বিচার বিভাগের পৃথকীকরণের ইতিহাস, স্বাধীনতা ও বাস্তবতা
মো. তাওহিদ হোসেন

সরকারি আইনি সেবা ন্যায় বিচার ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় কার্যকর ভূমিকা পালন করবে

এম. তাওহিদ হোসেন: “Ignorantia juris non excusat” ল্যাটিন এ ম্যাক্সিমটির ইংরেজি অর্থ করলে দাঁড়ায় Ignorance of the law is no excuse অর্থাৎ আইনের অজ্ঞতা কোন অজুহাত নয় অথবা সহজ করে বিশ্লেষণ করলে বলা যায় আইন না জানা কোন অজুহাত হতে পারে না। অধিকাংশ নাগরিক দেশের প্রচলিত আইন, নিজের আইনগত অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না৷ প্রশ্ন হচ্ছে যতজন দেশের প্রচলিত আইন, নিজের আইনগত অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ততোজন কী আইনের আশ্রয় লাভের সুযোগ পাচ্ছে? যথাযথ আইনী সেবা পাচ্ছে?

বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশে প্রতিনিয়ত নানাবিধ অপরাধ হচ্ছে, সামাজিক বিভিন্ন সমস্যা হচ্ছে যেগুলো সমাধানের জন্য একটি দেশের অন্যতম অর্গান তথা অঙ্গ বিচার বিভাগের দ্বারস্থ হতে হয় অথচ বিচার বিভাগের দ্বারস্থ হতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। ফলে আইন সম্পর্কে জেনে বা নিজের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে জেনেও কাজ হয় না।

বাংলাদেশের মতো দারিদ্র্যপীড়িত একটি দেশে ২০২৩ সালের বিবিএসের প্রকাশিত তথ্যমতে ১৮.৭% মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করে। দেশের এ ১৮.৭% মানুষের মধ্যে কাউকে না কাউকে অবশ্যই বিভিন্ন কারণে আইনী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয় আর যার জন্য লাগে অর্থ ও সঠিক পরামর্শ।

দেশের সংবিধানের ৩১ নং অনুচ্ছেদে স্পষ্ট করে বলে দেওয়া আছে দেশের প্রত্যেক নাগরিকের আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার আছে। সংবিধান প্রণয়নের ২৮ বছর পরে হলেও সংবিধানের ৩১ নং অনুচ্ছেদের যথাযথভাবে কার্যকরকীরণে আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০ সালে প্রণয়ন করা হয়।

আইনগত সহায়তা প্রদানের সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করলে পাই আর্থিকভাবে অসচ্ছল, সহায় সম্বলহীন এবং নানাবিধ আর্থসামাজিক কারণে বিচার প্রাপ্তিতে অসমর্থ এমন বিচারপ্রার্থীকে আইনগত সহায়তা প্রদানকে লিগ্যাল এইড বা আইনগত সহায়তা প্রদান বলে।

আইনগত সহায়তা প্রদানের ইতিহাস

আইন বিজ্ঞানী Mauro Cappelleti সর্বপ্রথম আইনগত সহায়তার ধারণা দেন। ১৯৪৫ সালে Statute of Henry ll গরিবদের জন্য মামলার ফি মওকুফ করেন পরবর্তীতে Legal Services Bureaux এর মাধ্যমে ১৯৪২ সালে অস্ট্রেলিয়ায় আইনগত সহায়তা কিছুটা চালু হয়। ১৯৪৯ সালে ইংল্যান্ডে আইনগত সহায়তা পদ্ধতি চালুর মাধ্যমে এটি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।

আইনগত সহায়তা প্রদানের বিধিমালা সম্পর্কে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক দলিল ও রাষ্ট্রীয় আইনে বলা আছে।আইনগত সহায়তা প্রদান সম্পর্কে-

১। ১২১৫ সালের ম্যাগনাকার্টার ৪০ অনুচ্ছেদ

২। Vienna Declaration and Programme of Action এর দফা ২৭

৩। Universal Declaration of Human Rights(UDHR) এর অনুচ্ছেদ ৭,১০

৪। ফৌজদারি কার্যবিধির, ১৮৯৮ এর ধারা ৩৪০

৫। দেওয়ানী কার্যবিধি, ১৯০৮ এর ধারা ৮৯(ক)

৬। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৭,৩১,৩৩,৩৫(৩)

৭। আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০ এ উল্লেখ আছে।

যারা আইনগত সহায়তা পাবেন

১। আর্থিকভাবে অসচ্ছল ব্যক্তি যার বার্ষিক গড় আয় সুপ্রীম কোর্টে আইনগত সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে ১,৫০,০০০ টাকা। অন্যান্য আদালতের (অধস্তন আদালতের ক্ষেত্রে ১,০০,০০০ টাকার বেশি নয়।

২। কর্মে অক্ষম, আংশিক কর্মহীন,কর্মহীন কোন ব্যক্তি।

৩। বছরে ১,৫০,০০০ টাকা আয় করতে অক্ষম কোন মুক্তিযোদ্ধা বা কোন শ্রমিক যার বছরে আয় ১,০০,০০০ টাকার বেশি নয়।

