কোম্পানি (সংশোধন) আইন ২০২০ : সংশ্লিষ্টরা হতাশ

মীর আব্দুল হালিম:

সম্প্রতি বাংলাদেশে প্রচলিত কোম্পানি আইন ১৯৯৪ সংশোধন করে কোম্পানি (সংশোধন) আইন ২০২০ সংসদে পাশ হয়েছে যা মহামান্য রাষ্ট্রপতির সম্মতি লাভ করার পর ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০ তারিখে সর্বসাধারণের অবগতির জন্য সাধারণ গেজেটের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে যা ওই দিন থেকেই কার্যকর হয়েছে। ইতিপূর্বে কোম্পানি আইন নতুনভাবে প্রণয়ন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল যা উক্ত সংশোধনীর মাধ্যমে আপাতত বন্ধ হয়েছে বলে মনে হয়।

উক্ত সংশোধনী আইনের ২ থেকে ১৫ ধারা অনুসারে মোট ১৪ টি ধারাতে পরিবর্তন এসেছে। এই ১৪টি সংশোধনী বিশ্লেষণ করলে মূলত দুইটি বিষয় পাওয়া যায় ।

প্রথমত: প্রথমটি হচ্ছে কোম্পানি আইনে সাধারণ সীল মোহর/কমন সিল/অফিসিয়াল সিল ব্যবহার করার যে বাধ্যবাধকতা ছিল তা বিলোপ করা হয়েছে। এ বিষয়ে ২, ২৪, ৩১, ৪৬, ৭৮, ৭৯, ৮৫, ২০৮, ২২৫, ২৬২, ৩৪৭ ও ৩৬৩ নং ধারা সমূহে সীলমোহর সংক্রান্ত কিছু অংশ পরিবর্তন করে সাধারণ সীলমোহর ব্যবহার করাকে বিলোপ সাধন করা হয়েছে।

দ্বিতীয়ত: তদ্বিতীয়টি হলো কোম্পানী লিখিতভাবে যে কোন ব্যক্তিকে সাধারণভাবে অথবা যে কোন নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভিতর বা বাহিরে যে কোন স্থানে উহার পক্ষে দলিল সম্পাদনের জন্য উহার এটর্নী হিসাবে ক্ষমতা প্রদান করতে পারবে এবং কোম্পানির পক্ষে কোন অ্যাটর্নি দলিলে স্বাক্ষর করলে গ্রহণযোগ্য হবে। এ বিষয়ে ১২৮ ও ১২৯ নং ধারা সমূহকে প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে।

নতুন ধারা ১২৮ এ দলিল সম্পাদনের বিষয়ে বলা হয়েছে যে কোম্পানি লিখিতভাবে যে কোন ব্যক্তিকে সাধারণভাবে অথবা যে কোন নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভিতরে বা বাহিরে যেকোনো স্থানে উহার পক্ষে দলিল সম্পাদনের জন্য উহার এটর্নি হিসেবে ক্ষমতা প্রদান করিতে পারিবে এবং কোম্পানির পক্ষে উক্ত অ্যাটর্নি কোন দলিলে স্বাক্ষর করলে দলিলটি কার্যকর হইবে এবং কোম্পানির উপর উহা বাধ্যকর হইবে।

নতুনধারা ১২৯ এ কোন কোম্পানি কর্তৃক বাংলাদেশের বাহিরের কোন স্থানে কোন ব্যক্তিকে ক্ষমতা অর্পণ করার বিষয়ে বলা হয়েছে যেকোন কোম্পানির উদ্দেশ্যাবলী অনুসারে উহার কোন কার্য বাংলাদেশের বাহিরে সম্পাদনের প্রয়োজন হইলে এবং উহার সংবিধি দ্বারা কোম্পানি ক্ষমতাপ্রাপ্ত হইলে বাংলাদেশের বাহিরের কোন ভূখণ্ডে, এলাকায়বাস্থানে কোম্পানি লিখিত ভাবে যেকোন ব্যক্তিকে ক্ষমতা অর্পণ করিতে পারিবে এবং তিনি কোম্পানির প্রতিনিধি বলিয়া গণ্য হইবেন। এ উদ্দেশ্যে প্রতিনিধিকে ক্ষমতা প্রদান সম্পর্কিত দলিলে কোন সময় উল্লেখ থাকলে, সেই সময় পর্যন্ত অথবা উক্ত দলিল কোন সময়ের উল্লেখ না থাকলে, প্রতিনিধির সাথে লেনদেনকারী ব্যক্তিকে প্রতিনিধির ক্ষমতা প্রত্যাহার বা অবসানের নোটিশ না দেওয়া পর্যন্ত প্রতিনিধির ক্ষমতা বহাল থাকিবে। উক্ত প্রতিনিধি প্রয়োজনীয় দলিল দস্তাবেজে তাহার স্বাক্ষর সহ লিখিত ভাবে তারিখ উল্লেখ করিবেন এবং যে ভূখণ্ডে, এলাকাবাস্থানে স্বাক্ষর করা হইল সেই ভূখণ্ড, এলাকাবাস্থানের নাম উল্লেখ করবেন।

উক্ত সংশোধনীতে বিভিন্ন দেশে প্রচলিত বিধান, স্থানীয় বাস্তবতার সঙ্গে সংগতি, উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন, হয়রানি লাঘব, শেয়ারবাজারের আইনের সঙ্গে সংঘাত এড়ানো, কোম্পানির বার্ষিক সাধারণ সভায় (এজিএম) নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির অবসান, রিটার্ন দাখিল সহজতর করা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় গুলি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। যা দেশি কিংবা বিদেশী ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারের ক্ষেত্রে খুব সহায়ক হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন না। আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনায় ছিল। যেমন,

