মোঃ রায়হানুল ইসলাম: গত কয়দিন যাবত আইন পেশায় আসতে ইচ্ছুক কিছু ‘শিক্ষানবীশ’ সনদের দাবীতে আন্দোলন করে আসছেন। করোনা ভাইরাস সংক্রমনে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অনেক কিছইু পূর্বের আইন মোতাবেক পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না। যেমন- দেশব্যাপী করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধকল্পে এবং শারীরিক উপস্থিতি ছাড়া আদালত পরিচালনার জন্য সংসদ কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছে ‘আদালত কর্তৃক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ ২০২০’ আইন। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত শারীরিক উপস্থিতি ছাড়াই এই আইন মোতাবেক কোর্টগুলো পরিচালিত হবে মর্মে সুপ্রিম কোর্টের বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। একইভাবে করোনা ভাইরাস মহামারির বিষয়কে আমলে নিয়ে আন্দোলনরত শিক্ষানবীশদের দাবী পূরণের বিষয়ে চিন্তা করা যেতে পারে।
তবে তার আগে আন্দোলনকারীদের দাবীর বিষয়ে আলোচনার সাথে সাথে তাদের সঙ্গে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সিনিয়রদের সাথে ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা নিয়ে কিছু কথা বলা দরকার। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে শিক্ষানবীশদের আন্দোলন সবাই প্রত্যেক্ষ করেছেন। শিক্ষানবীশদের অন্যতম দাবী হল- তাদেরকে গেজেটে ঘোষণা দিয়ে আইনজীবী সনদ দিতে হবে। আন্দোলনের এক পর্যায়ে তারা সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবীদের প্রাণের সংগঠন ‘বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচিত সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজলসহ অন্যন্য সিনিয়র আইনজীবীদের সাথে চরম ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেন। শুধু তাই নয়, তারা সুপ্রীম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এবং আইনজীবীদের প্রিয় নেতা ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন ও নজীব উল্লাহ হিরু সাহেবদের সম্পর্কে অশালীন মন্তব্য করেছেন, তাদের অনুরোধকে উপেক্ষা করে চলেছেন। সিনিয়র আইনজীবীদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তাদেরকে অপমান করেছেন। আন্দোলনকারীরা সুপ্রীম কোর্ট প্রাঙ্গন ত্যাগ করলেও সিনিয়র আইনজীবীদের সাথে অসদাচরণের জন্য এখন পর্যন্ত দুঃখ প্রকাশ বা ক্ষমা প্রার্থনা না করে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আশালীন মন্তব্য অব্যাহত রেখেছেন।
সকলে বিষয়গুলো জানলেও ‘বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট আইনজীবী সমিতি’ প্রসঙ্গে নবীন ভাই-বোনদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা ব্যক্ত করা জরুরী, যদিও শিরোনামের সাথে কথা গুলো অপ্রাসঙ্গিক- ‘১৯৪৮ সালে এই সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, যিনি কিনা এক সময় প্রধানমন্ত্রীও ছিলেন। এই সংগঠনের সভাপতি বা সম্পাদক দলীয় কোন পরিচয়ে নির্বাচিত হন না। বরং আইনজীবীদের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তার কারণেই নির্বাচিন হন। দলীয় পরিচয়ে নির্বাচন করলেও দল এখানে মূখ্য থাকে না, যোগ্যরাই এখানে নির্বাচিত হয়ে আসছেন। সেটার-ই প্রতিফলন ঘটে এখানকার ভোটে। সর্বশেষ নির্বাচনে সভাপতি একটা দল থেকে নির্বাচিত হলেও সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন অন্য দল থেকে। এটার মানে দাঁড়ায়, যিনি একটি দলের সভাপতিকে ভোট দিয়েছেন, তিনি-ই ঐ একই দলের সম্পাদক প্রার্থীকে ভোট দেন নাই। এর দ্বারা এটাই স্পষ্ট যে, আইজীবিদের নেতারা যে যার যোগ্যতা দিয়েই নেতা নির্বাচিত হয়েছেন। সুতরাং তাদের প্রতি আইনজীবীদের শ্রদ্ধা আকাশচুম্বি। হাইকোর্ট এবং আপীল বিভাগে যে সকল সম্মানিত বিচারপতিগন কর্মরত আছেন, তাদের অনেকেই এই সমিতির সাথে কোননা কোনভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। তাদের অধিকাংশই এই সমিতির সাধারণ সদস্য ছিলেন। কেউ কেউ এই সমিতির নেতা ছিলেন। বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের নির্বাচনের স্বচ্ছতা বা নিরপেক্ষতা নিয়ে কখনও কোন প্রশ্ন উত্থাপিত হয় নাই। সমাজের সবচেয়ে সচেতন মানুষগুলো এখানকার ভোটার। অথচ এই পেশার ভবিষ্যৎ যারা তারাই অশোভন আচরণ করছেন অগ্রজদের সঙ্গে!
