকে তাদের জন্য মাস্টাররোল সংরক্ষণ করতে হবে এবং স্বাভাবিক কর্মসময়ে লে অফ- কৃত শ্রমিকগণের মধ্যে যারা কাজের জন্য হাজিরা দিবেন তাদের নাম মাস্টার রোলে লিপিবদ্ধ করার ব্যবস্থা করবেন নিয়োগকর্তা ।
সাময়িক কর্মবিরতিতে থাকাকালে ছাঁটাই:
সাময়িক কর্মবিরতি থাকাকালে কোন শ্রমিককে ছাঁটাই করা হলে সে নিম্নরূপ সুবিধা প্রাপ্ত হইবে। কোন শ্রমিক সাময়িক কর্মবিরতিতে থাকার সময় কালে কোন পঞ্জিকা বৎসরে উপরে উল্লেখিত প্রথম ৪৫ দিন লে অফের পর যদি অবিচ্ছিন্ন ১৫ দিন বা তদূর্ধ্ব সময়ের জন্য লে – অফ করতে হয় তাহলে মালিক উক্ত শ্রমিককে লে-অফ এর পরিবর্তে আইনের অধীন ছাঁটাই করতে পারবেন। সাধারণ ছাঁটাই করার ক্ষেত্রে যে ধরনের নোটিশ প্রদানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে এক্ষেত্রে নোটিশ প্রদানের প্রয়োজন হইবে না কিন্তু সে সমস্ত ক্ষতিপূরণ প্রাপ্ত হইবে। এক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রত্যেক বৎসর চাকুরীর জন্য ৩০ দিনের মজুরি বা গ্রাচুইটি, যদি প্রদেয় হয়, যাহা অধিক হইবে সে তাহা পাওয়ার অধিকারী হইবে এবং সেইসাথে ক্ষতিপূরণ বা গ্র্যাচুইটির অতিরিক্ত হিসাবে আরও ১৫ দিনের মজুরি দিতে হবে।
ছাঁটাইকৃত শ্রমিকের পুনঃনিয়োগ:
সাধারণভাবে ছাঁটাইকৃত অথবা সাময়িক কর্মবিরতি কালে ছাঁটাইকৃত যেকোনো শ্রমিককে ছাঁটাই এর এক বছরের মধ্যে মালিক যদি পুনরায় নিয়োগ করতে ইচ্ছুক হন সে ক্ষেত্রে মালিক শ্রমিকের সর্বশেষ জানা ঠিকানায় একটি নোটিশ প্রেরণ করে তাকে চাকুরির জন্য আবেদন করতে আহ্বান জানাবেন এবং এই আহবানে সাড়া দিয়ে কোন শ্রমিক যদি পুনরায় চাকুরি পাবার জন্য আবেদন করে তাহলে তাকে নিয়োগের ব্যাপারে অগ্রাধিকার দিতে হইবে এরকম একাধিক ছাঁটাইকৃত শ্রমিকদের তাদের মধ্যে পূর্বে চাকরির জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
ছাঁটাই এবং বরখাস্তের মধ্যে পার্থক্য:
সাময়িক কর্মবিরতিতে থাকাকালে ছাঁটাই (Retrenchment) এবং সাধারণভাবে বরখাস্ত (Suspension & Termination) করার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। করোনা ভাইরাস মহামারির কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কোনো কর্মীকে যদি লে অফ/ছাঁটাই এর পরিবর্তে বরখাস্ত করা হয় তাহলে তা আইনে গ্রহণযোগ্য হবে কিনা এ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা রয়েছে। এই অবস্থায় বরখাস্ত করা হলে এ ধরনের আদেশ বা নোটিশের কোন আইনগত বৈধতা থাকবে না কিংবা তা আইনে বিচারযোগ্য হবে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে ছাঁটাই বা বরখাস্ত করা আইন এবং নৈতিকতার দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয় কিন্তু আইনানুসারে লে-অফ ঘোষণা করা যেতে পারে কারণ লে অফ ঘোষণা করলে শ্রমিক অন্তত তার মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারবে এবং মালিক কিছুটা ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবে। মালিকের দিক টুকু বিবেচনায় নিয়ে লে অফের বিধান রয়েছে বলে আমি মনে করি।
সাধারণ ছুটি ঘোষণা ও আইনি জটিলতা:
সরকার ইতিমধ্যেই সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে যা সরকারের নির্বাহী আদেশ ও বিজ্ঞাপন আকারে প্রকাশিত হয়েছে এবং সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ আইনের অধীনে একটি আদেশ জারি করেছে যেখানে সারা দেশকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে এবং চলাচলের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে। এ সকল সরকারি আদেশ সমূহ আইন হিসেবে বিবেচিত হবে এবং এই আদেশ অমান্যকারীদের কে আইনের আওতায় আনা যাবে সুতরাং শ্রম আইনের ক্ষেত্রে এ ধরনের আদেশ গুলির আইনগত বাধ্যবাধকতা কি হবে এনিয়ে আইনজীবী ও সাধারণ মানুষের মধ্যেও একটি উদ্বেগ বিরাজ করছে। এ ধরনের মহামারির পরিস্থিতির কারণে সাময়িক কর্মবিরতিতে থাকাকালীন ছাঁটাই কিংবা বরখাস্তকরণ এ ধরনের আদেশ গুলো ন্যায় সঙ্গত নয় বলেই অনেকে মনে করেন। পাশাপাশি যাদের উপর শ্রম আইন প্রযোজ্য নয় তারাও সমতা ও ন্যায়পরায়ণতার নীতিতে পড়বেন বলে বিশেষজ্ঞরা মতামত প্রদান করছেন। এছাড়াও মালিক শ্রেণী-তার কার্যাদেশ বা ক্রয় আদেশ বাতিল হওয়া, ক্রেতার দেশে ফোর্স মেজার ঘোষণা করা কিংবা ক্রেতার অপারগতার কারণে তাঁর ব্যবসায়িক ক্ষতির কথা জানিয়ে তার স্বপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করতে পারে যে সাধারণভাবে আমরা শ্রমিক ছাটাই বা বরখাস্ত করতাম না যদি না আমাদের ক্রয় আদেশ বা ক্রেতার ফোর্স মেজারের কারণে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত না হতাম।
সুতরাং এ অবস্থায় নিকট ভবিষ্যতে আদালত ও আইনজীবী কর্তৃক শ্রমিকদের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
(বিশেষ দ্রষ্টব্য: উপরোক্ত বক্তব্য একটি আইনী বিশ্লেষন ও শিক্ষামূলক। ইহা আইনি মতামত/পরামর্শ হিসেবে গ্রহণ না করে প্রয়োজনে শ্রম আইন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়ার প্রতি উৎসাহিত করা হলো)
লেখক: মীর আব্দুল হালিম, আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।
ইমেইল: bnn.mir@gmail.com