চন্দন কান্তি নাথ :
বাংলাদেশের সব জায়গায় এখন ডিজিটাল কার্যক্রম চলছে। আদালত ও এর বাইরে নয়। আদালত কর্তৃক তথ্য- প্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ, ২০২০ জারি করা হয়ে হয়েছে। শীঘ্রই এটা আইন হিসেবে ও প্রতিষ্ঠা পাবে। বাংলাদেশের সব খানে ডিজিটাল প্রক্রিয়াতে অনেক কাজ হচ্ছিল কিন্তু আদালতে এটা গতি পাচ্ছিল না। তবে করোনার দুর্যোগে এটা চালু হয়েছে। গতি ও পেয়েছে। ইতিমধ্যেই হাজার হাজার আসামী এই প্রক্রিয়াতে জামিন ও পেয়েছে। ভার্চুয়াল উপস্থিতি নিশ্চিত করার জন্যে এবং আদালতে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্যই অধ্যাদেশ তথা আইনটি হয়েছে।
অধ্যাদেশের শিরোনামে বলা হয়, “যেহেতু মামলার বিচার (trial), বা বিচারিক অনুসন্ধান (inquiry) বা দরখাস্ত বা আপিল শুনানি বা সাক্ষ্য (evidence) গ্রহণ বা যুক্ততর্ক (argument) গ্রহণ বা আদেশ (order) বা রায় (judgment) প্রদান কালে পক্ষগণের ভার্চুয়াল উপস্থিতি নিশ্চিত করবার উদ্দেশ্যে আদালতকে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষমতা প্রদানের নিমিত্ত বিধান প্রণয়ন করা সমীচীন ও প্রয়োজনীয়……. সেহেতু…অধ্যাদেশ প্রণয়ন ও জারি করলেন” মূলত আদালতকে ভার্চুয়াল উপস্থিতি নিশ্চিত ও তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষমতা প্রদানের জন্যই এই আইন করা হয়।
সে কারণে অধ্যাদেশের ২ (২) ধারায় বলা হয়, “এই অধ্যাদেশে ব্যবহৃত যে সকল শব্দ বা অভিব্যাক্তির সংজ্ঞা এই অধ্যাদেশে প্রণয়ন করা হয় নাই, সেই সকল শব্দ বা অভিব্যক্তি ফৌজদারি কার্যবিধি বা দেওয়ানি কার্যবিধিতে যে অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে সে অর্থে ব্যবহৃত হবে সে অর্থে প্রযোজ্য হবে” আবার অধ্যাদেশের ২ ধারায় ‘আইন’ ‘আদালত’ দেওয়ানি কার্য বিধি, ফৌজদারি কার্য বিধি এবং ভার্চুয়াল উপস্থিতি ব্যতীত অন্য কোন শব্দ সংজ্ঞায়িত করা হয় নাই। ভার্চুয়াল উপস্থিতি ব্যতীত অন্য শব্দ গুলোর সংজ্ঞা আমাদের সংবিধান ও আইনে যা আছে তাই। আর ভার্চুয়াল উপস্থিতি বলতে বুঝানো হয়েছে- অডিও – ভিডিও বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক পদ্ধতির মাধ্যমে কোনো ব্যাক্তির আদালতে বিচার বিভাগীয় কার্য ধারায় উপস্থিত থাকা বা অংশগ্রহণ।
আবার অধ্যাদেশের ৩ (১) ধারায় বলা হয়েছে, “ফৌজদারি কার্যবিধি বা দেওয়ানি কার্যবিধি বা আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে ভিন্নতর যাই থাকুক না কেন, যেকোনো আদালত এই অধ্যাদেশের ধারা ৫ এর অধীন জারিকৃত প্র্যাকটিস নির্দেশনা (বিশেষ বা সাধারণ) সাপেক্ষে, অডিও-ভিডিও বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে বিচারপ্রার্থী পক্ষরা বা তাদের আইনজীবী বা সংশ্লিষ্ট অন্য ব্যক্তি বা সাক্ষীর ভার্চুয়াল উপস্থিতি নিশ্চিত করে যেকোনো মামলার বিচার বা বিচারিক অনুসন্ধান বা দরখাস্ত বা আপিল শুনানি বা সাক্ষ্যগ্রহণ বা যুক্ততর্ক গ্রহণ বা আদেশ বা রায় প্রদান করতে পারবে।”
তবে ৩ (২) পরিষ্কার করে বলা হয়েছে ৩ (১) অধীন অডিও – ভিডিও বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে বিচারপ্রার্থী পক্ষরা বা তাদের আইনজীবী বা সংশ্লিষ্ট অন্য ব্যক্তি বা সাক্ষীর ভার্চুয়াল উপস্থিতি নিশ্চিত করা ব্যতীত অন্যান্য বিষয়ের ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্য বিধি বা ক্ষেত্র মত, দেওয়ানি কার্য বিধি অনুসরণ করতে হবে। অর্থাৎ অডিও-ভিডিও বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে উপস্থিতি ব্যতীত অন্য সব ক্ষেত্রে প্রচলিত আইনই প্রযোজ্য হবে। তবে প্র্যাকটিস নির্দেশনা (বিশেষ বা সাধারণ) সাপেক্ষে, উক্ত উপস্থিতির বিষয় টি নির্ধারিত হবে।