সুতরাং ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ না করে, সুপ্রীম কোর্টে কর্মরত সিনিয়রদের পরামর্শ নিয়েই তাদের আন্দোলনে নামা উচিত ছিল। সম্মানিত সিনিয়ররা কখনও তাদেরকে নিরাশ করতেন না। তবে সিনিয়র আইনজীবীরা কোন অন্যায় বা অন্যায় দাবীর বিপক্ষে থাকাটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। তাছাড়া আইনজীবী হতে ইচ্ছুক নবীন ভাই-বোনরা যখন আইনজীবী তালিকাভুক্তির জন্য ১০ বছরের একজন সিনিয়রের অধীনে ৬ মাস জুনিয়রশীপ করার অঙ্গিকার জমা দিয়েছিলেন। সিনিয়ররা বা আইনজীবিরা কখনো নবীন ভাই-বোনদের প্রতিপক্ষ নয়। আজকে যারা সিনিয়র তারাও এক সময় জুনিয়র ছিলেন। কিন্তু অযোগ্য কেউ এই পেশায় সম্পৃক্ত হলে, সেই প্রশ্নে অনেক আইনজীবীর দ্বিমত থাকাটাই স্বাভাবিক।
বার কাউন্সিলের দায়িত্ব এবং আইন পেশা
বার কাউন্সিল নিয়ম অনুসারে প্রতি বৎসর পরীক্ষার আয়োজন করতে বাধ্য। বার কাউন্সিল বনাম দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় মামলায় আপীল বিভাগ কর্তৃক প্রদানকৃত রায়েও বার কাউন্সিল কর্তৃক প্রতি বছর পরীক্ষা আয়োজনের প্রতি জোর দেওয়া হয়েছে।
রায়ের এক পর্যায়ে বলা হয়েছে- ‘The Bar Council shall complete the enrollment process of the applicants to be enrolled as advocates in the district courts each calendar year.’
সুতরাং এই ক্ষেত্রে বার কাউন্সিল তার ব্যর্থতার দায় এড়াতে পারেনা।
তবে বার কাউন্সিলের এই ব্যর্থতার কারনে পরীক্ষা ছাড়া গেজেট করে নিয়মিত আইনজীবিদের মত ‘স্থায়ী সনদ’ এর গেজেট দাবী মোটেও যৌক্তিক নয়। আন্দোলন করে সনদ দাবী করার সুযোগ অন্তত এই পেশার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। এই পেশায় যারা সনদপ্রাপ্ত হবেন, তিনি এক সময় আপীল বিভাগের বিচারপতিও হতে পারেন। অন্যান্য পেশার মত আইন পেশাকে দেখার সুযোগ নাই। বার কাউন্সিল বনাম দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় মামলার রায়ে এমনটাই ব্যক্ত করে বলা হয়েছে-
‘A profession of law being founded on great traditions that it is not a business but a part of a scheme of a welfare State where all segments of public reposed faith in them to protect their fundamental rights, they are answerable to the social conscience of the society and have moderate obligation towards them who are unable to protect their interest. Lawyers are duty bound to contribute in building social order so that the fruits of the social economic justice reach to the poor segment of people of the country, and therefore, a lawyer owes a duty to be fair not only to his client but also to the society.’
