রেবিনা রিফাই সারা:
বিগত বছরগুলোতে সাইবার অপরাধের যেসব মামলা এসেছে, তার মধ্যে অধিকাংশ (৭২% এর বেশি) মামলাই সাবেক প্রেমিক প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ছবি ভাইরাল করা প্রসঙ্গে। কিন্তু বাংলাদেশে বর্তমানে এর প্রভাব পড়ছে স্বামী-স্ত্রীর উপরও। যেমন, বেশ কিছু মামলায় স্বামী যৌতুক সরাসরি চাইতে গেলে জেল জরিমানার ভয়ে তার সহযোগীর মাধ্যমে স্ত্রীর আপত্তিকর ছবি অনলাইনে ভাইরাল করছে এবং টাকা আদায় করেছে। আবার বেশ কিছু মামলায় বিবাহ বিচ্ছেদের পর সাবেক স্বামী প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে প্রাক্তন স্ত্রীর আপত্তিকর ছবি অনলাইনে ভাইরাল করছে। অর্থাৎ, অনলাইনে ব্যক্তিগত ছবি দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইল এখন বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড এর মধ্যে আর সীমাবদ্ধ নাই। আর এর সবই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনের আওতায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আজকে আলোচনা করব পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১২ নিয়ে।
প্রথমেই এই আইনটি সম্পর্কে ও এই আইনের অধীনে পর্নোগ্রাফি ঠিক কি- এই বিষয়ে জেনে নেই। পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১২ সালের ৯ নং আইন। অন্য আইনে যাই থাকুক না কেন, এই আইনের ধারা ৩ অনুযায়ী এই আইন প্রযোজ্য হবে। এই আইনের আওতায় পর্নোগ্রাফি উৎপাদন, সংরক্ষণ, বাজারজাতকরণ, বহন, সরবরাহ, ক্রয়, বিক্রয়, ধারণ বা প্রদর্শন ইত্যাদি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
আইনে পর্নোগ্রাফির সংজ্ঞা
ধারা ২ এর উপধারা গ অনুসারে, পর্নোগ্রাফি অর্থ হলো- যৌন উত্তেজনা সৃষ্টিকারী কোন অশ্লীল সংলাপ, অভিনয়, অঙ্গভঙ্গি, নগ্ন বা অর্ধনগ্ন নৃত্য যা চলচ্চিত্র, ভিডিও চিত্র, অডিও ভিজ্যুয়াল চিত্র, স্থির চিত্র, গ্রাফিকস বা অন্য কোন উপায়ে ধারণকৃত ও প্রদর্শনযোগ্য এবং যার কোন শৈল্পিক বা শিক্ষাগত মূল্য নেই। যৌন উত্তেজনা সৃষ্টিকারী অশ্লীল বই, সাময়িকী, ভাস্কর্য, কল্পমূর্তি, মূর্তি, কার্টুন (অনেকেই ট্রল করেন) বা লিফলেট।
পর্নোগ্রাফির সরঞ্জাম
ধারা ২ এর ঘ অনুসারে, ‘পর্নোগ্রাফি সরঞ্জাম’ অর্থ- পর্নোগ্রাফি উৎপাদন, সংরক্ষণ, ধারণ বা প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত, ক্যামেরা,কম্পিউটার বা কম্পিউটার যন্ত্রাংশ, সিডি, ভিসিডি, ডিভিডি,অপটিক্যাল ডিভাইস, ম্যাগনেটিক ডিভাইস, মোবাইল ফোন বা উহার যন্ত্রাংশ এবং যে কোনো ইলেক্ট্রনিক, ডিজিটাল বা অন্য কোন প্রযুক্তিভিত্তিক ডিভাইস।।
তদন্তের সময়সীমা
তদন্তের সময়সীমা ৩০ কার্য দিবস পর্যন্ত। এরপরে প্রয়োজন অনুসারে ১৫ দিন সময় বাড়ানো হতে পারে।
পর্নোগ্রাফি আইনে অপরাধের শাস্তি
পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১২ এর ৮ ধারায় পর্নোগ্রাফির জন্য শাস্তি উল্লেখ করা হয়েছে।
