সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট চন্দন কান্তি নাথ

সুপ্রিম কোর্টের নতুন প্র্যাকটিস নির্দেশনা যেভাবে সংশয় দূর করেছে

চন্দন কান্তি নাথ:

বাংলাদেশে প্রায় সকল ক্ষেত্রে এখন ডিজিটাল কার্যক্রম হচ্ছে |আদালতে সুপ্রীম কোর্ট এর প্র্যাকটিস নির্দেশনা (direction) সাপেক্ষে বিচার (trial), বা বিচারিক অনুসন্ধান (inquiry) বা দরখাস্ত বা আপিল শুনানি বা সাক্ষ্য (evidence) গ্রহণ বা যুক্ততর্ক (argument) গ্রহণ বা আদেশ (order) বা রায় (judgment) প্রদানকালে পক্ষগণের ভার্চ্যুয়াল উপস্থিতি নিশ্চিত করবার জন্যে সরকার আইন করেছে | যখন সব কিছু বন্ধ ছিল তখন মাননীয় সুপ্রীম কোর্ট এর প্র্যাকটিস নির্দেশনা (direction)  মোতাবেক জামিন শুনানি হয়| পরে সুপ্রীম  কোর্ট ২৩০ নং প্র্যাকটিস নির্দেশনা (direction) জারি করেন| তাতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা নিশ্চিতকরণ ও শারীরিক উপস্থিতি ব্যতিরেকে বিচার কার্য পরিচালনার কথা বলা হয় | বাংলাদেশের  মাননীয় প্রধান বিচারপতি হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক পূর্বের প্রদত্ত ক্ষমতা বলে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট এর ১০ ই মে ২০২০ ইং তারিখে ২১৪ নং বিজ্ঞপ্তি মূলে প্রচারিত বিশেষ প্র্যাকটিস নির্দেশনার ধারাবাহিকতায় অতিরিক্ত বিশেষ ২৩০ নং  প্র্যাকটিস নির্দেশনা (direction) জারি করেন | উক্ত নির্দেশনাতে স্পষ্টভাবে আদালত কর্তৃক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ, ২০২০  এবং ২১৪ নং বিজ্ঞপ্তি অনুসারে অতীব জরুরী বিষয়সমূহ শুনানি গ্রহণ ও প্রয়োজনীয় আদেশ প্রদান করার কথা বলা হয় | ১ নং দফাতে বলা হয় – ‘অধস্তন দেওয়ানী ও ফৌজদারি আদালত এবং ট্রাইবুনাল সমূহে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অতীব জরুরী বিষয় সমূহ আদালত কর্তৃক তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ, ২০২০ এবং বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট এর ১০ /০৫ /২০ তারিখের ২১৪ নং বিজ্ঞপ্তি মূলে প্রচারিত বিশেষ প্র্যাকটিস নির্দেশনা অনুসরনে শুনানি গ্রহণ ও প্রয়োজনীয় আদেশ প্রদান করবেন |’

সে মোতাবেক আদালতগুলো ভার্চ্যুয়াল উপস্থিতি নিশ্চিত করে অতীব জরুরী বিষয়ে  প্রায় সবক্ষেত্রে আদালত কর্তৃক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ, ২০২০ ব্যবহার করে  আদেশ প্রদান করার সুযোগ  তৈরী হয়| কিন্তু ৭/৬/২০২০ ইং তারিখে ৩ নং নতুন প্র্যাকটিস নির্দেশনা প্রদান করা হয় যেখানে শুধুমাত্র Negotiable Instruments Act, 1881 এর ১৩৮ ধারার মামলা, অন্য মামলা ও আপিলসহ যেখানে তামাদি আইনের ৫ ধারা প্রযোজ্য নয় সেগুলো দাখিল এর কথা বলা হয়েছে| এতে আইন অঙ্গনে সংশয় তৈরী হয়|