সুতরাং যোগ্যদেরই আইন পেশার জন্য সনদ পাওয়া উচিত। তাই পরীক্ষা পদ্ধতি আরো কঠোর করা জরুরী। আর পরীক্ষা ছাড়া নিয়মিত আইনজীবিদের মত সনদ প্রদানের প্রশ্নই আসেনা।
আইনজীবী দাবী করার অধিকার এবং সনদের দাবী
বর্তমানে সনদপ্রাপ্ত আইনজীবী থেকে সনদ ছাড়া আইনজীবীর (!) সংখ্যাও কম নয়। সম্প্রতি ঢাকা বার এবং সুপ্রীম কোর্টে বেশ কিছু আইনজীবী পরিচয়দানকারী টাউটকে ধরা হয়েছে। আবার অনেকে সনদ ছাড়াই নিজেকে আইনজীবী বা এডভোকেট দাবী করছেন। যেমন- কেবল আইটিপি পরীক্ষা দিয়ে, বার কাউন্সিল পরীক্ষায় পাশ করা ছাড়াই ঢাকা ট্যাকসেস বারের অধিকাংশ সদস্য দাপটের সাথে নিজেদের এডভোকেট বা আইনজীবী পরিচয় দিয়ে আসছেন। অথচ ‘ঢাকা ট্যাকসেস বার এসোসিয়েশন’ বার কাউন্সিল কর্তৃক স্বীকৃত কোন বার নয়। আইনজীবী হতে হলে আইনজীবী বা এডভোকেটের নিম্নোক্ত সংজ্ঞার অর্ন্তভুক্ত হতে হবে।
জেনারেল ক্লজেজ এ্যাক্ট- ১৮৯৭ ধারা (২) (এ) এ বলা আছে- “Advocate” means a person enrolled as such under the Bangladesh Legal Practitioners and Bar Council Order, 1972 (P. O. No. 46 of 1972). Bangladesh Legal Practitioners and Bar Council Order, 1972 (২) (এ) তে বলা আছে, “Advocate” means an advocate entered in the roll under the provisions of this Order.’
সুতারং আইন বহির্ভূতভাবে কেউ এডভোকেট বা আইনজীবী দাবী করে আইন পেশায় সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ নাই। আর লিখিত বা ভাইভা পরীক্ষা ছাড়া এই ধরনের সুযোগ থাকা উচিত নয়। ইতোপূর্বে শিক্ষানবীশরা এমসিকিউ পরীক্ষার দাবী করেছিলেন। কর্তৃপক্ষ পরীক্ষার তারিখ দিয়েছে এবং সেই পরীক্ষায় অনেকে উত্তীর্ণ হয়েছেন। এখন তারা দ্রুত লিখিত পরীক্ষার দাবী না করে, বাকী দুই ধাপের পরীক্ষা ছাড়াই সদন দাবী করছেন। এর যুক্তি হিসেবে তারা বলছেন- সনদ না থাকার কারনে তারা তাদের পরিবারকে চেহারা দেখাতে পারেন না। তারা খুবই দুঃখ কষ্টে আছেন ইত্যাদি। এই সকল যুক্তিতে স্থায়ী সনদ দাবী করা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এবং বে-আইনী।
শিক্ষানবীশরা এমনটা দাবী করছেন না যে, যতদিন লিখিত পরীক্ষা হচ্ছে না, ততদিন (লিখিত পরীক্ষার আগ পর্যন্ত) আদালতে অস্থায়ীভাবে প্র্যাকটিসের অনুমতি বা সুযোগ দেওয়া হোক। এমনটা দাবী করলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ভেবে দেখার সুযোগ পাবে বলে বিজ্ঞজনরা মনে করেন। আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে- তারা মূলত পরীক্ষা ভীতি থেকেই পরীক্ষা ছাড়া সনদ দাবী করছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে, এই ধরনের দাবী প্রথম শ্রেনীর শিক্ষার্থীরাও করছেন না। অন্যদিকে আন্দোলনকারীরা দাবী না করলেও বার কাউন্সিল এই বিষয়ে সমাধানের পথ খোঁজার চিন্তা করতে পারে। অস্থায়ীভাবে শিক্ষানবীশদের প্রাকটিসের অনুমতি প্রদান করা হলে তারা আন্দোলনের আর সুযোগ পাবে না।
পরিশেষে,এই পেশার মর্যাদা রক্ষার জন্য দারুল এহসান ইউনিভাসির্টি মামলার রায়ের আলাকে নিম্নোক্ত পর্যবেক্ষণসহ আদালতের অন্যান্য পর্যবেক্ষণগুলো বাস্তবায়ন করা অতীব জরুরী।
The Bar Council may limit/increase the age limit of a person to be enrolled as an advocate either in the district courts or the High Court Division by framing rules.The Bar Council has power not to recognize any degree in respect of any student for being enrolled as an advocate who has not studied four years honors course in law along with other subjects in any private university.
আইন পেশার মর্যাদা রক্ষায় যে যার অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখতে হবে। পেশাকে বিতর্কিত করে এমন কোন দাবী বা কাজে লিপ্ত হওয়া কাম্য নয়।
মোঃ রায়হানুল ইসলাম: আইনজীবী; সুপ্রীম কোর্ট, বাংলাদেশ। ই-মেইল: rayhan01719@yahoo.com