মো. মোতাহার হোসেন সাজু:
করোনা ভাইরাস প্রথম সৃষ্ট হয় চীনের ওহান প্রদেশে। সেখানে প্রথম এই ভাইরাসটির তথ্য দেন চীনের ওহান কেন্দ্রীয় হাসপাতালের চক্ষু বিশেষজ্ঞ লি ওয়েন লিয়াংক, যিনি চীনা সরকারকে প্রথম সতর্ক করেছিলেন কিন্তু সরকার গুরুত্ব না দিয়ে উল্টো তাকে সতর্ক করেন। ফলে বিশ্বে প্রথম চীনা চিকিৎসক লি এর মৃত্যসহ প্রচুর প্রাণহানি ঘটে।
বাংলাদেশে গত ৮মার্চ করোনা ভাইরাস ইতালী প্রবাসী ব্যক্তির সংক্রমনের মাধ্যমে অভিষিক্ত হয়, প্রথমে তিনজন। পরে একের পর এক মৃত্যুর মিছিলে অনেকে। ইতোমধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আমাদেরকে সতর্ক করেছে বাংলাদেশে সম্ভাব্য প্রানহানি হতে পারে বিশ লক্ষ। করোনা সনাক্তের পর আমরা ৪৪ দিন অতিক্রম করছি। যেদিকে সারা বিশ্বে করোনা সনাক্ত ও মৃত্যুর পরিসংখ্যান প্রথম ৩০ দিন এর চেয়ে পরবর্তী ৩০ দিনের গড় ৮০ গুন, ১০০ গুন এবং ৬০ দিনের পর আরো বেশী। একইভাবে বাংলাদেশে আমরা অত্যান্ত ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি।
এক্ষেত্রে চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী কেউ নিরাপদ নয়। যখন করোনা ডিম্বানু ফোটানোর সময় সেই মুহুর্তে আমরা। ইতোমধ্যে যুক্ত হয়েছে খালেদা জিয়া’র প্যারোল মুক্তির সময় সহস্রাধিক নেতাকর্মীর সমাবেশ, সরকারী ছুটির প্রথম ধাপে হাজার হাজার চাকুরীজীবির বাড়ী ফেরা, বিজেএমই’র আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের কারনে গাজীপুরে জড়ো হওয়া গার্মেন্টস কর্মী, খেলাফত মজলিশের সিনিয়র আমীর আনসারী’র মৃত্যুতে জানাজার নামে হাজার হাজার লোকের সমাবেশ এর মধ্য দিয়ে তৈরী হচ্ছে করোনা ভাইরাস এর প্রজনন কেন্দ্র।
জানিনা ঐ প্রজনন কেন্দ্রের অংশীদারিত্বের দায়-দায়িত্ব এখন আইনজীবীদের উপর পড়ে কিনা? প্রতি মুহুর্ত শংকা হচ্ছে সংক্রমণের। আজ (২৩ এপ্রিল) সুপ্রিম কোর্টের পৃথক পৃথক প্রজ্ঞাপন জারী হয়েছে সারা দেশের জেলা ও দায়রা জজ, চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, ক্ষেত্রভেদে চীফ মেট্রোপলিটান ম্যাজিষ্ট্রেট কোর্ট সামাজিক দুরুত্ব বজায় রেখে সপ্তাহে ২দিন এবং সুপ্রীম কোর্ট এর আপীল বিভাগের চেম্বার জজ ও হাইকোর্ট বিভাগের একটি একক বেঞ্চ জরুরি মামলা শুনানীর জন্য নির্ধারন করা হয়েছে।
সরকার ইতোমধ্যে ৫ম ধাপে ৫ মে পর্যন্ত সরকারী ছুটি ঘোষনা করেছে। কিছু জরুরী পরিসেবা আওতা বহির্ভূত রাখা হয়েছে। যার মধ্যে কোর্ট এর নাম নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, সরকার প্রতিনিয়ত গণমাধ্যমে সতর্ক করছে ঘরে থাকার জন্য, সেই মুহুর্তে কোর্ট সীমিত পরিসরে চালু রাখাও আত্নঘাতি সিদ্ধান্ত। মানুষকে ঘরে রাখার জন্য জীবনের ঝুকি নিয়ে কাজ করে আর্মি, পুলিশ, Rab , অপরদিকে জীবনের ঝুকি নিয়ে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী ; ঠিক সেই মুহুর্তে সীমিত পরিসরে কোর্ট চালুর সিদ্ধান্ত।
