মোকাররামুছ সাকলান:
দেশে মোবাইল কোর্ট আইন করা হয় ২০০৯ সালে। গেজেট ও প্রকাশ করা হয় ‘মোবাইল কোর্ট আইন, ২০০৯’ এই হিসাবে। ‘মোবাইল’ শব্দটা ইংরেজী হলেও তা আমাদের বাংলা আইনে অবস্থান করে নেয়। এই ইংরেজী শব্দটা আমাদের বাংলা আইনে কিভাবে ঢুকে গেল তা আমার বোধগম্য না। আমাদের এই আইনের নামটা থেকেই বোঝা এই আইনের ভিতর অনেক কিছুই নতুনভাবে আমদানী করা করা হয়েছে। আমার মতে এই আইনের গেজেটের নামটা হতে পারত ভ্রাম্যমান আদালত আইন, ২০০৯।
ধারা ১(১) এ লিখা যেতে পারত ‘এই আইন ভ্রাম্যমান আদালত আইন, ২০০৯ নামে অভিহিত হইবে।’ কিন্তু কেন এই নাম শব্দটা ‘ভ্রাম্যমান’ না হয়ে ‘মোবাইল’ হল? যারা আইন তৈরীর কাজে ছিলেন তারাই ভাল বলতে পারবেন। তবে আমার কাছে মনে হয় ভ্রাম্যমান শব্দ ব্যবহার করলে কোর্ট শব্দটা ব্যাবহার করা যেত না। আর কোর্টের বাংলা প্রতিশব্দ হল আদালত। ব্রিটিশ আমল থকেই আমদের দেশে কোর্ট শব্দটা ব্যবহার করা হচ্ছে। জন মানুষের কাছে এই কোর্ট শব্দটা অধিক মান্য বা ভীতিকর মনে হয়। সেক্ষেত্রে কোর্ট শব্দটা ব্যবহার করার জন্যই কি ভ্রাম্যমান আদালত শব্দ বাদ দেওয়া হয়েছে তা আমার বোধগম্য না। এছাড়া এমন ও হতে পারে ব্রিটিশ আমল হতে শুরু হওয়া নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের বিচারিক কর্তৃত্ব পুনরায় ফিরিয়ে নেওয়া বা পুনঃপ্রষ্ঠিত করার জন্য বাংলায় উপযুক্ত শব্দ বাদ দিয়ে আইনের নামকরনের ইংরেজী শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে। হয়ত ব্রিটিশ আমলাতান্রিক মনোভাবকে জিইয়ে রেখে দেশের মানুষকে স্বাধীন বিচার বিভাগের প্রকৃত সুবিধা থেকে বঞ্চিত করার কোন উদ্দেশ্যে ইংরেজী শব্দ ‘মোবাইল’ ব্যবহার করা। এছাড়া এটাও ঠিক যে বাংলাদেশে মোবাইল কোম্পানী গুলোর কারনে ‘মোবাইল’ শব্দটির ব্যাপক জনপ্রিয়তা আছে। কাজেই সেই জনপ্রিয়তা থেকে কিছু জনপ্রিয়তা ধার করে নিয়ে আর বাংলাদেশের মানুষকে ইংরেজী শব্দ দিয়ে একটা আইন বানায় দিলেও কেউ কিচ্ছু মনে করবে না। বরং ইংরেজী শব্দ ব্যবহার করার কারনে অশিক্ষিত বা অল্প শিক্ষিত মানুষজন একটু ভয় বেশিই পাবে বলে মনে হয়।
আইনে French একটি শব্দ আছে তাহল ‘de hors’ অর্থাৎ বহির্ভুত বা বাইরে। আইনে যখন কোন কিছু আইনগত বিধানের বাইরে গিয়ে কোন কাজ করে তবে তাকে ‘de hors’ অর্থাৎ আইন বহির্ভুত বলা হয়। বাংলা সঠিক প্রতিশব্দ ‘ভ্রাম্যমান’ থাকা সত্বেও মোবাইল শব্দটা ব্যবহার করা আমার কাছে ‘de hors’ বলেই মনে হয়।
এবার আলোচনার বিষয়ে আসি। বিগত ২৩ এপ্রিল ২০২০ সালে সুপ্রীম কোর্ট ২০৩ নম্বর বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলে “..০৫ মে তারিখ পর্যন্ত বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের উভয় বিভাগ ও সকল অধঃস্তন আদালত সমুহে সাধারন ছুটি ঘোষনা করা হল।” এখন তাহলে প্রশ্ন আসে দেশে ‘অধঃস্তন আদালত’ বলতে কি বুঝি? মোবাইল কোর্ট কি অধঃস্তন আদালত? নাকি উচ্চতর কোন আদালত? নাকি বিশেষ কোন আদালত?
আমাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫২ তে আছে আদালত” অর্থ সুপ্রীমকোর্টসহ যে কোন আদালত। ১৫২ অনুচ্ছেদের ইংরেজী পাঠে বলা আছে “court” means any court of law including Supreme Court। আবার সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১৪ তে বলা আছে ‘আইনের দ্বারা যেরূপ প্রতিষ্ঠিত হইবে, সুপ্রীম কোর্ট ব্যতীত সেইরূপ অন্যান্য অধস্তন আদালত থাকিবে।‘’ আবার অনুচ্ছেদে ১১৪ এর ইংরেজী পাঠে বলা আছে “There shall be in addition to the Supreme Court such courts subordinate thereto as may be established by law”।
আবার ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ধারা ৬ এ বলা আছে “Besides the Supreme Court and the Courts constituted under any law for the time being in force, other than this Code, there shall be two classes of Criminal Courts in Bangladesh, namely:-
(a) Courts of Sessions ; and (b) Courts of Magistrates.
(2) There shall be two classes of Magistrate, namely: – (a) Judicial Magistrate; and (b) Executive Magistrate.
আর মোবাইল কোর্ট আইন, ২০০৯ এর ২(১০) ধারায় বলা আছে “মোবাইল কোর্ট” অর্থ ধারা ৪ এ উল্লিখিত মোবাইল কোর্ট। আর এই আইনের ৪ ধারায় বলা আছে “আইন শৃঙ্খলা রক্ষা এবং অপরাধ প্রতিরোধ কার্যক্রমকে দক্ষতার সহিত সম্পাদন করিবার স্বার্থে আবশ্যক ক্ষেত্রে কতিপয় অপরাধ তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলে আমলে গ্রহণ করিয়া দণ্ড আরোপের সীমিত ক্ষমতা প্রয়োগের উদ্দেশ্যে সমগ্র দেশে কিংবা যে কোন জেলা বা মেট্রোপলিটন এলাকায় ভ্রাম্যমান কার্যক্রম পরিচালিত হইবে যাহা “মোবাইল কোর্ট” নামে অভিহিত হইবে”।
আবার মোবাইল কোর্ট আইনের ৫ ধারায় বলা হচ্ছে “সরকার… যে কোন এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটকে, এবং ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট তাহার আঞ্চলিক অধিক্ষেত্রে যে কোন এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটকে, আইন শৃঙ্খলা রক্ষা এবং অপরাধ প্রতিরোধ কার্যক্রম সম্পাদনের উদ্দেশ্যে লিখিত আদেশ দ্বারা মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করিবার ক্ষমতা অর্পণ করিতে পারিবে।”
অর্থাৎ সংবিধানের ১১৪ অনুচ্ছেদের কর্তৃত্ব বলে ২০০৯ সালে মোবাইল কোর্ট আইন প্রনয়ন করা হয়। এই আইনের মাধ্যমে অপরাধ তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলে আমলে গ্রহণ করে দন্ড আরোপ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়। এই দন্ড আরোপের কাজটা সম্পুর্ন রুপেই এক ধরনের বিচারিক কাজ বা ‘Judicial Activities’.
আমাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৫(৩) এ বলা হচ্ছে “ফৌজদারী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তি আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালত বা ট্রাইব্যুনালে দ্রুত ও প্রকাশ্য বিচারলাভের অধিকারী হইবেন।
তাহলে দণ্ড আরোপ করতে হলে আপনাকে আদালত বা Court বা Tribunal ব্যতিত অন্য কোন ফোরামে দন্ড আরোপ করার কোন অধিকার সংবিধান দেয় নাই। অর্থাৎ মোবাইল কোর্ট বাংলাদেশে আইনের অধীনে তৈরী করা একটি ‘অধঃস্তন আদালত’ যা সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৫(৩) দন্ড আরোপ করতে পারে।
এই মোবাইল কোর্ট সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১০৮ অনুযায়ী একটি অধঃস্তন আদালত হিসাবে হাইকোর্টের সরাসরি তত্ত্বাবধানে থাকবে এবং হাইকোর্ট যেকোন সময়ে একটি অধঃস্তন আদালত হিসাবে মোবাইল কোর্ট কে নিয়ন্ত্রন করতে পারবে। অতঃএব এই ধারনা পরিস্কার যে মোবাইল কোর্ট বাংলাদেশের সংবিধানের অধীনে প্রতিষ্ঠিত একটি সাধারন অধঃস্তন আদালত। সুনির্দিস্ট কিছু আইনের অপরাধের তাৎক্ষনিক বিচার করার জন্য এই আদালত সংক্ষিপ্ত পদ্ধতিতে বিচার করেন।
একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে মোবাইল কোর্ট আইনের ৪ ধারায় ‘ভ্রাম্যমান কার্যক্রম” শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। আইনের নামে ভ্রাম্যমান শব্দ ব্যবহার করা না হলেও এখানে ব্যবহার করা হয়েছে যাতে মোবাইল কোর্ট কোন স্থায়ী অফিস ছাড়াই যেকোন জায়গায় গিয়ে আদালতের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন। চাইলে রাস্তার উপর Footpath এও এর কার্যমক্রম পরিচালনা করতে পারেন।
উপরে উল্লিখিত সংজ্ঞাগুলো থেকে এই বিষয়টা পরিস্কার যে মোবাইল কোর্ট সংবিধানের আলোকে সুপ্রিম কোর্টের অধীনে একটি অধঃস্তন আদালত। সে হিসাবে সুপ্রীম কোর্টের যাবতীয় নির্দেশাবলী পালন করা মোবাইল কোর্টের উপর বাধ্যকর।
ইতিমধ্যে কামরুজ্জামান খান বনাম বাংলাদেশ [২৩ বি এল সি হাইকোর্ট ৫০২] মামলায় মোবাইল কোর্ট আইনের ৫, ৬(১), ৬(২), ৬(৪), ৭, ৮(১), ৯, ১০, ১১, ১৩ ও ১৫ ধারা সমুহকে অবৈধ ঘোষনা করেছে। এই রায়ের বিরুদ্ধে বর্তমানে আপীল বিভাগে আপীল চলমান আছে বিধায় রায়ের কার্যকারিতার উপর স্থগিতাদেশ আছে। অর্থাৎ মোবাইল কোর্টের যে ধারাগুলকে অসাংবিধানিক ঘোষনা করা হয় স্থগিতাদেশের কারনে স্বাবাভিক অবস্থায় মোবাইল কোর্টে চলতে পারে।
কিন্তু দেশের সমস্ত অধঃস্তন আদালতের কার্যক্রমে এই মুহুর্তে সুপ্রীম কোর্টের বিজ্ঞপ্তি নং ২০৩ তারিখ ২৩/০৪/২০২০ এ ঘোষিত সাধারন ছুটি ঘোষনা করেছেন অতএব ছুটি থাকার কারনে মোবাইল কোর্ট আইন ২০০৯ ব্যবহার করে অধঃস্তন আদালত হিসাবে যেকোন ধরনের সাজা দেওয়া ক্ষমতার অপব্যাবহার ছাড়া আর কিছুই নয়।
বরিশালে বিজ্ঞ আইনজীবী মোঃ রবিউল ইসলাম রিপন সহ সুপ্রীম কোর্টের সুনির্দিস্ট নির্দেশ ছাড়া যেকোন ধরনের ছুটির সময়ে যেকোন ধরনের মোবাইল কোর্টের পরিচালনা করা অপরাধ। যারা এ ধরনের কাজ করেছেন তারা শৃংখলা ভঙ্গের কাজ করেছেন। তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহন করা উচিত বলে আমি মনে করি।