এই সংশোধনী কোম্পানি আইন এর সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকেই কিছুটা হতাশ করেছে, বিগত কয়েক বছরে কোম্পানি আইন সংশোধন হবে বলে নানা রকম সেমিনার-সিম্পোজিয়াম আলোচনায় লেখালেখিতে কোম্পানি আইনের বিভিন্ন জটিলতা গুলো উপস্থাপন করা হয়েছে এবং আশা করা হয়েছিল এই জটিলতা গুলো আসন্ন সংশোধনীর মাধ্যমে দূরীভূত হবে। কিন্তু সেই জটিল বিষয়গুলিকে অপেক্ষা করিয়া অত্যন্ত সীমিত ভাবে সাধারণ দুটি বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যা প্রকৃত পক্ষে কোম্পানি আইনে সৃষ্ট জটিলতা নিরসনে খুব বেশি সহায়ক নয়।

একটি বিষয় ছিল এক ব্যক্তির মালিকানায় কোম্পানি গঠনের সুযোগ থাকার কথা। বর্তমান আইনে একটি কোম্পানী গঠন করতে হলে সর্বনিম্ন ২ জন শেয়ারহোল্ডার এর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে যা পরিবর্তন করে একজন শেয়ার হোল্ডার এর মাধ্যমে কোম্পানি গঠন করার একটি প্রস্তাবনা ছিল। বিশেষজ্ঞদের মতে বাংলাদেশের অসংখ্য প্রোপাইটরশিপ ব্যবসাকে আয় করের আওতায় আনতে হলে একক ব্যক্তি কোম্পানি গঠন করার ব্যবস্থা অত্যন্ত সহায়ক।

অন্য একটি বিষয় ছিল কোম্পানি সংঘবিধি ও সংঘ স্মারক এ কোন ধরনের পরিবর্তন প্রয়োজন হলে তা মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের আদেশের প্রয়োজন হয়। এই প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল, সময় ও ব্যয় সাপেক্ষ যা কোম্পানি আইনের নিয়ন্ত্রক সংস্থা নিজেই এ ধরনের সাধারণ কাজের অনুমতি দিতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত এবং ইহা আদালতের মূল্যবান সময় বাঁচাবে বলেও সংশ্লিষ্ট সবাই মনে করে।

অন্য বিষয় ছিল কোম্পানির নিয়ন্ত্রক সংস্থা যৌথ মূলধন কোম্পানি ফার্মগুলোর পরিদপ্তর (আরজেএসসি)” ডিজিটাল ফাইলিং ব্যবস্থা চালু করেছে যা কোম্পানি আইনে স্বীকৃতি দেয়া প্রয়োজন এর অবর্তমানে পদ্ধতিগত ব্যবস্থায় কোম্পানি আইনের সঠিক চর্চা হয়না বলে অনেকে মনে করেন।

শেয়ার হস্তান্তরের ক্ষেত্রে দাতা এবং গ্রহীতার উপস্থিতির বাধ্যবাধকতা শেয়ার হস্তান্তর প্রক্রিয়াকে অত্যন্ত জটিল করেছে। বিশেষ করে বিদেশি শেয়ার হোল্ডারদের ক্ষেত্রে। ‌আলোচনা ছিল এ ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসবে এবং সহজীকরণ করা হবে কিন্তু উক্ত সংশোধনে এ রকম বিষয়ে কোন কিছু বলা হয়নি। আলোচনা ছিল কোম্পানিতে কর্পোরেট গভর্নেন্স চালুর বিষয়ে/ পরিপালন বিষয়ে নানা রকম যুগোপযোগী পদক্ষেপ নেয়া হবে কিন্তু তার কিছুই সংশোধনীতে দেখা যায় নি।

এ সংশোধনীর ফলে বাংলাদেশ বিশ্ব ব্যাংক প্রকাশিত “Ease of Doing Business” এর রেংকিং ইনডেক্সে ৭ থেকে ৮ ধাপ উন্নতি করবে বলে মন্ত্রণালয় সূত্রে প্রকাশ। দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহের মধ্যে আমাদের পেছনে একমাত্র আফগানিস্তান আছে। ভারত ৬৩, শ্রীলংকা ৯৯, পাকিস্তান ১০৮, বাংলাদেশ ১৬৮ নং অবস্থানে রয়েছে।

আমি মনে করি কোম্পানি আইন সম্পর্কে পরিবর্তনের জন্য দেশীবিদেশী বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে একটি দীর্ঘ সময় গবেষণা করা উচিত যার মাধ্যমে কোম্পানি আইনে প্রচলিত নীতি সমূহ এবং প্র্যাকটিস গুলি বাংলাদেশের উপযোগী করে বাস্তবায়ন করার পদক্ষেপ নেয়া জরুরী। স্থান কাল পাত্র ভেদে আইনের নীতিসমূহ যে সমান ভাবে কাজ করে না এই বিষয়গুলি নীতিনির্ধারকদের মাথায় থাকা উচিত। বাংলাদেশের সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক অবস্থান এবং আইন মেনে চলার অভ্যাস গুলি আইন প্রয়োগের আগে ভাবি না বলেই আমাদের আইনগুলি হয়তো ততটা কার্যকর হয় না। ভোগান্তি বাড়ে, সময় এবং অর্থের অপচয় হয়, জটিলতায় ব্যবসাবাণিজ্যের প্রসার হয় না, অর্থনৈতিক মুক্তি সে তো বহুদূর।

বিশেষ দ্রষ্টব্য: উপরোক্ত বক্তব্য একটি আইনী বিশ্লেষন শিক্ষামূলক লেখক এর ব্যক্তিগত অভিমত।

 লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।

ইমেইল: bnm.mir@gmail.com