রাইসুল ইসলাম সৌরভ:
বিশ্বব্যাপী নভেল করোনাভাইরাস (COVID-19) আমাদের জীবনে কেবল সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিকভাবেই গুরুতর প্রভাব ফেলেনি বরং এই মারাত্মক মহামারির আইনি ক্ষেত্রেও রয়েছে গভীর প্রভাব। প্রাণঘাতী COVID-19 এর ব্যাপক প্রসার রুখতে দুনিয়া জুড়ে যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তা ঘিরে কিছু কৌতূহল উদ্দীপক আইনি প্রশ্নও দেখা দিয়েছে; যথাঃ ব্যক্তি স্বাধীনতা, সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা, ধর্মপালনের স্বাধীনতা, বিদেশে অবস্থানরত নাগরিকের নিজের দেশে পুনরায় প্রবেশের অধিকার বা সে সবের বিনিময়ে বৃহত্তর মঙ্গল (Public Good) নিশ্চিত করা প্রভৃতি। ইতোমধ্যে নাগরিকদের এসব মৌলিক অধিকারের কয়েকটি জনস্বাস্থ্য রক্ষায় সমগ্র পৃথিবীতেই সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছে। বাংলাদেশেও অনুরূপভাবে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ন্যায় করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনের পাশাপাশি হোম কোয়ারেন্টাইন সহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে এবং যার ফলে নাগরিকদের কিছু আইনি অধিকার যেমনঃ স্বাধীন ভাবে চলাফেরার অধিকার সাময়িক ভাবে স্থগিত হয়ে পড়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরই তো মধ্যে সে সব বিধি-নিষেধ মেনে চলার জন্য ও জনগণের মধ্যে সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে ২০১৮ সালে প্রণীত সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইনানুসারে সংবাদ মাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি ও প্রকাশ করেছে।
মহামারি রূপে আবির্ভূত হওয়া নভেল করোনাভাইরাসের সঙ্গে অনেকগুলি আইনি প্রশ্ন জড়িত থাকলেও দেশব্যাপী যেহেতু কোয়ারেন্টাইন নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে এবং অনেকেই কোয়ারেন্টাইন না মেনে যথেচ্ছা ঘোরাফেরা করছেন; এমন কি আমরা দেখলাম করোনা হটস্পট ফেরত অনেক প্রবাসী বাংলাদেশী প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে না যেয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে যার যার বাড়ি ফেরত গেলেন, সেহেতু এই প্রবন্ধে কেবল মাত্র কোয়ারেন্টাইনের সঙ্গে সম্পর্কিত নাগরিক অধিকার সমূহ আলোচনা করা হলো।
কোয়ারেন্টাইন বলতে এমন এক অবস্থা বোঝানো হয় যেখানে কোন ব্যক্তি সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত অপর কোন ব্যক্তির সংস্পর্শে আসলে বা রোগাক্রান্ত কোন এলাকা থেকে ঘুরে ফিরলে ওই ব্যক্তি ও রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েন কিনা তা পর্যবেক্ষণ করতে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সকলের থেকে তাকে আলাদা করে রাখা। এখানে বিশেষভাবে মনে রাখা প্রয়োজন যে, আপাত ভাবে কোন ব্যক্তিকে স্বাস্থ্যবান মনে হলেও বা তার ভেতর কোন উপসর্গ না থাকলেও এরূপ ক্ষেত্রে তাকে কোয়ারেন্টাইনে যেতে হবে। কারণ আপাত উপসর্গহীন ব্যক্তিও ভাইরাসের দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে এবং উপসর্গ প্রকাশ পেতে নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হওয়ার প্রয়োজন পড়ে।
কোয়ারেন্টাইন শব্দের উৎপত্তি ইতালিয়ান শব্দ ‘কোয়ারান্টাগিরোনি’ থেকে; যার অর্থ চল্লিশ দিন। চতুর্দশ শতাব্দী থেকে ইতালির ভেনিস বন্দরে প্লেগ রোগাক্রান্ত এলাকা থেকে কোন জাহাজ আসলে তাকে চল্লিশ দিনের পূর্বে তীরে ভিড়তে দেয়া হতো না; সেখান থেকেই মূলত ছোঁয়াচে রোগের ক্ষেত্রে কোয়ারেন্টাইনের প্রচলন। কোয়ারেন্টাইনের উদ্ভবের সঙ্গেই এর সাথে যুগযুগ ধরে ব্যক্তি স্বাধীনতার বিরোধ চলমান।