৪। বয়স্ক ভাতা পাচ্ছেন এমন ব্যক্তি

৫। ভিজিডি কার্ডধারী দুঃস্থ মহিলা

৬। পাচারের শিকার নারী বা শিশু

৭। এসিডদগ্ধ নারী বা শিশু

৮। আদর্শ গ্রামে গৃহ বা ভূমি বরাদ্দপ্রাপ্ত যেকোনো ব্যক্তি

৯। অসচ্ছল বিধবা এবং স্বামী পরিত্যক্তা দরিদ্র নারী

১০। শারীরিক বা মানসিক সমস্যার কারণে উপার্জনে অক্ষম ব্যক্তি এবং সহায় সম্বলহীন প্রতিবন্ধী

১০। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে আদালতে অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে অসমর্থ ব্যক্তি

১১। বিনা বিচারে আটক এমন ব্যক্তি যিনি আত্মপক্ষ সমর্থনে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে আর্থিকভাবে অসচ্ছল

১২। আদালত কর্তৃক বিবেচিত আর্থিকভাবে অসহায় কিংবা দরিদ্র কোনো ব্যক্তি

১৩। জেল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বিবেচিত আর্থিকভাবে অসহায় কিংবা দরিদ্র কোনো ব্যক্তি

১৪। আর্থিকভাবে অসচ্ছল, সহায় সম্বলহীন, নানাবিধ আর্থ-সামাজিক এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে ক্ষতিগ্রস্থ কোনো ব্যক্তি যিনি আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে স্বীয় অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য মামলা পরিচালনা করতে অসমর্থ।

যেভাবে আইনগত সহায়তা পাবেন

আইনগত সহায়তা সংস্থার হতে আইনগত সহায়তা গ্রহণকারীকে তার নাম, পূর্ণ ঠিকানা এবং আইনগত সহায়তার কারণ উল্লেখ করে সংস্থা কর্তৃক নির্ধারিত ফর্মে আবেদন করতে হবে। আপীল বিভাগ বা হাইকোর্ট বিভাগে বিচারের বিষয় হলে সুপ্রিম কোর্ট কমিটির চেয়ারম্যান এর নিকট আবেদন করতে হবে। অধস্তন আদালতে বিচারের বিষয় হলে জেলা কমিটির চেয়ারম্যানের নিকট আবেদন করতে হবে।

আবেদন প্রাপ্তির পর কমিটি একটি ক্রমিক নাম্বার প্রদান করে নির্দিষ্ট রেজিস্ট্রারে আবেদনপত্রের লিপিবদ্ধ করবে। এরপর সহায়তা গ্রহীতাকে একটি প্রাপ্তি রশিদ প্রদান করবে। আবেদনপত্রটির উপর সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য কমিটির অব্যবহিত পরবর্তী সভায় উপস্থাপনের ব্যবস্থা করবে।আবেদনপত্রে উল্লেখিত তথ্যের ভিত্তিতে যদি সংস্থা বা জেলা কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব না হয় তবে আবেদনকারীকে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অতিরিক্ত তথ্য সরবরাহের জন্য পরামর্শ দিবেন।

এরপর সংস্থা বা জেলা কমিটির সভায় আবেদনপত্রটির আলোকে আইনগত সহায়তা প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে তা সংস্থা বা জেলা কমিটি কর্তৃক আবেদনকারীকে জানানো হবে। যদি কোনো আবেদনকারীর আবেদন জেলা কমিটি কর্তৃক নাকচ হয় তাহলে সেটা মঞ্জুরির জন্য ও আবেদনকারী তার আবেদন নাকচ হওয়ার তারিখ হতে ৬০ দিনের মধ্যে সংস্থার কাছে আপিল পেশ করতে পারবে এবং এ ব্যাপারে সংস্থার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।

সারা বাংলাদেশে ৬৪ জেলায় জেলা লিগ্যাল এইড অফিস, সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড অফিস, ঢাকা ও চট্টগ্রামে অবস্থিত শ্রমিক আইন সহায়তা সেল, জাতীয় হেল্প লাইন কলসেন্টার(১৬৪৩০) এছাড়া অনলাইনে www.judiciary.org.bd ওয়েবসাইটেও আবেদন ফর্ম পাওয়া যাবে।

শেষ কথা

আইনগত সহায়তা প্রদান শুধু বিচারপ্রার্থীকে সহায়তা করে না পুরো বিচার ব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়নে সহায়তা করে। কেননা Principle of Natural Justice এ একটি কথা আছে “Audi Alteram Partem” ল্যাটিন এ ম্যাক্সিমটির ইংরেজি অর্থ “let the other party be heard” বা No man shall be condemned unheard অর্থাৎ কাউকে না শুনে অভিযুক্ত করা যাবে না।

বাংলাদেশে অর্থের অভাবে আইনজীবী নিয়োগ না করে কেউ বিনা দোষে বা বিনা শুনানিতে সাজা পাক সেটি কাম্য হতে পারে না। তাই আইনগত সহায়তা প্রদান শুধু ২৮ এপ্রিল দিবস কেন্দ্রীক না রেখে দেশের নাগরিকদের মধ্যে বছরব্যাপী এ বিষয়ে জানাতে হবে, প্রচার করতে হবে, সেবা প্রার্থীদের সহায়তা করতে হবে তবেই বৈষম্যহীন ও সত্যিকারের সোনার বাংলাদেশ গড়া সম্ভব হবে।

লেখক: একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী।