সাঈদ আহসান খালিদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক

আইনজীবীর হাতে হাতকড়া ও মোবাইল কোর্ট

সাঈদ আহসান খালিদ: 

এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট পরিচালিত মোবাইল কোর্ট কিছুদিন পরপর একেকটা অন্যায়, অবৈধ বিচার করে, দেশজুড়ে প্রতিবাদ হয়, বাংলাদেশ নামের বিশ্ব মানচিত্রের ছোট্ট একটা দেশের ছোট্ট কোন প্রশাসনিক ইউনিটের এই সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে অনেকে যারা নিজেদের অধিক্ষেত্রে মনেমনে এখনো নিজেদের একেকজন প্রভু, সামন্তরাজা কিংবা মুঘল সম্রাট মনে করেন- তারাই আবার সুপ্রিমকোর্টে হাজির হয়ে সেসব অন্যায় বিচারের জন্য নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেন, অতঃপর আবার ‘যাহা লাউ তাহা কদু’। অবশ্য এর অন্যথা হওয়ার উপায় কি আছে? দেশে বিচার ব্যবস্থা বিদ্যমান। তারপরও নির্বাহীরা নিজেরাই বিচারক হতে চান। ফলে যা ঘটার তাই ঘটে চলছে, শুধু ঘটনার স্থান-কাল-পাত্র পরিবর্তন হয়- এই যা।

ছবিতে পুলিশ পরিবেষ্টিত হাতকড়ায় আবদ্ধ একজন আইনজীবী। বরিশালে রাস্তায় টিসিবির পণ্য বিক্রয়ের অনিয়মের প্রতিবাদ করায় ঘটনাস্থলে এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট ডেকে আনিয়ে, মোবাইল কোর্ট বসিয়ে, হাতকড়া পরিয়ে, ৭ দিনের কারাদণ্ড দিয়ে তাৎক্ষণিক এই আইনজীবীকে জেলে পাঠানো হয়েছে। অভিযোগ আনা হয়েছে- তিনি ‘সরকারি কাজে বাধা’ দিয়েছেন। শাস্তি দেওয়া হয়েছে দণ্ডবিধির ১৮৬ ধারায়।

আইন যারা পড়ে, পড়ায় এবং পেশাগতভাবে আইনের চর্চা করে- অনিয়ম আর অন্যায়ের ‘প্রতিবাদ’ করার মানসিকতা তাদের মজ্জাগত। দণ্ডপ্রাপ্ত আইনজীবী টিসিবির পণ্য বিক্রয়ের ঠিক কোন অনিয়মের প্রতিবাদ করেছিলেন- তা এখনো জানি না কিন্তু যে নিয়মে মোবাইল কোর্ট বসিয়ে এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট তাঁকে জেলে পাঠালেন- সেটি স্পষ্টত আইনের গুরুতর বিচ্যুতি এবং অর্পিত ক্ষমতার অপব্যবহার। কারণ- আইনের শিক্ষার্থীরা প্রাতিষ্ঠানিক আইন শিক্ষার একেবারে প্রাথমিক স্তরেই আইনের যে রোমান ‘ম্যাক্সিম’ (আইনের নীতি)’র সাথে পরিচিত হয় তা হচ্ছে- ‘de minimis non curat lex’
[The law does not concern itself with Trifles ]

অর্থাৎ, এই নীতি অনুসারে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে আইন প্রয়োগ বা বিচার করা যাবে না। এই নীতিটি উদ্ভূত হয়েছে আইনের অনাবশ্যক প্রয়োগ রুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে। হতে পারে- ওই আইনজীবীর সাথে কোন বিষয় নিয়ে টিসিবির ওই ব্যক্তির মধ্যে তর্কাতর্কি হয়েছে, বাক-বিতণ্ডা হয়েছে। এই তুচ্ছ তর্কাতর্কির জেরে ফোন করে এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটকে ডেকে এনে আদালত বসিয়ে একজন মানুষকে হাতকড়া পরিয়ে জেলে পাঠানো ব্যক্তিস্বার্থে মোবাইল কোর্ট আইনের অপপ্রয়োগ, আইনের নীতির সাথে সাংঘর্ষিক এবং কর্তৃত্ব বহির্ভূত। এই ঘটনার মাধ্যমে নির্বাহী বিভাগের হাতে বিচারিক ক্ষমতার অপব্যবহারের চলমান সমালোচনা আরো সংহত হলো।

