আলমগীর মুহাম্মদ ফারুকী:
ঘরে ভাল খাবার রান্না হলে আনন্দ লাগাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু খেতে গিয়ে কিছুটা লজ্জা লাগলো। আমাদের চারপাশে এই কঠিন সময়ে যে সকল ব্যক্তির ন্যুনতম খাবারের চাহিদা মেটাতে কষ্ট হচ্ছে, কর্মহীন থাকার কারনে যাদের আয় উপার্জন নাই, তাদের বা তাদের নিষ্পাপ শিশু সন্তানদের কাছে নিজেকে অপরাধী মনে হলো। সত্যিই আমরা অপরাধী।
আফ্রিকার উপজাতিদের নিয়ে একটি খুব জনপ্রিয় ও সুন্দর গল্প আছে যার শিরোনাম হলো- ‘UBUNTU’। একজন নৃবিজ্ঞানী আফ্রিকার কোন এক গোত্রের উপজাতি শিশুদের নিয়ে একটি খেলার আয়োজন করলেন। এক ঝুড়ি মিষ্টি একটি গাছের পাশে রেখে শিশুদেরকে ১০০ মিটার দূরত্বে দাঁড় করিয়ে বললেন, যে আগে দৌঁড়ে এসে ঝুড়ি নিতে পারবে সেই মিষ্টিগুলো পাবে। প্রতিযোগিতা শুরু হলে শিশুরা হাতে হাত ধরে একসাথে দৌঁড়ে ঝুড়ির কাছে এলো এবং সবাই সেই মিষ্টিগুলো সমানভাবে ভাগাভাগি করে খেল। নৃবিজ্ঞানী শিশুদের জিজ্ঞাসা করলেন, তারা কেন এমনটা করল? শিশুরা একসাথে জবাব দিল- ‘UBUNTU’…যার মানে- “How can one be happy, when the others are sad”? তাদের উপজাতীয় ভাষায় ‘Ubuntu’ শব্দের অর্থ হলো – “I AM BECAUSE WE ARE”। করোনা ভাইরাসের কারনে সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয়ের সময়ে এই গল্পটি অনেকটা প্রাসঙ্গিক….
আমরা স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পরিচিতি পেতে যাচ্ছি। ঠিক এই সময়, এক অদৃশ্য শত্রু এসে উপস্থিত, যার নাম- ‘COVID-19’। মানবসম্প্রদায় এখন এই আণুবীক্ষণিক জীবাণু দ্বারা সৃষ্ট বিভীষিকা মোকাবিলা করছে। নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন এই বিষয়টিকে যুদ্ধের সাথে তুলনা করেছেন। চেনা শত্রুর সাথে যুদ্ধ করা যায়, তবে যে অচেনা সে অনেক ভয়ংকর। প্রথম বিশ্ব তথা উন্নত বিশ্ব যেখানে যুদ্ধে ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত, তৃতীয় বিশ্ব হিসেবে সেখানে আমাদের কি করা উচিত??
উন্নত বিশ্বের বিজ্ঞানীদের দিকে আমরা তাকিয়ে আছি, কখন আবিষ্কৃত হবে এই ভাইরাস প্রতিরোধের ভ্যাকসিন, ঔষধ বা প্রতিষেধক। লকডাউন চলছে। প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যার ছোট্ট একটি দেশ আমাদের, যেখানে সম্পদ ও আয়ের সুষম বন্টন নেই। অধিকাংশ গরীব লোকজন লকডাউন ও করোনা কি তা বুঝেইনা। তাদের বুঝানোও যাবেনা, তাদের জন্য ‘সামাজিক দূরত্ব’ নামের কথাটিই একটি বিলাসিতা ছাড়া আর কিছুই নয়। পেটের ক্ষুধা একসময় তাদেরকে প্রতিবাদী করে তুলবে। আমরা জানি- ‘A hungry man is always an angry man’. এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হবার জন্য আমরা কি প্রস্তুত? কতটুকু নাগরিক দায়িত্ব পালন করলে মানুষ হিসেবে আমরা প্রত্যেকে আমাদের দায়িত্বহীনতার লজ্জাবোধকে ঢাকতে পারব?
