মনজিলা সুলতানা ঝুমা: ইভ টিজিং শব্দটা যখন আপনি শুনবেন আপনার মস্তিষ্ক অবচেতন মনে একটা গল্প তৈরী করবে। গল্পটা এমন হবে, যে কিছু মেয়ে স্কুলে যাচ্ছে আর বখাটে কিছু ছেলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দু’টো শব্দ উড়িয়ে দিচ্ছে, শিস দিচ্ছে, হাসছে বা হাততালি দিচ্ছে! এই গল্প আপনার মস্তিষ্ক কল্পনা করছে মানে হলো, এটি নতুন কিছু নয়। ইভ টিজিং আমাদের সমাজের সাধারণ নামে জঘন্য একটি অপরাধ। যা একটি মাত্র শব্দের কারনে কয়েক সেকেন্ডে মানুষের মস্তিষ্কে একটি গল্প তৈরী করে ফেলে। বাংলাদেশে এমন মেয়ে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর যে জীবনে কখনোই ইভ টিজিং এর শিকার হন নাই! এটি মূলত এক ধরনের ইউফেমিজম (Euphemism)। জনসমাবেশে, রাস্তা-ঘাটে, বাসে, জনসাধারণের সামনে নারী কেবল উত্যক্তের শিকারই হন না, বরং তারা নিগৃহীত, যৌন হয়রানি বা যৌন নিপীড়নের শিকার হন। অর্থাৎ, উত্যক্তের আড়ালে থাকে যৌন প্রবৃত্তির মোড়ক। এটিই হলো ইউফেমিজম। বখাটেদের যৌন হয়রানির আড়ালে লুকিয়ে থাকা যৌন লালসার ক্ষত সামাজিক দৃষ্টিতে কিংবা জনসাধারণের চোখে খুব স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে না। কেবল ভুক্তভোগীই বোঝেন এর অন্তর্নিহিত গোপন যাতনা। এ ধরনের উত্যক্ততা স্বাধীনভাবে ও নিরাপদে পথচলার মতো মৌলিক অধিকারের উপর সরাসরি আঘাত হানে। সুতরাং ইভ টিজিং এক প্রকার ভয়াবহ যৌন হয়রানি বা যৌন সন্ত্রাস।
ইভ টিজিং কি?
কোনো নারী বা কিশোরীকে তার স্বাভাবিক চলাফেরা বা কাজকর্ম করা অবস্থায় অশালীন মন্তব্য করা, ভয় দেখানো, চিৎকার করা, বিকৃত নামে ডাকা, কোনো কিছু ছুড়ে দেয়া, ব্যক্তিত্বে লাগে এমন মন্তব্য করা, যোগ্যতা নিয়ে টিটকারী করা, তাকে নিয়ে অহেতুক হাস্যরসের উদ্রেক করা, রাস্তায় হাঁটতে বাঁধা দেওয়া, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করা, ইঙ্গিতপূর্ণ ইশারা দেওয়া, সিগারেটের ধোঁয়া গায়ে ছাড়া, উদ্দেশ্যেমূলকভাবে পিছু নেয়া, অশ্লীলভাবে প্রেম নিবেদন করা, উদ্দেশ্যেমূলকভাবে গান, ছড়া বা কবিতা আবৃত্তি করা, চিঠি লেখা, পথ রোধ করে দাঁড়ানো, প্রেমে সাড়া না দিলে হুমকি প্রদান ইত্যাদি ইভটিজিংয়ের মধ্যে পড়ে।
ইভটিজিংয়ের শিকার হলে কি করবেন?