বাংলাদেশে সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন ২০১৮ এর ৫(১) উপ ধারানুসারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কেবল মাত্র সংক্রামক রোগে আক্রান্ত সন্দেহ ভাজন কোন ব্যক্তিকে কোয়ারেন্টাইনের আদেশ দিতে পারে। কিন্তু এই সন্দেহ কি স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে নাকি উপসর্গ দেখে নির্ধারিত হবে সে বিষয়ে আইনে কিছু বলা নেই। আইনে শুধু রোগে ইতোমধ্যে আক্রান্ত হওয়ার সন্দেহের কথা বলা হয়েছে; রোগাক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা বা ব্যাধিগ্রস্ত কোন এলাকা থেকে ফেরত আসা ব্যক্তিকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়নি। সুতরাং বর্তমান আইনানুযায়ী আপাত ভাবে স্বাস্থ্যবান কোন মানুষকে কোয়ারেন্টাইনে নেয়ার সুযোগ নেই। কারণ গবেষণা বলছে করোনা ভাইরাসের উপস্থিতি মানব শরীরে পেতে বা উপসর্গ প্রকাশ পেতে চৌদ্দ বা ততোধিক দিন সময় লাগতে পারে। কাজেই জনস্বার্থে এ রকম ব্যক্তিকে কোয়ারেন্টাইনে নিতে হলে আইনটি সংশোধন করাপ্রয়োজন।
তবে কেউ কোন ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত এ রকম বিশ্বাসযোগ্য তথ্য থাকলে তাকে কোয়ারেন্টাইনে নেয়া যেতে পারে এবং সে যেতে না চাইলে বা আদেশ অমান্য করলে আমলঅযোগ্য, জামিনযোগ্য ও আপোষযোগ্য অপরাধ সংগঠন করেছে বলে প্রতীয়মান হবে। যার জন্য তার সর্বোচ্চ তিন মাস কারাদণ্ড অথবা পঞ্চাশ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয়দণ্ড হতে পারে। সংক্রামক রোগ আইনানুসারে এই আইনের অধীনে সংগঠিত অপরাধের অভিযোগ, তদন্ত, বিচার ও আপিল ফৌজদারী কার্যবিধি অনুযায়ী নিষ্পত্তি হবে। তাই এই আইন অনুযায়ী কেউ অপরাধ করলে ভ্রাম্যমাণ আদালতে বিচার করার সুযোগ নেই। তবে ভ্রাম্যমাণ আদালত চাইলে দণ্ডবিধির ২৬৯-২৭১ ধারার অধীনে সংক্রামক ব্যাধি ছড়িয়ে দেয়ার অপরাধে বিচার করতে পারে। কোয়ারেন্টাইনের আদেশ কেউ চ্যালেঞ্জ করতে পারবে কিনা সে বিষয়ে এই আইনে কিছু বলা না থাকলেও সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি চাইলে হাইকোর্টে রীট দায়ের করতে পারেন।
একথাঅনস্বীকার্যযে, বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে করোনাভাইরাসের ব্যাপক সংক্রমণ রুখতে কোয়ারেন্টাইন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ নাগরিকের এমন কোন আইনি অধিকার নেই যা ব্যক্তিকে স্বেচ্ছাচারিতা করে আপামোর জনতার ক্ষতিসাধনের অনুমোদন দেয়। তাছাড়া আইনের একটি সাধারণ নীতি হল কেউ যদি তার নিজের অথবা সমাজের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় তবে সে অপরাধ না করলেও বৃহত্তর মঙ্গলের স্বার্থে তাকে আটক করে রাখা যায়।
অপর দিকে, কোয়ারেন্টাইন অবশ্যই কোন স্বস্তিদায়ক বিষয় নয়; এমন কি তা যদি নিজবাস গৃহেও হয়। সুতরাং কাউকে কারণ না জানিয়ে, স্বৈরতান্ত্রিক উপায়ে বা আইনের যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে কোয়ারেন্টাইনে নেয়া যায় না। যদিও কোয়ারেন্টাইনে নেয়া ব্যক্তি চাইলেই কোয়ারেন্টাইন থেকে মুক্তি পেতে পারেন না; তবে তাকে কোয়ারেন্টাইনে নেয়ার প্রক্রিয়া আইনানুগ ছিল কিনা সে বিষয়ে নিশ্চয় জানতে চাইতে পারেন এবং কোয়ারেন্টাইন কালীন সময় তিনি পর্যাপ্ত খাবার, বসবাসোপযোগী পরিবেশ, চিকিৎসা, কোয়ারেন্টাইনে যাবার কারণ, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা প্রভৃতি পাওয়ার অধিকারী।
কোভিড-১৯ আমাদের এমন এক বাস্তবতার সম্মুখীনে দাঁড় করিয়েছে যেখান থেকে পরিত্রাণ পেতে আমাদের সকলকেই ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে হলেও একে অপরের পাশে দাঁড়াতে হবে; তবে তা অবশ্যই আইনি অধিকার পরিত্যাগ করে অথবা যথাযথ আইনানুগ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে নয়।
লেখক- ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।