আমাদের সংবিধানে আদালত অর্থ সুপ্রীমকোর্টসহ যে কোন আদালত। Code of Criminal Procedure, 1898 এর ৬ ধারা ও Civil Courts Act, 1887 এর ৩ ধারা ও Code of Civil Procedure, 1908 এবং অন্য আইন অনুসারে দেশের অনেক আদালত আছে যেখানে মানুষ আইনের আশ্রয় পায়। সংবিধান এর অনুচ্ছেদ ১৪১গ (১) মতে জরুরি অবস্থার সময় আদালতের কার্যক্রম শুধু মাত্র কিছুটা হ্রাস করা যায়। অন্য সময় নয়। কিন্তু কোনো জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয় নাই।
আবার ৩৫ (৩) অনুসারে ফৌজদারী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তি আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালত বা ট্রাইব্যুনালে দ্রুত ও প্রকাশ্য বিচারলাভের অধিকারী হবেন-অনুচ্ছেদ টি ও অকার্যকর নয়। অনুচ্ছেদ ৩১ অনুসারে আইনের আশ্রয়লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহারলাভ যে কোন স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষতঃ আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না, যাতে কোন ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে। ৩৩ (১) অনুচ্ছেদে আছে গ্রেপ্তারকৃত কোন ব্যক্তিকে যথাসম্ভব শীঘ্র গ্রেপ্তারের কারণ জ্ঞাপন না করে প্রহরায় আটক রাখা যাবে না এবং উক্ত ব্যক্তিকে তাঁর মনোনীত আইনজীবীর সহিত পরামর্শের ও তাঁর দ্বারা আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার হতে বঞ্চিত করা যাবে না।৭ (২) নং অনুচ্ছেদে আছে – সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোন আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসামঞ্জস্য হয়, তাহলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হবে৷ ৪৪ (১) নং অনুচ্ছেদে মৌলিক অধিকার ভাগে প্রদত্ত অধিকারসমূহ বলবৎ করবার জন্য এই সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগের নিকট মামলা রুজু করবার অধিকারের নিশ্চয়তা দান করা হয়।
মানুষের বিচার পাওয়ার অধিকার ও আইন অনুযায়ী ব্যবহার UDHR(Universal Declaration of Human Rights), ICCPR (International Covenant on Civil and Political Rights) এবং সর্বোপরি আমাদের সংবিধান মোতাবেক মৌলিক অধিকার। করোনার সময়ে ও কোনো অধিকার স্থগিত হয় নাই। আবার দেওয়ানি সংক্রান্ত বিভিন্ন আইন অনুসরণ করে দেওয়ানি বিচার কার্যক্রম সম্পন্ন হয়। তবে ফৌজদারি আদালত তদন্ত প্রক্রিয়া এর জন্যে শুক্রবার ও শনিবার ও চলে। তবে
শুক্রবার ও শনিবার এর মতই করোনার কারণে দীর্ঘদিন আদালত সহ সব কিছু বন্ধ ছিল। তখন আসামী দের কথা চিন্তা করে মাননীয় প্রধান বিচারপতি হাইকোর্ট বিভাগ এর সম্মতিক্রমে প্র্যাক্টিস নির্দেশনা জারি করে এবং অনেকে জামিন পায়। কিন্তু পরে প্রায় সব কিছু খুলে দেয়া হয়েছে। তাই বাংলাদেশের সংবিধান ও আইন অনুসারে আদালতের ও প্রায় সব কিছুই চলার কথা ছিল। কিন্তু করোনার কারণে সেটা সম্ভব ছিল না।