সারা দেশে সামাজিক দুরুত্ব বজায় রেখে কোর্ট চালানো সংশ্লিষ্ট বার এসোসিয়েশন এর সহযোগিতা নিয়ে কতোটুকু সম্ভব ভাবতে অবাক লাগে। কোর্ট এর main stakeholders হচ্ছে বিচারক, বিচারপ্রার্থী, উভয়পক্ষের আইনজীবী, কোর্ট ষ্টাফ। এদের সমন্বয় ঘটিয়ে কোর্ট চালানো আবার সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা কতটুকু সম্ভবপর? যে কোন ক্রান্তিকালে কোর্টের রেওয়াজ ছিলো বারের সাবেক সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও সিনিয়র আইনজীবীদের সাথে পরামর্শক্রমে ক্রান্তিকাল উত্তোরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া, সেই রেওয়াজ এখন উঠে গেছে কিনা জানিনা?
করোনা ভাইরাসে সবচেয়ে ঝুকিতে বয়োজ্যেষ্ঠরা। বয়োজ্যেষ্ঠ stakeholders রা আরো বেশী ঝুকিতে পড়বে। বার এসোসিয়েশন তথা কতিপয় আইনজীবীদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য সীমিত পরিসরে কোর্ট চালু সংশ্লিষ্ট বারে মোট আইনজীবীর ১% ও নয়। সীমিত পরিসরে কোর্ট চালানোর সুবিধাভোগী কখনোই দরিদ্র/সীমিত আয়ের আইনজীবীরা হতে পারবে না। কারন তাঁদের মামলা তদবীর করার মতো উপযুক্ততা নেই। তাহলে কাদের স্বার্থে বার এসোসিয়েশন এর এমন দাবী বা দাবীর প্রেক্ষিতে প্রজ্ঞাপন জারী? কোর্ট চালুর মধ্য দিয়ে কোন ব্যাক্তির মৃত্যু হলে বা সংক্রমণ হলে এর দায়-দায়িত্ব কে নিবে?
যেখানে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট করোনা মহামারীতে দীর্ঘ মেয়াদী লকডাউনের কথা চিন্তা করে ৩টি virtual court চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং ১৮ মার্চ নোটিশ জারী করেছে। নোটিশে বলা হয়েছে শুধুমাত্র মৃত্যু দন্ডে দন্ডিত মামলা, পারিবারিক বিষয় সংক্রান্ত মামলা উভয় পক্ষের সম্মতির ভিত্তিতে ২৪ এপ্রিল এর মধ্যে আগ্রহ ব্যক্ত করে জানালে video conferencing এর মাধ্যমে virtual court এ শুনানী হইবে। Virtual court চালুর জন্য ভারতে সমস্ত access আছে, যেটা আমাদের নেই।
অপরদিকে, যুক্তরাজ্যে virtual court আছে কিন্তু লকডাউনে ভিডিও এবং অডিও লিংক বাড়ানোর জন্য The Coronovirus Bill 2020 অনুমোদন দিয়েছে। করোনা ভাইরাস থেকে কেউ নিজেকে, পরিবারকে বা দেশকে বাঁচাতে চাইলে সে মোটামুটি পারবে শুধুমাত্র সরকার ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম পালন করে ঘরে থেকে সামাজিক দুরুত্ব পালন করা।
বিচারক, আইনজীবী, বিচারপ্রার্থী, কোর্ট ষ্টাফসহ সকলকে করোনা ভাইরাস এর সংক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য মাননীয় প্রধান বিচারপতি, বার এসোসিয়েশন নেতৃবৃন্দের সুদৃষ্টি কামনা করছি।
লেখক- সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও সাবেক ডেপুটি এটর্নি জেনারেল, বাংলাদেশ।