“সমগ্র সৃষ্টি আল্লাহ্-র পরিজন। আল্লাহ্-র কাছে সবচেয়ে প্রিয় সেই ব্যক্তি, যে তার পরিজনের প্রতি বেশি অনুগ্রহশীল”- মহানবী (সাঃ) এর এই মহান বাণীর প্রতি আমরা কতটুকু আন্তরিক? দাবীমতে আমরাতো অধিকাংশই মুসলমান। “যার অনিষ্ট থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদ নয় সে মুমিন নয়”। “ঐ ব্যক্তি মুমিন নয়, যে ব্যক্তি পেট পুরে খায় আর তার প্রতিবেশী পাশে ক্ষুধার্ত থাকে”। পবিত্র হাদীসের এই মহান বাণীর মর্মমতে এদেশে এখন মুমিন বা মুসলমান কারা তা নির্ণয় করার সময় এসে গেছে…
ফেইসবুকে করোনা আক্রান্তের মৃত্যুর হিসেবের সাথে সাথে চাল চোর, ত্রান চোরের পরিসংখ্যান দিচ্ছেন কৌতুহলীরা। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, এই সকল চোরদের সংখ্যা মৃত ব্যক্তিদের সংখ্যার সাথে সমান তালে বাড়ছে। পবিত্র কোরআন শরীফের আয়াতগুলোতে দুই ধরনের বার্তা রয়েছে। এক- সৃষ্টিকর্তার প্রতি দায়িত্ব, দুই- সৃষ্টিকূলের প্রতি দায়িত্ব। সহজ কথায় স্রষ্টার প্রতি দায়িত্বে অবহেলায় ক্ষমা পাবার সু্যোগ সহজ হয়ে থাকে, কিন্তু সৃষ্টির প্রতি দায়িত্বে অবহেলার ক্ষমার সুযোগ ততটা সহজ নয়। এটি ‘হাক্কুল ইবাদ’। মহান আল্লাহ্-র ঘোষনা প্রায় এমনি-ই…
মা-কে তার সন্তানরা জংগলে ফেলে চলে যায়, মৃত ব্যক্তির লাশকে গ্রহন করার জন্য কতেক ক্ষেত্রে কাউকে পাওয়া যায়না। দাফন-কাফন, জানাযার জন্য কেউ সহজে এগিয়ে আসেনা। কুর্মিটোলা হাসপাতালে পিপিই পরা সন্তান বাবার মৃতদেহ ফেলে রেখে চলে গেছে। নিয়ে গেছে বাবার ডেথ সার্টিফিকেট, পেনশনের টাকা তোলার জন্য। পিতামাতা-সন্তান, স্বামী-স্ত্রী পরস্পর কাউকে চিনতে আগ্রহী নন, ভাই ভাইয়ের কাছে আসছেনা। এই যেন হাসরের মাঠের এক কঠিন মক ট্রায়াল (Mock Trial)…
করোনা পজিটিভ রোগী কিংবা তার নিকট স্বজনরা কতটা অসহায় তা যেন চোখ বন্ধ করলেই কল্পনা করতে পারছি। পত্রিকার খবরে এসেছে, কতেক ক্ষেত্রে রোগীর বাড়িতে আশপাশের প্রতিবেশীরা হামলা করছেন। হাসপাতালে কিংবা অন্যখানে জীবিত বা মৃত এ সকল হতভাগ্য রোগীদের স্পর্শ করা যেন পাপ! এই দৃষ্টিভঙ্গি এখনিই বদলাতে হবে। বাড়ীতে, পাড়ায়, হাসপাতালে এই অসহায় অসুস্থদের প্রতি মানবিক আচরন করতে হবে। কে যেন একবার বলেছিল, “দূরের মানুষকে ভালবাসা সহজ কিন্তু কাছের মানুষকে ভালবাসা কঠিন”। এই বক্তব্যটির ব্যাখ্যা অনেক সুদূরপ্রসারী ও শিক্ষনীয়। ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন, ফিলিস্তিন ও কাশ্মীরি জনগণের জন্য আমরা হাহাকার করি। এক্ষেত্রে আমদের উপর কোন দায়িত্ব বর্তায় না, শুধু সমবেদনা দেখালেই চলে। কিন্তু আমার পাশে বুভুক্ষু, দরিদ্র ও রোগাক্লিষ্ট মানুষকে শুধু ভালবাসা ও সমবেদনা দেখালেই দায়িত্ব শেষ হয়না, তার প্রতি সময়, অর্থ ব্যয় করতে হয়। এজন্য দূরের কারো প্রতি মেকি ভালবাসা না দেখিয়ে প্রতিবেশীকে ভালবাসুন…