কিন্তু গত ১৫ ই জুন, ২০২০ সনে ২৩০ নং  প্র্যাকটিস নির্দেশনা (direction) এর ধারাবাহিকতা দিয়ে নতুন  ২৪৮  নং প্র্যাকটিস নির্দেশনা (direction) দেয়া হয় এবং  তাতে ২৩০ নং  প্র্যাকটিস নির্দেশনা (direction) অনুসরণ করতে বলা হয়| যেখানে ৭/৬/২০২০ ইং তারিখে ৩ নং প্র্যাকটিস নির্দেশনার কথা বলা হয়নি| আর ইতিমধ্যে উহার ব্যাখ্যা প্রদানে মাননীয় ঢাকা মহানগর দায়রা জজ (ভার্চ্যুয়াল আদালত) এর এম ইমরুল কায়েশের আদালতে আসামি সামছুল আলম ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে আত্মসমর্পণ করে জামিন পেয়েছেন। এসময় আসামি সামছুল আলম আইনজীবী ফারুক আহম্মেদের চেম্বারে উপস্থিত ছিলেন। শুনানি শেষে বিচারক দশ হাজার টাকা মুচলেকায় তার জামিন আবেদন মঞ্জুর করেন।

ভার্চ্যুয়াল উপস্থিতি নিশ্চিত করার জন্যে এবং আদালতে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্যই অধ্যাদেশ তথা আইনটি হয়েছে| অধ্যাদেশের শিরোনামে বলা হয় – মামলার বিচার (trial), বা বিচারিক অনুসন্ধান (inquiry) বা দরখাস্ত বা আপিল শুনানি বা সাক্ষ্য (evidence) গ্রহণ বা যুক্ততর্ক (argument) গ্রহণ বা আদেশ (order) বা রায় (judgment) প্রদানকালে পক্ষগণের ভার্চ্যুয়াল উপস্থিতি নিশ্চিত করবার উদ্দেশ্যে আদালতকে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষমতা প্রদানের নিমিত্ত বিধান প্রণয়ন করা সমীচীন ও প্রয়োজন বিধায় অধ্যাদেশ প্রণয়ন ও জারি করা হয়েছে| আবার অধ্যাদেশের ২ ধারায় ভার্চ্যুয়াল উপস্থিতি বলতে বুঝানো হয়েছে, অডিও, ভিডিও বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক পদ্ধতির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তির আদালতে বিচার বিভাগীয় কার্য ধারায় উপস্থিত থাকা বা অংশগ্রহণ| ৩(২) ধারায় পরিষ্কার করে বলা হয়েছে ৩(১) অধীন অডিও, ভিডিও বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে বিচারপ্রার্থী পক্ষরা বা তাদের আইনজীবী বা সংশ্লিষ্ট অন্য ব্যক্তি বা সাক্ষীর ভার্চ্যুয়াল উপস্থিতি নিশ্চিত করা ব্যতীত অন্যান্য বিষয়ের ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্য বিধি বা ক্ষেত্র মত, দেওয়ানি কার্য বিধি অনুসরণ করতে হবে |

আবার বর্তমানে কোনো জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয় নাই| ৩৫(৩) অনুসারে ফৌজদারী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তি আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালত বা ট্রাইব্যুনালে দ্রুত ও প্রকাশ্য বিচারলাভের অধিকারী হবেন-অনুচ্ছেদটিও অকার্যকর নয়| অনুচ্ছেদ ৩১ অনুসারে আইনের আশ্রয়লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহার লাভ যে কোন স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষতঃ আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না, যাতে কোন ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে। ৩৩ (১) অনুচ্ছেদে আছে গ্রেপ্তারকৃত কোন ব্যক্তিকে যথাসম্ভব শীঘ্র গ্রেপ্তারের কারণ জ্ঞাপন না করে প্রহরায় আটক রাখা যাবে না এবং উক্ত ব্যক্তিকে তাঁর মনোনীত আইনজীবীর সহিত পরামর্শের ও তাঁর দ্বারা আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার হতে বঞ্চিত করা যাবে না। ৭ (২) নং অনুচ্ছেদে আছে, সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্যকোন আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসামঞ্জস্য হয়, তাহলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হবে৷ ৪৪(১) নং অনুচ্ছেদে মৌলিক অধিকার ভাগে প্রদত্ত অধিকারসমূহ বলবৎ করবার জন্য এই সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগের নিকট মামলা রুজু করবার অধিকারের নিশ্চয়তা দান করা হয়।

মানুষের বিচার পাওয়ার অধিকার ও আইন অনুযায়ী ব্যবহার UDHR (Universal Declaration of Human Rights), ICCPR (International Covenant on Civil and Political Rights) এবং সর্বোপরি আমাদের সংবিধান মোতাবেক মৌলিক অধিকার|