আইনের আশ্রয় নেবেন! কীভাবে নেবেন চলুন বিস্তারিত জেনে নেই।
কেউ ইভ টিজিংয়ের শিকার হলে বা হচ্ছে, এমন কোনো ঘটনা দেখলে, প্রথমে নিকটস্থ থানায় গিয়ে দ্রুত বিষয়টি অবগত করতে হবে। লিখিত অভিযোগও করা যেতে পারে। অবশ্য পুলিশ নিজে বাদী হয়েও মামলা করতে পারে। যদি উত্যক্তকারী পরিচিত কেউ হয়, তাহলে তার নাম–ঠিকানা দিতে হবে। অপরিচিত হলে তার চেহারার বর্ণনা দিতে হবে এবং ঘটনা ও ঘটনাস্থল সম্পর্কে সঠিক তথ্য দিতে হবে। পুলিশের স্বদিচ্ছা থাকলে উত্যক্তকারী খুঁজে আইনি ব্যবস্থা নিতে পারেন। কোন কারনে থানায় যদি অভিযোগ না নেয়, তাহলে সরাসরি আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার সুযোগ আছে। অথবা আশপাশে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হলে ভ্রাম্যমাণ আদালতকে সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি অবগত করা যেতে পারে। তাছাড়া জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ ডায়াল করলে পুলিশি সহায়তা নিতে পারেন। আপনার আশপাশের র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নে অথবা উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার, সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিসে স্বশরীরে হাজির হয়ে লিখিত বা মৌখিকভাবে অভিযোগ দাখিল করতে পারেন। জেলাপর্যায়ে বিজ্ঞ জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে অবহিত করতে পারেন। র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকেও জানাতে পারেন। তাৎক্ষণিকভাবে ভ্রাম্যমাণ আদালত যদি হাতেনাতে প্রমাণ পান, তাহলে ঘটনাস্থলেই শাস্তি আরোপ করতে পারবেন। তবে মনে রাখতে হবে, ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে নিরীহ কাউকে ফাঁসানোর চেষ্টা করলে কিন্তু ফল উল্টো হতে পারে।
প্রচলিত আইনে ইভ টিজিং এর শাস্তি
বাংলাদেশের বিভিন্ন আইনে ইভ টিজিং এর শাস্তির বিধান আছে। এক নজরে এই জঘন্য অপরাধের বিভিন্ন শাস্তি সম্পর্কে সামগ্রিক একটা চিত্র দেখে নেয়া যাক।
দন্ডবিধি, ১৮৬০-এর ৫০৯ ধারায় ইভটিজিং সম্পর্কে বলা হয়েছে- এই ধারা অনুযায়ী যদি কেউ অপরাধ করে এবং তা প্রমাণিত হয় তবে সেই ব্যক্তি এক (১) বৎসর পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদের বিনাশ্রম কারাদণ্ডে বা অর্থদণ্ডে বা উভয় দন্ডেই দণ্ডিত হতে পারেন।
একই আইনের ২৯৪ ধারা অনুযায়ী যদি কেউ এই অপরাধ করে, তাহলে সেই ব্যক্তি তিন (৩) মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড বা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডনীয় হবেন। তাছাড়া একই আইনের ৩৫৪ ধারায় বলা হয়েছে-যদি কোনো ব্যক্তি কোনো নারীর শালীনতা নষ্ট করার অভিপ্রায়ে বা শালীনতা নষ্ট হতে পারে জেনেও তাকে আক্রমণ করে বা অপরাধমূলক বলপ্রয়োগ করে তাহলে সে ব্যক্তি ২ বৎসর পর্যন্ত যে কোনো বর্ণনার কারাদণ্ডে বা জরিমানাদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অধ্যাদেশের ৭৫ ও ৭৬ ধারায় ইভটিজিং বা উত্যক্তার বিষয়ে বলা হয়েছে- ৭৫ ধারা অনুযায়ী সমাজে অশালীন বা উচ্ছৃঙ্খল আচরণের শাস্তি হিসেবে ৩ মাস মেয়াদ পর্যন্ত কারাদণ্ড বা ৫০০ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে।’ এবং ৭৬ ধারা অনুযায়ী শাস্তি ১ বৎসর পর্যন্ত মেয়াদের কারাদণ্ডে অথবা ২ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এর ১০ ধারা অনুযায়ী, যদি কোন ব্যক্তি অবৈধভাবে তার যৌন কামনা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে তার শরীরের যে কোন অঙ্গ বা কোন বস্তু দ্বারা কোন নারী বা শিশুর যৌন অঙ্গ বা অন্য কোন অঙ্গ স্পর্শ করেন বা কোন নারীর শ্লীলতাহানি করেন তা হলে তার এই কাজ হবে যৌন পীড়ন এবং এর জন্য উক্ত ব্যক্তি অনধিক দশ (১০) বছর কিন্তু অন্যুন তিন (৩) বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন৷
ইভটিজিং প্রতিরোধে করোনীয়
সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ক্লাসরুমে ইভটিজিং সম্পর্কে আলোচনা এবং নেতিবাচক বিষয় তুলে ধরতে হবে। ইভ টিজিংকে উৎসাহিত করে এ ধরণের বক্তব্য, বিজ্ঞাপন, বা নাটক প্রচার না করতে পারে, এই বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এই বিষয়ে তৎপর এবং কার্যকরী ভুমিকায় এগিয়ে আসতে হবে।
সবাইকে ইভ টিজিংয়ের স্বীকার ভিকটিমের পাশে দাঁড়াতে হবে এবং তাকে প্রতিকুলতা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করতে হবে।
লেখক- মনজিলা সুলতানা ঝুমা; আইনজীবী, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ঢাকা ও খাগড়াছড়ি।