পবিত্র কোরআন ও হাদীসের মূল বানী যা ইসলামী দার্শনিক মাওলানা জালালুদ্দিন রুমির সেই উক্তিতে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে- “Remember, The way you make love is the way God will be with you.” জীবকে, জীবনকে, মানুষকে ভালবাসার মধ্যে মুক্তি নিহিত। এ বিষয়টা চারিদিকে ছড়িয়ে দেয়ার সময় এসেছে। নামাযী মুমিনের পাশাপাশি অন্যের সম্পদ হরন না করা, দায়িত্ব পালনে অবিচল থাকা, অন্যের অধিকারের দিকে সচেতন থাকা মুসলমান বা মুমিন প্রয়োজন। সকল ধর্মের যে মানবিক ও ভালবাসার দিক রয়েছে বিশ্বাসমতে তা চর্চা করার সময় এখন। নতুবা নিজেকে ধার্মিক দাবী করা কপটতা, ভন্ডামি। “জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর”- স্বামীজীর এই কথার মূল মন্ত্রই হলো মানবিক ও ভালবাসার সমাজ সৃষ্টি করা। এজন্য আসুন মায়া ছড়িয়ে দিই চারিদিকে…
এই কঠিন বাস্তবতায় কতটুকু টিকে থাকতে পারব আমরা জানিনা। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অনেক ব্যয়বহুল এবং তা দিয়ে চিকিৎসা আরও সুদূর পরাহত। উন্নত বিশ্ব এক্ষেত্রে অনেকাংশে অসহায়ত্ব প্রকাশ করছে। চিকিৎসা বিজ্ঞান এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে এখনো জয়ী বা সফল হতে পারেনি। তাই আমরা এ-ই ভাইরাসের সাথে যুদ্ধে বাস্তবিকভাবে বিজ্ঞানকে সম্পূর্ণভাবে পাশে পাবনা- এটাই সত্য। তাই মানুষকে নিয়ে, মানবিকতাকে সাথে করে এই জীবানুর বিরুদ্ধে লড়ে যেতে হবে। এটাই হবে সঠিক বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থান, এটাই হোক ব্রত। আমরা একে এভাবেই জয় করতে চাই…
সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে পরিচয় দিতে আমরা পছন্দ করি। নিজের দায়িত্বের দিকে খেয়াল না করে সরকার কিংবা অন্যের সমালোচনায় আমরা সিদ্ধহস্ত। এই আমরাই আবার জাতির দূর্দিনে স্বার্থপর হয়ে পড়ি। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়াতে, এমনকি চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট বস্তুর দাম বাড়াতে আমাদের লজ্জা লাগেনা। এমনটাই হচ্ছে, হয়ে আসছে। অনেকক্ষেত্রে করোনা আক্রান্ত রোগীরা তথ্য গোপন করে চিকিৎসা নিতে গিয়ে সবার ভরসাস্থল চিকিৎসক ও চিকিৎসা ব্যবস্থাকে হুমকিতে ফেলছেন। ‘নিজেকে বদলাও’ – এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রশংসা করি, তবে তা নিজে চর্চা করিনা। এভাবে আর কতদিন চলবে? পবিত্র রমজানের শিক্ষাও কি আমাদের মধ্যে পরিবর্তন আনবেনা??
