মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ্ আল-গালিব খান:
আজ পহেলা মে, আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস।১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের ন্যায্য মজুরি আর দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল এবং প্রাণের বিনিময়ে যে অধিকার শ্রমিকরা আদায় করতে সক্ষম হয়েছিল তারই ফলস্বরুপ ১৮৮৯ সালের ১৪ই জুলাই ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে ১ মে শ্রমিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরের বছর ১৮৯০ সাল থেকে পহেলা মে-কে বিশ্বব্যাপী ‘মে দিবস’ বা ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। শ্রমিকদের এই গৌরবের কথা সবার জানা। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায় শ্রমিকদের রক্তমাখা সেই আন্দোলনের মর্যাদা নিশ্চিত করতে পেরেছি আমরা!
এ বছর এক ভিন্ন পরিস্থিতিতে পালিত হচ্ছে মে দিবস। করোনা ভাইরাসের কারণে বিশ্ব যখন স্থবির, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চলছে কারফিউ বা লকডাউন। কর্মহীন অবস্থায় ঘরে বন্দি লাখ লাখ শ্রমিক। এমন অবস্থায় শ্রমিকদের অধিকার কতটুকু রক্ষিত হচ্ছে সে প্রশ্ন তোলা মনে হয় অযৌক্তিক নয়।
আমাদের সংবিধানে উল্লেখ করা হয়েছে রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হল মেহনতি মানুষ, কৃষক-শ্রমিকের সকল প্রকার শোষনের হাত থেকে মুক্ত করা তথা তাদের অধিকার নিশ্চিত করা।
বাংলাদেশে শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা বিষয়ক প্রধান আইন শ্রম আইন ২০০৬, এর পাশাপাশি রয়েছে শ্রম বিধিমালা ২০১৫। এছাড়াও রয়েছে বেশ ক’টি আইন।
শ্রম আইন ২০০৬ এর প্রস্তাবনায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, শ্রমিক নিয়োগ, মালিক ও শ্রমিকের মধ্যে সম্পর্ক, সর্বনিম্ন মজুরীর হার নির্ধারণ, মজুরী পরিশোধ, কার্যকালে দুর্ঘটনাজনিত কারণে শ্রমিকের জখমের জন্য ক্ষতিপূরণ, ট্রেড ইউনিয়ন গঠন, শিল্প বিরোধ উত্থাপন ও নিষ্পত্তি, শ্রমিকের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, কল্যাণ ও চাকুরীর অবস্থা ও পরিবেশ এবং শিক্ষাধীনতা ও সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি সম্পর্কে এই আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। এই আইনে মোট ২১ টি অধ্যায় রয়েছে। আমরা অধ্যায়গুলোর শিরোনামের দিকে নজর দিতে চাই।
- নিয়োগ ও চাকুরীর শর্তাবলী,
- কিশোর শ্রমিক নিয়োগ,
- প্রসূতি কল্যান সুবিধা,
- স্বাস্থ্য রক্ষা ব্যবস্থা,
- নিরাপত্তা (বিভিন্ন যন্ত্র এবং ক্ষতিকারক গ্যাস ও বর্জ্য থেকে),
- স্বাস্থ্য, স্বাস্থ্য বিধি ও নিরাপত্তা সম্পর্কে বিশেষ বিধান,
- কল্যাণমূলক ব্যবস্থা (খাবার,ক্যান্টিন এবং গ্রুপ বীমা),
- কমর্ঘন্টা ও ছুটি,
- মজুরী ও তার পরিশোধ,
- মজুরী বোর্ড,
- দুর্ঘটনাজনিত কারণে জখমের জন্য ক্ষতিপূরণ,
- ট্রেড ইউনিয়ন এবং শিল্প সম্পর্ক বিরোধ নিষ্পত্তি, শ্রম আদালত, শ্রম আপীল ট্রাইব্যুনাল, আইনগত কার্যধারা, ইত্যাদি,
- মুনাফায় শ্রমিকের অংশগ্রহণ,
- ভবিষ্য তহবিল,
- শিক্ষাধীনতা,
- অপরাধ, দন্ড এবং পদ্ধতি,
- প্রশাসন, পরিদশর্ন, ইত্যাদি।
অনুমান করা যাচ্ছে এটি একটি হেলদি আইন। এই আইনের কথাগুলো খুব সুন্দর এবং শ্রমিক বান্ধবও বটে। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ কতটুকু হচ্ছে সে সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা যায়। আলোচনা দীর্ঘ না করার লক্ষ্যে আমরা শুধু কর্মপরিবেশ এবং নিরাপত্তা বিষয়ে দু একটা উদাহরণ দিতে চাই।
আইনের ৫১ ধারায় পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে বলা হয়েছে