সেকারণে গত ৩০ শে মেতে অধ্যাদেশ এর ধারা ৫ এর ক্ষমতা বলে ২৩০ নং প্র্যাক্টিস direction এ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা নিশ্চিত করণ ও শারীরিক উপস্থিতি ব্যতিরেখে বিচার কার্য পরিচালনার লক্ষে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধান বিচারপতি হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক পূর্বের প্রদত্ত ক্ষমতা বলে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট এর ১০ ই মে ২০২০ ইং তারিখে ২১৪ নং বিজ্ঞপ্তি মূলে প্রচারিত বিশেষ প্র্যাক্টিস নির্দেশনা এর ধারাবাহিকতায় অতিরিক্ত বিশেষ প্র্যাক্টিস নির্দেশনা জারী করেন। উক্ত নির্দেশনাতে স্পষ্টভাবে আদালত কর্তৃক তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ, ২০২০ এবং ২১৪ নং বিজ্ঞপ্তি অনুসারে অতীব জরুরী বিষয় সমূহ শুনানি গ্রহণ ও প্রয়োজনীয় আদেশ প্রদান করার কথা বলা হয়েছে। ১ নং নির্দেশনা তে বলা হয় – ‘অধস্তন দেওয়ানী ও ফৌজদারি আদালত এবং ট্রাইবুনাল সমূহে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অতীব জরুরী বিষয় সমূহ আদালত কর্তৃক তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ, ২০২০ এবং বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট এর ১০ /০৫ /২০ তারিখের ২১৪ নং বিজ্ঞপ্তি মূলে প্রচারিত বিশেষ প্র্যাক্টিস নির্দেশনা অনুসরনে শুনানি গ্রহণ ও প্রয়োজনীয় আদেশ প্রদান করবেন।’
সে মোতাবেক আদালত গুলো ভার্চুয়াল উপস্থিতি নিশ্চিত করে অতীব জরুরী বিষয়ে প্রায় সব ক্ষেত্রে আদেশ প্রদান করার সুযোগ তৈরী হয়। অবশ্য পরে ৭ /৬ /২০ ২০ ইং তারিখে ৩ নং নতুন প্র্যাক্টিস নির্দেশনা প্রদান করা হয় যেখানে শুধুমাত্র Negotiable Instruments Act, 1881 এর ১৩৮ ধারার মামলা, অন্য মামলা ও আপিল সহ যেখানে তামাদি আইনের ৫ ধারা প্রযোজ্য নয় সেগুলো দাখিল এর কথা বলা হয়েছে। তবে পূর্বের নির্দেশনার আলোকে দেওয়ানি মামলা ও অতীব জরুরী হলে দাখিল হচ্ছে। কিন্তু আদালতের অন্য কার্যক্রম গুলো প্রায় বন্ধ আছে। কিন্তু এটা হওয়ার নয়। কেনো না পরবর্তী প্র্যাক্টিস নির্দেশনা আগের নির্দেশনার ধারাবাহিকতা বটে। আর ২৩০ নং প্র্যাক্টিস direction মোতাবেক সমস্যা হলে ২১৪ নং প্র্যাক্টিস direction এর ১৯ নং দফায় তার সমাধান ছিল। তাতে পরিষ্কার বলা হয়েছে এই নির্দেশনা তে প্রদত্ত কোনো বিষয় উত্থাপিত হলে আদালত প্রচলিত আইন অনুসারে আদালত পরিচালনার বিষয়ে পদ্ধতি নির্ধারন করতে পারবেন। আর আদালত ২৩০ নং প্র্যাক্টিস direction মোতাবেক মামলার বিচার (trial), বা বিচারিক অনুসন্ধান (inquiry) বা দরখাস্ত বা আপিল শুনানি বা সাক্ষ্য(evidence) গ্রহণ বা যুক্ততর্ক(argument) গ্রহণ বা আদেশ (order) বা রায় (judgment) প্রদান করতেই পারেন। কেনো না ২৩০ নং নির্দেশনাতে আদালত কর্তৃক তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ, ২০২০ এবং ২১৪ নং বিজ্ঞপ্তি অনুসারে কাজ করার কথা যৌথভাবে আছে। আবার মানুষের বিচার পাওয়ার অধিকার অতীব জরুরী বিষয় বটে।
করোনা কবে শেষ হবে WHO পর্যন্ত বলতে পারে না। আবার উপরের আলোচনা হতে এটি পরিষ্কার যে সংবিধান ও আইন অনুসারে অধ্যাদেশের অধীনে আদালতে সকল বিষয় ভার্চুয়াল উপস্থিতি নিশ্চিত করে ধীরে ধীরে প্রায় সব ক্ষেত্রে চালু হলে বাঁধা নাই। তবে সময়ের প্রেক্ষাপটে ধীরে ধীরে ভার্চুয়াল উপস্থিতি এর ত্রুটি গুলো উন্মোচন হবে এবং সেগুলোর সমাধান হবে বলেই আশা করা যায় এবং তাতে সাধারণ জনগণ আইনের আশ্রয় লাভের অধিকারী হবে। আর এটাই সবাই কামনা করে।
চন্দন কান্তি নাথ : সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, কুমিল্লা।