কিন্তু এরপরও সবার মনে প্রশ্ন চলে আসে যে অধঃস্তন আদালতের ছুটি থাকার সময়েও এতদিন ধরে বিভিন্ন ভাবে মোবাইল কোর্ট চলেছে। হ্যাঁ চলেছে কিন্তু তা সংবিধান সম্মতভাবে চলতে পারে না। সুপ্রীম কোর্টের সুনির্দিস্ট কোন নির্দেশনা ছাড়া মোবাইল কোর্ট চলতে পারে না এটাই সংবিধানে বলা আছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১৬ তে বলা আছে “বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচারবিভাগীয় দায়িত্বপালনে রত ম্যাজিষ্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল- নির্ধারণ, পদোন্নতিদান ও ছুটি মঞ্জুরীসহ) ও শৃংখলাবিধান রাষ্ট্রপতির উপর ন্যস্ত থাকিবে এবং সুপ্রীম কোর্টের সহিত পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তাহা প্রযুক্ত হইবে।
সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১৬এর বিধানটি মাসদার হোসেন মামলায় রায়ের সংবিধান (পঞ্চদশ সংশোধন) আইন, ২০১১ (২০১১ সনের ১৪ নং আইন)-এর ৩৯ ধারাবলে প্রতিস্থাপিত হয়। অর্থাৎ মাসদার হোসেন রায়ের প্রযোজ্য অংশটুকু ছিল এমন “It is declared that in exercising control and discipline of persons employer in judicial service and magistrates exercising judicial functions under Article 116 the views and opinion of the Supreme Court shall have the primacy over those of the Executive”. [52 DLR (AD) 82]. (বোল্ড ও আন্ডারলাইন লিখকের)
মোবাইল কোর্টের আইনটা ২০০৯ সালে অর্থাৎ মাসদার হোসেন মামলার আগে কিংবা সংবিধান (পঞ্চদশ সংশোধন) আইন, ২০১১ এর আগে সংসদ কর্তৃক পাশ হয়েছে। আগে পাস হলেও মাসদার হোসেন মামলার রায় অনুসরনে আইনসভা কর্তৃক সংবিধান (পঞ্চদশ সংশোধন) আইন, ২০১১ মোবাইল কোর্টের নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেটদের বিচারিক ক্ষমতা ত্বত্তাবধানের দায়িত্ব সুপ্রীম কোর্টের উপর ন্যস্ত করেছেন।
মোবাইল কোর্টের নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেটরা রাস্ট্রপতি দ্বারা নিয়োজিত হন। তাদের কর্মের শর্ত নির্ধারিত হয় সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৩৩ অনুবলে। নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেবরা মোবাইল কোর্ট ছাড়া আরও অন্য কাজ সম্পাদন করে থাকেন। কিন্তু যেহেতু তারা মোবাইল কোর্ট আইনের মাধ্যমে বিচার কাজ বা Judicial Function করছেন তাই শুধু বিচারিক কার্যক্রম করার সময়টা তে তাদের সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশাবলি মেনে চলা তাদের জন্য বাধ্যতামূলক। মোবাইল কোর্ট আইনের ৫ ধারা বলে সরকার নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেটদের কে বিচারিক কাজে পদায়ন করতে পারেন মাত্র। কিন্তু বিচার কার্যের সার্বিক নিয়ম কানুন বিধিবিধান বা পদ্ধতি সমুহ সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশাবলী ও আইনের বিধানাবলী অনুসরন করেই নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেটকে বিচারকার্যক্রম করতে হবে।
ইচ্ছে করলেই মোবাইল কোর্ট নির্বাহী বিভাগের ম্যজিস্ট্রেট দিয়ে পরিচালনা করা সংবিধান সম্মত নয়। অতএব অধঃস্তন আদলতের সাধারন ছুটিতে মোবাইল কোর্ট সংবিধান সম্মতভাবে চলতে পারে না। যদি তা পরিচালিত হয় তবে তা হবে ‘de hors’ বা কর্তৃত্ব বহির্ভুত।
[২৩ বি এল সি হাইকোর্ট ৫০২] মামলার রায়ের বিরুদ্ধে আপীল বিবেচনাধীন থাকা অবস্থায় উপর্যুক্ত আইনি আলোচনা একজন আইনজীবী হিসাবে লেখকের আইনি মত মাত্র।
লেখক- এডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট।