অ্যাডভোকেট ইকবাল হাসান

বার কাউন্সিল ‘পরীক্ষা জট’ সমাধানে বিকল্প পদ্ধতি: বিশ্লেষণ ও মতামত

অ্যাডভোকেট ইকবাল হাসান:

সনদ প্রত্যাশী শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের সমস্যা সমাধানে বিলম্বিত পরীক্ষা নীতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। করণীয় উচিৎ হবে যুগোপযোগী সমাধান, যা হবে দীর্ঘদিনের জন্য কার্যকরি।

জনবিস্ফোরণের এই দেশে বিলম্বিত পরীক্ষা কখনোই মান নিয়ন্ত্রণ করেনা বরং সমস্যাকে ঘনীভূত করে। কারণ দিন যত যাবে পরিক্ষার্থী সংখ্যা জ্যামিতিক হারে তত বাড়বে। এখানে উল্লেখ্য যে, ২০১২ সাল থেকে আইনজীবীদের তালিকাভুক্তকরণ প্রক্রিয়ায় প্রথম ধাপ প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হিসেবে প্রথমবার এমসিকিউ (MCQ) পদ্ধতি চালু করা হয়। এরপর থেকে যথাক্রমে ২০১৩, ২০১৫, ২০১৭ এবং সর্বশেষ ২০২০ সালে আইনজীবী তালিকাভুক্তকরণ পরীক্ষার প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।

অন্যদিকে, প্রতি ছয় মাস পর পর বার কাউন্সিল তালিকাভুক্তকরণ প্রক্রিয়া সম্পন্নের বিধি থাকলেও বিগত সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অধিক পরীক্ষার্থীর চাপে সময় মতো সম্পন্ন হয়নি। কোন ক্ষেত্রে তালিকাভুক্তকরণ প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হতে ছয় মাসের পরিবর্তে একবছর গড়িয়ে দুই বছর সময় লেগেছে। বিশেষ করে সর্বশেষ প্রিলিমিনারি পরীক্ষাটি (২০১৭ সালের পর ২০২০ সালে) প্রায় তিন বছরের ব্যবধানে অনুষ্ঠিত হয়। যার ফলে আইনজীবী তালিকাভুক্তকরণ প্রক্রিয়াটি একটি দীর্ঘসূত্রিতায় রূপান্তর হয়েছে।

দেশে মামলা সংখ্যার আনুপাতিক হারে যে পরিমাণ আইনজীবী থাকার প্রয়োজন সেই সংখ্যক আইনজীবী নেই। অথচ, মামলা জট নিরসনে আইনজীবীদের ভূমিকা অনেকাংশেই মূখ্য। দক্ষ আইনজীবীর অভাবে নিচ্ছিদ্র বেলুনের মত ফুলছে দেশের মামলার জট। সেজন্য, এমন একটি সনদ পরীক্ষা পদ্ধতি দরকার, যা হবে সময়োপযোগী, দ্রুত এবং বাস্তব সম্মত। যে পরীক্ষা পদ্ধতি অবলম্বনে দেশে দক্ষ আইনজীবী তৈরী হবে এবং মামলা জট নিরসনে ভূমিকা রাখবে।

এক্ষেত্রে করনীয় বিকল্প পরীক্ষা পদ্ধতি যেমন হতে পারে
শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের চলমান সমস্যা নিরসনে এবং ভবিষ্যত দক্ষ আইনজীবী তৈরীর বাস্তবতার নিরিখে করনীয় হিসাবে নিম্নে উল্লেখিত ১০টি সুপারিশের আলোকে একটি বিকল্প পরীক্ষা পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে। এই বিকল্প পরীক্ষা পদ্ধতি বাস্তবায়ন হলে অনেকাংশেই কমে যাবে শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের বর্তমান সমস্যাগুলো এবং ভবিষ্যত সমস্যার একটি দীর্ঘ মেয়াদী সমাধানও হতে পারে।

  • প্রথমত, শিক্ষানবিশ আইনজীবীদেরকে যার যার জেলা বারে কমপক্ষে ১ বছর আদালতের জুনিয়র হিসাবে প্র্যাকটিস করতে হবে। আদালতে নিয়মিত হাজির থাকতে হবে। জেলা আদালতে একটি বিশেষ হাজিরা খাতা দিয়ে হাজিরা নিশ্চিত করা হবে। শতকরা ৭০ ভাগ হাজিরা দিলে সনদের জন্য পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পাবে। শিক্ষানবিশদের জেলা পর্যায়ের সব ধরণের আদালতেই অর্থাৎ জেলা ও দায়রা আদালত, সিভিল আদালত, দায়রা ও ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতসহ বিভিন্ন ট্রাইব্যুনাল আাদালতে একটি নির্দিষ্ট সময় উপস্থিত থাকতে হবে। যাতে করে শিক্ষানবিশরা আদালতে মামলা পরিচালনার প্রায়োগিক জ্ঞান লাভ করবে।
  • বার কাউন্সিলের পরীক্ষা নেয়ার জন্য একটি পঞ্জীবর্ষ থাকবে। সেখানে প্রতি বছর কোন তারিখে এমসিকিউ, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষাসহ সনদ প্রদান অনুষ্ঠিত হবে, তা সুস্পষ্টভাবে তালিকা বা তফসিল করে উল্লেখ থাকবে।
  • পরীক্ষা অনুষ্ঠান সংক্রান্ত কার্যক্রম স্থানীয় জেলা জাজ এবং জেলা আইনজীবী সমিতির তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত হবে। শিক্ষর্থীরা নিজ জেলা বারের অধীনে নিজ জেলায় পরীক্ষা দিবেন। পূর্বনির্দিষ্ট তারিখ অনুসরে সারাদেশে একই দিনে একই সময়ে একই প্রশ্নে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে।
  • আইনজীবী তালিকাভুক্তির এমসিকিউ পরীক্ষাটি বর্তমান নিয়মেই মূল্যায়িত হবে। তবে পরীক্ষাটি সংশ্লিষ্ট জেলা বার সভাপতি এবং জেলা ও দায়রা বিচারকের তত্ত্বাবধানে প্রতিটি জেলায় অনুষ্ঠিত হবে। পরীক্ষার দিন সকালে রাষ্ট্রীয় ডাকে সীলগালা খামে প্রশ্নপত্র ও উত্তরপত্র আসবে। পরীক্ষা শেষে আবার সীলগালা খামে করে উত্তরপত্র ও উপস্থিতি নথি প্রয়োজনীয় নিরাপত্তাসহ বার কাউন্সিলে আবার ফেরত আসবে।
  • লিখিত পরীক্ষাও উপরের পদ্ধতি অনুসারে হবে। তবে লিখিত পরীক্ষার খাতা জেলা জজের অধীনে বিচারকগণ মূল্যায়ন করবেন। জেলা আদালতে বিচারক সংখ্যা বেশি হওয়ায় দ্রুত লিখিত পরীক্ষার ফলাফল পাওয়া যাবে। এক জেলা বারের খাতা অন্য জেলা আদালতের বিচারকগণ মূল্যায়ন করবেন। পরীক্ষার খাতায় নামের পরিবর্তে কোড থাকবে।
  • মৌখিক পরীক্ষা স্থানীয় জেলা ও দায়রা জজ, বার কাউন্সিলের ১জন প্রতিনিধি, জেলা বার সভাপতি ও সেক্রেটারি নিবেন। তাদের মনোনয়ন তালিকা বার কাউন্সিলে যাবে এবং ৭ দিনের মধ্যে বার কাউন্সিল এই ফলাফল গেজেট করে প্রকাশ করে সংশ্লিষ্ট বারে পাঠাবে।
  • কোন পরীক্ষার্থী এই লিখিত পরীক্ষায় সংক্ষুব্দ মনে করলে বার কাউন্সিল বরাবর আপিল করবেন। বার কাউন্সিল এক মাসে মধ্যে সেসব পরীক্ষার্থীর খাতা পুনঃমূল্যায়ন পূর্বক নতুন সমন্বিত ফলাফল প্রকাশ করবেন। আর জেলা বারে মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে কোন পরীক্ষার্থী অসন্তোষ প্রকাশ করলে বার কাউন্সিলের সদস্যগণ পুনরায় মৌখিক পরীক্ষা নিতে পারবেন এবং সমন্বিত ফলাফল প্রকাশ করতে পারবেন।
  • আইনজীবী অন্তর্ভুক্তির পুরো বিষয়টি স্বচ্ছভাবে সম্পন্ন হয়েছে কিনা, সে বিষয়টি বাংলাদেশ বার কাউন্সিল এনরোলমেন্ট কমিটি দেখবেন ও তদারকি করবেন। এক্ষেত্রে এনরোলমেন্ট কমিটি স্বাধীন থাকবেন। সিলেবাস প্রণয়ন, প্রশ্নপত্র তৈরী এবং ফলাফল প্রকাশের ক্ষেত্রে এনরোলমেন্ট কমিটির অনুমোদন লাগবে।
  • সনদপ্রাপ্ত নবীন আইনজীবীগণ নিজ জেলা বার আদালতে কমপক্ষে ১ বছর আদালতের কর্মকর্তা হিসাবে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করবেন। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট জেলার জেলা জজ অসহায় ফরিয়াদি ও বিচারপ্রার্থিদের মামলাগুলো নবীন আইনজীবীদের মধ্যে বন্টন করবেন। সংশ্লিষ্ট বার সভাপতি, সেক্রেটারি ও অন্যান্য সদস্যগণ তাদের আইনপেশার প্রতি দায়িত্বস্বরূপ উক্ত নবীন আইনজীবীদের এই গরীব ফরিয়াদিদের মামলা পরিচালনায় সিনিয়র আইনজীবীর ন্যায় মামলার উদ্ভূত পরিস্থিতিতে করণীয় অভিমত ও উপদেশ দিয়ে সহায়তা করবেন। এক্ষেত্রে মামলাজট নিরসনে ভূমিকা রাখায় সরকার থেকে স্বল্প অর্থের হলেও একটি নির্দিষ্ট মাসহারা নবীন আইনজীবীগণ পাবেন, যাতে তারা আইন পেশায় টিকে থাকতে পারেন।
  • নবীন দক্ষ আইনজীবী কর্তৃক ১ বছর দায়িত্ব পালন শেষে তারা নতুন পাসকৃত তালিকাভুক্ত আইনজীবীদের কাছে মামলা হস্তান্তর করবেন এবং নতুনদেরকে তাদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করবেন।

এভাবে দক্ষ আইনজীবী তৈরীর একটি চলমান প্রক্রিয়া বার কাউন্সিল ও জেলা বারের তত্বাবধানে চলবে, বার ও বিচারকের মাঝে সুসম্পর্ক স্থাপন হবে এবং দেশের মামলার জট নিরসন হবে, গরীব ফরিয়াদীরা, বিচার প্রার্থিরা উপকৃত হবে। এবং প্রতি বছর সনদ পরীক্ষা সম্পন্ন হবে, প্রতি বছর শিক্ষানবিশরা সনদ পাবেন, প্রতি বছর নবীন আইনজীবী দক্ষ আইনজীবীতে রূপান্তরিত হবেন।

অ্যাডভোকেট ইকবাল হাসান: আইনজীবী; জজ কোর্ট, ঢাকা।