তবে অতীব জরুরি বিষয়টি কোথাও সংজ্ঞায়িত করা হয়নি| বিচার (trial), বা বিচারিক অনুসন্ধান (inquiry) বা দরখাস্ত বা আপিল শুনানি বা সাক্ষ্য (evidence) গ্রহণ বা যুক্ততর্ক (argument) গ্রহণ বা আদেশ (order) বা রায় (judgment) এর প্রতিটি ক্ষেত্রে জরুরী বিষয় থাকতে পারে| কারো একমাত্র মাথা গুঁজার বাড়িটির কম মূল্যে হতে পারে কিন্তু তা বেদখল হওয়ার উপক্রম হলে বা একমাত্র কৃষি জমি, পুকুর বেদখল হলে তা জরুরী বিষয়| পুলিশ কাউকে ধরার জন্যে হয়রানি করছে, তাঁর আদালতে আত্মসমর্পণ (surrender) করা দরকার, আবার অনেকে প্রকাশ্যে খুন, ধর্ষণ, ডাকাতি, চুরি করছে – তাঁর তদন্ত, সাক্ষ্য (evidence) গ্রহণ বা যুক্ততর্ক (argument), আদেশ প্রদান ও বিচার গুরুত্বপূর্ণ| ম্যাজিস্ট্রেটগণ অতীব জরুরী বিধায় ২২ ধারায় ও ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি থেকে শুরু করে, রিমান্ড (remand) শুনানি, আসামীকে বিচারিক (Judicial) অথবা পুলিশ হেফজতে (custody) তে পাঠানোর কাজ করছেন এবং এফআইআর (FIR) হলে তারও আনুষঙ্গিক সকল পাতায় পাতায় স্বাক্ষর করছেন| এভাবে  অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা থেকে শুরু করে সমান অধিকার, জীবন ও জীবিকার অধিকার (right to life and profession), সম্পত্তি ও চাকরি রক্ষাসহ অনেক কাজ ও বিষয় আছে যা অতীব জরুরী এবং আদালত উক্ত অতীব জরুরী বিষয় দেখলে উদ্ভূত অধিকারগুলো রক্ষার জন্যে সাধারণ নাগরিকরা আদালতের আশ্রয় নিতে পারেন| আবার বর্তমানে অনেক আইনজীবীও (advocate) করোনা সময়ে কর্মহীন হয়েছে|

আগেই বলা হয়েছে প্রায় অতীব জরুরী সকল বিষয় শুনানির জন্যে গত ১৫ ই জুন এর নতুন প্র্যাকটিস নির্দেশনা (direction) এর মাধ্যমে সকল সংশয় দূর হয়েছে এবং তাতে ২৩০ নং প্র্যাকটিস নির্দেশনা (direction) অনুসরণ করতে বলা হয়| ফলে আদালত কর্তৃক তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ, ২০২০  এবং ২১৪ নং বিজ্ঞপ্তি অনুসারে অতীব জরুরী বিষয়সমূহ শুনানি গ্রহণ ও প্রয়োজনীয় আদেশ দেয়া যাবে| আর ২৩০ নং প্র্যাকটিস নির্দেশনা (direction) মোতাবেক সমস্যা হলে ২১৪ নং প্র্যাকটিস নির্দেশনা (direction) এর ১৯ নং দফায় তার সমাধান আছে| তাতে পরিষ্কার বলা হয়েছে উক্ত নির্দেশনাতে নাই এমন কোনো বিষয় উত্থাপিত হলে আদালত প্রচলিত আইন অনুসারে আদালত পরিচালনার বিষয়ে পদ্ধতি নির্ধারণ করতে পারবেন| তাই ২০২০ সনে ২৩০ নং  প্র্যাকটিস নির্দেশনা (direction) এর ধারাবাহিকতা দিয়ে নতুন প্র্যাকটিস নির্দেশনা (direction) এর মাধ্যমে বিচার (trial), বা বিচারিক অনুসন্ধান (inquiry) বা দরখাস্ত বা আপিল শুনানি বা সাক্ষ্য (evidence) গ্রহণ বা যুক্ততর্ক (argument) গ্রহণ বা আদেশ (order) বা রায় (judgment) প্রদানকালে পক্ষগণের ভার্চ্যুয়াল উপস্থিতি নিশ্চিত করে সকল সংশয় দূর করে সকল অতীব জরুরী বিষয় শুনানি হলে সবাই উপকৃত হবে|

লেখক- সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, কুমিল্লা।