সৃষ্টির মাঝে অনাসৃষ্টি থাকে। থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। সুরা মূলকে মহান আল্লাহ্ তা’য়ালা বলেছেন, “যিনি সৃষ্টি করেছেন মরণ ও জীবন, যাতে তোমাদেরকে পরীক্ষা করেন-কে তোমাদের মধ্যে কর্মে শ্রেষ্ঠ”? সেই পরীক্ষার মূল সময়টা হয়তো এখনই। অনাসৃষ্টি বা ধ্বংস নয়, বরং সৃষ্টিশীলতা দিয়ে জাতিকে আমরা বাঁচাব…এই হোক অংগীকার…
মানুষ জেগে উঠেছে। তারা নিজেরাই গম-চাল চোরদের ধরিয়ে দিচ্ছে, ঘৃনা করছে। সরকার এই অপরাধীদের ছাড় না দেবার বিষয় বার বার ব্যক্ত করেছেন। সরকারের বিভিন্ন সংস্থাসহ স্বেচ্ছাসেবীরা এই সময় মাঠে কাজ করছেন। অসংখ্য চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মী এই ভাইরাসের সংক্রমণের শিকার হয়েছেন। এই প্রতিরোধ যুদ্ধে বিভিন্ন সরকারি সংস্থার কেউ আক্রান্ত হলে তাদের জন্য নানা প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে। আমরা এই কঠিন সময়ে মহান প্রভুর নিকট অসহায় হয়ে নিজেকে সমর্পন করছি। এখনই সময় মানুষের জন্য অন্য মানুষদের ভালবাসা দেখানো…
বল কি তোমার ক্ষতি/জীবনের অথৈ নদী/পার হয় তোমাকে ধরে দুর্বল মানুষ যদি/মানুষ যদি সে না হয় মানুষ/দানব কখনো হয় না মানুষ/যদি দানব কখনো বা হয় মানুষ লজ্জা কি তুমি পাবে না? আসুন, শিল্পী ভূপেন হাজারীকার এই কালজয়ী সৃষ্টির মূল মন্ত্রে উজ্জীবিত হই। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ের সেই একতা ও ত্যাগ আমাদের মধ্যে সঞ্চারিত হোক। এই দুর্দিনকে মানবিকতা ও মূল্যবোধ দিয়ে জয় করে পৃথিবীকে দেখিয়ে দিই…
আবারো ধর্মের মূল মন্ত্রে উজ্জীবিত হই, নৈতিকতাকে হৃদয়ে ধারণ করি। আমরা বলি- আমাদের পাশের একজনকেও না খেয়ে মরতে দিবনা। নিজের সুখ ও আনন্দকে কমিয়ে দিই, অন্যের সাথে ভাগাভাগি করি। বিলাসিতাকে বর্জন করি। সৎ হই। একজন একেক জনের দায়িত্ব নিই। মাদার তেরেসা বলেছিলেন, “যদি তুমি একশো মানুষকে সাহায্য করতে সক্ষম না হও, তাহলে অন্তত একজনকে সাহায্য করো।” এজন্য গোপন বা প্রকাশ্যে সম্পদের অংশ দান করি। স্বার্থপরতাকে হারিয়ে দিই। ভোগ নয়, ত্যাগেই সন্তুষ্ট হই….
সরকারি দায়িত্ববানরা আরো দায়িত্বশীল হোক। চিকিৎসকের হাত হোক আরো কোমল ও আন্তরিক। বিচারক ও পুলিশের আইনের হাত আরো কঠোর হোক। রাজনীতিবিদরা আরো জনবান্ধব হোক। প্রশাসন হোক আরো মানবিক। সাধারন জনগন হোক একে অপরের জন্য নিবেদিতপ্রাণ। এখন সময় ভালবাসার, ত্যাগের। আসুন, তা-ই করি, অন্তত এই জরাকে পৃথিবী থেকে বিদায় না দেয়া পর্যন্ত। তখন এই পৃথিবী অবাক বিস্ময়ে দেখবে- ‘এই বাঙালি জাতি এ-ই মরন ঘাতককে চিকিৎসা বিজ্ঞান দিয়ে পরাজিত করতে না পারলেও মানুষে মানুষে ভালবাসা দেখিয়ে একে ব্যর্থ করে দিয়েছে’। এমন কাজ করি যেন এই দেশ ও এই মানুষরা ইতিহাসের অংশ হয়ে যায়, যেমন হয়েছিল সেই মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়। পৃথিবীর অন্যদের জন্য আমরা যেন উদাহরণ হতে পারি এবং সে উদাহরণ যেন হয় আনন্দের ও অহংকারের…
লেখক- অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ, নোয়াখালী।