মোবাইল কোর্ট আইন, ২০০৯ এর ধারা- ৬ এ মোবাইল কোর্টের ক্ষমতার ব্যাপারে বলা আছে- এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক একজন অভিযুক্তকে এই আইনে শাস্তিপ্রদান করতে হলে ঘটনাটি ওই ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে সংঘটিত বা উদঘাটিত হতে হবে। অথচ খবরে জানা গেল- ঘটনাস্থলে এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট উপস্থিত ছিলেন না, তাঁর সম্মুখে এটি সংঘটিত হয়নি, ঘটনা ঘটার পরে ফোনে কল করে এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটকে ডেকে এনে আদালত বসানো হয়। এই বিচার আসলে শুধু অবিচারই নয় অনাচার হয়েছে৷

মোবাইল কোর্ট আইনের ধারা-৭ অনুযায়ী- এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট শুধু তখনই কারাদণ্ড দেয়ার ক্ষমতা রাখেন যখন অভিযুক্ত ব্যক্তি অভিযোগ লিখিতভাবে স্বীকার করেন। অভিযোগ স্বীকার না করলে এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট কাউকে দণ্ড প্রদানের ক্ষমতা রাখেন না, একই আইনের ধারা- ৭(৪) অনুসারে মোবাইল কোর্ট পরিচালনাকারী এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট সেক্ষেত্রে দণ্ড আরোপ না করে অভিযোগটি বিচারার্থে উপযুক্ত এখতিয়ার সম্পন্ন আদালতে প্রেরণ করবেন৷

 

এই উপযুক্ত আদালত কোনটি?

১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের ধারা- ১৯০(৪) অনুযায়ী এই অভিযোগের বিচার হবে নিয়মিত বিচারিক আদালতে। আলোচ্য ঘটনায় অভিযুক্ত আইনজীবী কি এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে লিখিতভাবে দোষ স্বীকার করেছিলেন? অবশ্য মোবাইল কোর্টের সম্মুখে লিখিতভাবে দোষ অস্বীকার করে কোন অভিযুক্তের খালাস পাওয়া কিংবা বিচার নিয়মিত আদালতে হস্তান্তরিত হয়েছে- এটি বেনজির। অবস্থা এমন- মোবাইল কোর্ট যারেই ধরে সেই দোষ স্বীকার করে- নিয়মিত আদালতের মতো কোন অব্যাহতি, বেকসুর খালাস নেই!

র‍্যাব-পুলিশ পরিবেষ্টিত মোবাইল কোর্টের সামনে কোন অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি লিখিত স্বীকারোক্তি দিয়েও থাকে- সেই স্বীকারোক্তির আইনি বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ এবং সংবিধান পরিপন্থী। এই ধরণের স্বীকারোক্তি সংবিধানের ৩৫(৪) অনুচ্ছেদের লংঘন যেখানে বলা হয়েছে- ‘কোনো অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করা যাবে না’।

‘Every Person is Presumed to be Innocent Until Proven Guilty.’ অর্থাৎ, সাক্ষ্য-প্রমাণ দ্বারা চূড়ান্তভাবে দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত আইনের চোখে প্রত্যেক ব্যক্তি নির্দোষ বলে গণ্য। এই ‘Presumption of Innocence’ – আইন ও বিচারের একটি একেবারে প্রাথমিক ম্যাক্সিম। সাক্ষ্যের সত্যতা যাচাইকরণ বিচার ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা মোবাইল কোর্টের তাৎক্ষণিক বিচারে সম্ভব হয় না।

‘সরকারি কাজে বাধাদান’ সংশ্লিষ্ট ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ১৮৬ ধারা একটি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ প্রভুরা দেশীয় প্রজাদের যে কোন প্রতিবাদকে ভয় পেতো এবং আইনের বাতাবরণে প্রতিবাদকে অবরুদ্ধ রাখার চেষ্টা করেছিল। দুঃখের বিষয়- ২০২০ সালেও স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিকেরা প্রভুত্বমূলক ঔপনিবেশিক আইনের প্রেতাত্মা থেকে মুক্ত হতে পারছে না। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় ‘প্রতিবাদ’, ‘জবাবদিহিতা চাওয়া’ আর ‘সরকারি কাজে বাধাদান’-কে সমার্থে গ্রহণের সুযোগ নেই।

এই মোবাইল কোর্ট মাসদার হোসেন মামলায় গৃহীত বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং ‘ক্ষমতার পৃথকীকরণ তত্ত্ব’র সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এই কোর্টে যিনি প্রসিকিউটর তিনিই বিচারক যা ন্যায়বিচার এবং Principle of Due Process of Law এর অস্বীকার। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৫(৩) অনুযায়ী ফৌজদারি অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালত বা ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক বিচার লাভের অধিকারী। কিন্তু নির্বাহী বিভাগের আজ্ঞাবহ প্রশাসনিক কর্মকর্তা দ্বারা পরিচালিত মোবাইল কোর্ট স্বাধীন বা নিরপেক্ষ কোনো আদালত বা ট্রাইব্যুনাল নয়।

সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৩(১) অনুযায়ী অভিযুক্ত ব্যক্তিকে তার মনোনীত আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ ও আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। কিন্তু মোবাইল কোর্টে অভিযুক্তদের আত্মপক্ষ সমর্থনের বা আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করার কোনো অধিকার থাকে না। র‍্যাব-পুলিশ কাউকে ধরে এনে এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটের দফতরে নিয়ে হাজির করল কিংবা ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের ফলে এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটকে ফোন করে ঘটনাস্থলে উপস্থিত করালো আর তিনি মোবাইল কোর্ট বসিয়ে কোন রকম তদন্ত, জামিন, কিংবা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে কাউকে জেলে পাঠিয়ে দিল, কাউকে কানে ধরালো, পার্কে প্রেমিক-প্রেমিকার বিয়ে পড়িয়ে দিল- এসব দৃষ্টান্ত সংবিধান, আইন ও মানবাধিকারের সুস্পষ্ট ব্যত্যয়, এটি অসভ্যতা এবং পরিত্যাজ্য।

মোবাইল কোর্ট- কনসেপ্ট হিসেবে দারুন। এর উদ্দেশ্য মহৎ। বিচারপ্রার্থী মানুষের দোরগোড়ায় বিচারকাজ নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যেই এ ধরনের আদালতের প্রচলন। এতে বিচারপ্রার্থীদের সময় ও অর্থ সাশ্রয় হয়। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালাম ভারতে প্রথম এ ধরনের কোর্ট চালুর ধারণা দেন। হরিয়ানায় ২০০৭ সালে এটি চালু হয়। ২০১৩ সালে পাকিস্তানের পেশোয়ারে দাতাদের টাকায় চালু হয় মোবাইল কোর্ট। ভারত ও পাকিস্তানে বিচার বিভাগের অধীনেই মোবাইল কোর্টের কার্যক্রম চলছে। সেটিই স্বাভাবিক এবং কাঙ্ক্ষিত। অন্যদিকে, বাংলাদেশে আমলারা সেটি দখল করে রেখেছেন।

যেহেতু মোবাইল কোর্টে তাৎক্ষণিক বিচার করা হয়, যেহেতু এখানে অভিযুক্তের আইনজীবীর পরামর্শলাভের সুযোগ নেই, সেহেতু সহকারি কমিশনার হিশেবে সদ্য সার্ভিস শুরু করা একজন নবীন পেশাজীবীকে ম্যাজিস্ট্রেসির গুরুদায়িত্ব চাপিয়ে মোবাইল কোর্ট বসিয়ে কলমের এক খোঁচায় কাউকে কারাগারে নিক্ষেপ করার পূর্বে অধিক সতর্কতা জরুরি। আইন এবং বিচারপদ্ধতি সম্বন্ধে শিক্ষাগত ও পেশাগতভাবে স্বচ্ছ- গভীর ধারণার অধিকারী দক্ষ ব্যক্তিদেরকেই মোবাইল কোর্ট পরিচালনায় সম্পৃক্ত করা উচিত। মোবাইল কোর্টের বিচারের কাজ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের হাতে ছেড়ে দেওয়াই হবে যুক্তিসঙ্গত।

‘পাথরের ডিম দিয়ে মুরগি যতোই তা দিক- সেটি পাথরই থাকে; বাচ্চা ফুটে না’- এই সত্য যত তাড়াতাড়ি হৃদয়ঙ্গম করা যাবে তত মঙ্গল।

লেখক- সহকারী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।