“প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানকে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে এবং কোন নর্দমা, পায়খানা বা অন্য কোন জঞ্জাল হতে উত্থিত দূষিত বাষ্প হতে মুক্ত রাখতে হবে, এবং বিশেষ করে
(ক) প্রতিষ্ঠানের মেঝে, কর্মক্ষেত্র, সিড়ি, যাতায়াতের পথ হতে প্রতিদিন ঝাড়ু দিয়ে ময়লা ও আবর্জনা উপযুক্ত পন্থায় অপসারণ করতে হবে;
(খ) প্রত্যেক কর্মক্ষেত্রেরর মেঝে সপ্তাহে অন্ততঃ একদিন ধুতে করতে হবে, এবং প্রয়োজনে ধোয়ার কাজে জীবানুনাশক ব্যবহার করতে হবে;
(গ) যে ক্ষেত্রে কোন উৎপাদন প্রক্রিয়ার কারণে কোন মেঝে এমনভাবে ভিজে যায় যে, তার জন্য পানি নিষ্কাশনের প্রয়োজন হয়, সেক্ষেত্রে পানি নিষ্কাশনের উপযুক্ত ব্যবস্থা করতে হবে;
(ঘ) প্রতিষ্ঠানের সকল আভ্যন্তরীণ দেওয়াল, পার্টিশন, ছাদ, সিড়ি, যাতায়াতপথ-
১) রং বা বার্নিশ করা থাকলে, প্রত্যেক তিন বৎসরে অন্ততঃ একবার পুনঃ রং বা বার্নিশ করতে হবে,
(২) রং অথবা বার্নিশ করা এবং বহির্ভাগ মসৃণ হলে, প্রতি চৌদ্দ মাসে অন্ততঃ একবার তা বিধিদ্বারা নির্ধারিত পন্থায় পরিস্কার করতে হবে,
(৩) অন্যান্য ক্ষেত্রে, প্রতি চৌদ্দ মাসে অন্ততঃ একবার চুনকাম বা রং করতে হবে।
অগ্নিকান্ড সম্পর্কে সতর্কতা সম্পর্কে ৬২ ধারায় বলা হয়েছে, প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে বিধি দ্বারা নির্ধারিতভাবে অগ্নিকান্ডের সময় প্রত্যেক তলার সাথে সংযোগ রক্ষাকারী অন্ততঃ একটি বিকল্প সিঁড়িসহ বহির্গমনের উপায় এবং প্রত্যেক তলায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জামের ব্যবস্থা করতে হবে৷ কতগুলো কর্মক্ষেত্র এমন ব্যবস্থা রয়েছে তা পরিষ্কার হয়েছে রানা প্লাজা এবং তাজরিন ফ্যাশান অগ্নিকান্ডের মধ্যদিয়ে।
দেশের মোট রপ্তানি আয়ের সিংহভাগই আসে তৈরি পোশাক থেকে৷ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৮৩ ভাগ আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮৪ ভাগই যোগান দিয়েছে এই খাত। বর্তমানে বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পে ৪০ লাখের মতো শ্রমিক কাজ করেন, যার অধিকাংশই নারী৷ আমরা দেখেছি করোনা সংকটে স্বাস্থ্য ঝুকির মাঝেও কারখানা খোলা বন্ধের একটা লুকোচুরি খেলা হয়েছে। শ্রমিকরা বেতন ভাতার জন্য নারায়নগঞ্জ এবং ঢাকায় আন্দোলন করেছে, এসময়ে এমন চিত্র সত্যি দুঃখজনক। ইতিমধ্যেই সরকারের হস্তক্ষেপে এই অবস্থার সমাধান হয়েছে। স্বল্প পরিসরে খুলছে গার্মেন্টস গুলো। তাদের বেতন ভাড়া সম্পর্কেও মন্ত্রনালয় থেকে দিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা দেয়া হয়েছে এই সেক্টরে। আমরা আশা করবো যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনেই কারখানাগুলো সচল থাকবে এবং সম্ভাবনাময় এই খাত রক্ষা পাবে।
বিভিন্ন সময় শ্রমিক সংগঠনগুলো খুব বড় বড় কথা বললেও বর্তমান এ সংকটে তাদের ঠিক সেভাবে আর দেখা যাচ্ছে না। যাদের নির্দেশে নিমিষেই গণপরিবহন বন্ধ হয়ে যেত, রাজপথে নেমে যেত হাজার হাজার পরিবহন শ্রমিক, কেন জানি সেই কর্তাব্যক্তিরা লোকচক্ষুর আড়ালে। বর্তমানে দেশের পরিবহন সেক্টরের সঙ্গে ৭০ লাখের বেশি শ্রমিক জড়িত। মূলত তারা দৈনিক মজুরীর ভিত্তিতে কাজ করেন। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রভাবে ২৬ মার্চ হতে পরিবহন চলাচল বন্ধ ঘোষণার পর থেকে এসব শ্রমিক কার্যত বেকার হয়ে পড়েছেন,অনাহারে-অর্থাভাবে কাটাচ্ছে দিন। শ্রমিকদের কথা মতে, তাদের কল্যাণ তহবিলের নামে প্রতিদিন যে অর্থ আদায় করা হয় সেই টাকার সামান্য অংশও যদি তাদের জন্য ব্যয় করা হতো, তাহলে শ্রমিকদের বেহাল দশা হত না।
এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশের বাণিজ্যিক প্রতিটি যানবাহন থেকে মালিক-শ্রমিক সংগঠনের নামে ঘোষণা দিনে ৭০ থেকে ১২০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করা হয়। দেশে সব মিলিয়ে বাণিজ্যিক যানবাহন আছে ৮ লাখের বেশি। সে হিসাবে সর্বনিম্ন ৭০ টাকা ধরে হিসাব করলেও বছরে দুই হাজার কোটি টাকার বেশি চাঁদা আদায় হয়। যদিও শ্রমিক সংগঠনগুলো বলছে তারা যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে শ্রমিকদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে।
এছাড়াও আমরা সংবাদপত্রে প্রায়শই দেখি, জাহাজ ভাঙ্গা শ্রমিক, সরকারী পাটকল শ্রমিক, চিনি কল শ্রমিকসহ সরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গুলোর শ্রমিকদের আন্দোলন এবং অসন্তোষেরর খবর।সে অর্থে বলা যায় সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রমিকদের অবস্থাও নাজুক।
বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যান ফাউন্ডেশন আইন ২০০৬ এর ৫ ধারা অনুসারে ফাউন্ডেশনের কার্যাবলী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে
(ক) শ্রমিক ও তার পরিবারের কল্যাণ সাধন;
(খ) শ্রমিক ও তার পরিবারের কল্যাণার্থে, বিভিন্ন প্রকার প্রকল্প গ্রহণ ও তার বাস্তবায়ন;
(গ) শ্রমিকদের বিশেষতঃ অক্ষম বা অসমর্থ শ্রমিকদের আর্থিক সাহায্য প্রদান;
(ঘ) অসুস্থ শ্রমিকের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা বা আর্থিক সাহায্য প্রদান;
(ঙ) দূর্ঘটনায় কোন শ্রমিকের মৃত্যু ঘটলে তার পরিবারবর্গকে সাহায্য প্রদান;
(চ) শ্রমিকের পরিবারের মেধাবী সদস্যকে শিক্ষার জন্য বৃত্তি কিংবা স্টাইপেন্ড প্রদান;
(ছ) শ্রমিকদের জীবন বীমাকরণের জন্য যৌথ বীমা ব্যবস্থার প্রবর্তন করা এবং এই লক্ষ্যে তহবিল হইতে সংশ্লিষ্ট বীমা প্রতিষ্ঠানকে প্রিমিয়াম পরিশোধ করা;
(জ) তহবিল পরিচালনা ও প্রশাসনিক উদ্দেশ্যে অন্যান্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করা।
করোনা ভাইরাসের কারণে কর্মহীন হয়ে পড়া দিনমজুর, রিক্সা বা ভ্যান চালক, মটর শ্রমিক, নির্মাণ শ্র্রমিক, পত্রিকার হকার, হোটেল শ্র্রমিকসহ অন্যান্য পেশার মানুষ ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা পাবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।১৩ এপ্রিল বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে তিনি এ ঘোষণা দেন। অবশ্যই এই মহৎ কাজের জন্য তিনি প্রসংশা পাবার দাবীদার।
বাংলাদেশ ১৯৭২ সালে আই এল ও কনভেনশনে অনুস্বাক্ষর করে। সে হিসেবে ৪৮ বছর পার করেছি আমরা। সে অর্থে শ্রমিক অধিকার এবং কর্মপরিবেশসহ নানা সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা সম্ভব হয় নি।আশার কথা ইপিজেডগুলো এবং বিভিন্ন বেসরকারী প্রতিষ্ঠান সত্যিকার অর্থেই আইন মেনে কর্মপরিবেশ এবং শ্রমিক অধিকার নিশ্চিত করেছে। যা অবশ্যই রোল মডেল।
- আমরা চাই শ্রম আইন যথাযত ভাবে প্রয়োগ করা হোক। এর মধ্য দিয়েই শ্রমিকরা ন্যায্য মজুরি ও নিরাপদ কর্মস্থলের নিশ্চয়তা পাবে। শ্রমিক সংগঠনগুলো প্রকৃত অর্থে শ্রমিকদের কল্যানে এগিয়ে আসুক। মালিকরাও শ্রমিকদের শ্রমের মূল্য যথাযত ভাবে উপলব্ধি করুক। তবেই অর্থনৈতিক ভাবে যেমন আমরা এগিয়ে যাব তেমনি শ্রমিক দিবসের যথাযথ মূল্যায়ন করা হবে।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই
“আসিতেছে শুভদিন,
দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা শুধিতে হইবে ঋণ! / হাতুড়ি শাবল গাঁইতি চালায়ে ভাঙিল যারা পাহাড়,
পাহাড়-কাটা সে পথের দু’পাশে পড়িয়া যাদের হাড়, / তোমারে সেবিতে হইল যাহারা মজুর, মুটে ও কুলি,
তোমারে বহিতে যারা পবিত্র অঙ্গে লাগাল ধূলি; / তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাহাদেরি গান।”
লেখক- শিক্ষানবিশ আইনজীবী, ঢাকা জজ কোর্ট।
email: ghalibhit@gmail.com