ধারা ৮ (১) অনুযায়ী, কোন ব্যক্তি পর্নোগ্রাফি উৎপাদন করলে বা উৎপাদন করার জন্য অংশগ্রহণকারী সংগ্রহ করল করে চুক্তিপত্র করলে অথবা কোন নারী, পুরুষ বা শিশুকে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য করলে বা প্রলোভন দেখিয়ে ভিডিও ধারণ করলে সর্বোচ্চ ৭ (সাত) বৎসর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড এবং দুই লক্ষ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবে।
ধারা ৮ (২) অনুযায়ী, কোন ব্যক্তি পর্নোগ্রাফির মাধ্যমে অন্য কোন ব্যক্তির সামাজিক বা ব্যক্তি মর্যাদা হানি করলে বা ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায় করলো বা কোন সুবিধা আদায় করলে বা ব্যক্তিকে ধারনকৃত ভিডিও দিয়ে মানসিক নির্যাতন করলে সর্বোচ্চ ৫ বৎসর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড এবং দুই লক্ষ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবে।
ধারা ৮ (৩) অনুযায়ী, কোন ব্যক্তি ইন্টারনেট বা ওয়েবসাইট বা মোবাইল ফোন বা অন্য কোন ইলেকট্রনিক ডিভাইসের মাধ্যমে পর্নোগ্রাফি সরবরাহ করলে সর্বোচ্চ ৫ বৎসর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড এবং দুই লক্ষ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবে৷
ধারা ৮ (৪) অনুযায়ী, কোন ব্যক্তি পর্নোগ্রাফি প্রদর্শনের মাধ্যমে গণউপদ্রব সৃষ্টি করলে সর্বোচ্চ ২ বৎসর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড এবং এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবে।
ধারা ৮ (৫) অনুযায়ী, কোন পর্নোগ্রাফি প্রাপ্তি স্থান সম্পর্কে কোন প্রকারের বিজ্ঞাপন প্রচার করলে অথবা সন্ধান দিলে সর্বোচ্চ ২ বৎসর সশ্রম কারাদণ্ড এবং এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবে।
তবে হ্যাঁ মিথ্যা বা ভিত্তিহীন বা হয়রানির জন্য কেউ ফাঁসাতে চাইলে তার জন্যও শাস্তি আছে- সর্বোচ্চ ২ বৎসর সশ্রম কারাদণ্ড এবং এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবে।
সাক্ষ্যগ্রহণ এবং জামিনযোগ্যতা
এই আইনে ভিডিও-অডিও এভিডেন্স হিসেবে নেয়া যাবে। যদিও সাক্ষ্য আইনে এটা গ্রহণযোগ্য না। এই আইন অনুযায়ী অপরাধ আমলযোগ্য এবং জামিনঅযোগ্য।
সবশেষে, পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১২ ছাড়াও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আছে যেখানে কুরুচিপূর্ণ খুদে বার্তা প্রেরণের জন্যও মামলায় পড়তে হতে পারে। সুতরাং, জেনে না জেনে যারা পর্নগ্রাফি করে ফেলছেন, সাবধান হোন। ২০১২ সালে পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনটি প্রণয়ন হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত আইনটির আওতায় ১৯টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে ও চলমান মামলা রয়েছে ১৩ টি (পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ থেকে সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী)। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও পর্ণগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনের আওতায় শাস্তিযোগ্য অপরাধের শিকার হলে যতদ্রুত সম্ভব আইনগত সহায়তা নিন এবং বিয়ের আগে বা পরে এমন কোন ছবি ধারণ করবেন না যেটা ভবিষ্যতে হুমকির কারণ হতে পারে।
রেবিনা রিফাই সারা: আইনজীবী; ঢাকা জজ কোর্ট এবং ঢাকা ট্যাক্সেস বার এসোসিয়েশন।