কাজী ফয়েজুর রহমান: দেশের বিচার বিভাগ মূলত দুই ভাগে বিভক্ত। উচ্চচর বিচার বিভাগ তথা সুপ্রিম কোর্ট এবং অধস্তন বিচার বিভাগ বা নিম্ন আদালতসমূহ। এর মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের আবার রয়েছে দুইটি বিভাগ। একটি উচ্চ আদালত বা হাইকোর্ট এবং অপরটি আপীল বিভাগ। এছাড়া অধস্তন আদালতের মধ্যে দেওয়ানি, ফৌজদারি ও ট্রাইব্যুনাল এই তিন ধরণের আদালত রয়েছে। বিচারিক এখতিয়ারের ওপর ভিত্তি করে অধস্তন আদালতসমূহ আবার নানা ভাগে বিভক্ত।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ষষ্ঠভাগে বিচার বিভাগের ধরণ ও এখতিয়ার নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। এ ভাগের প্রথম পরিচ্ছেদে সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগ অর্থাৎ আপীল বিভাগ ও হাইকোর্টের বিচারিক ক্ষমতা, আদালত পরিচানলায় প্রশাসনিক বিধি প্রণয়ন, বিচারক নিয়োগ পদ্ধতি, বিচারকের ক্ষমতা ও উক্ত পদের মেয়াদ সম্পর্কে বলা আছে। আর দ্বিতীয় ও তৃতীয় পরিচ্ছেদে যথাক্রমে অধস্তন আদালত ও ট্রাইব্যুনাল বিষয়ে বলা আছে।
আদি সংবিধান অনুযায়ী অধস্তন আদালতসমূহ তত্ত্বাবধায়ন ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা হাইকোর্টের। যদিও পরবর্তীতে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীতে ‘আদালত’ শব্দটি ‘আদালত ও ট্রাইব্যুনাল’ শব্দগুলো দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়। হাইকোর্টের সহজ বাংলা ‘উচ্চ আদালত’ সকলেরই জানা। সংবিধানে সুপ্রিম কোর্টকে সর্বোচ্চ আদালত বলা হলেও হাইকোর্টের বাংলা হিসেবে উচ্চ আদালত ব্যবহার করা হয়নি। তবু হাইকোর্টের বদলে উচ্চ আদালত ব্যবহারে কোন দ্বিমত নাই। কিন্তু সংবিধানে স্পষ্টভাবে হাইকোর্টের অধীনস্ত আদালতসমূহকে অধস্তন আদালত বলা হলেও গণমাধ্যমে সংবাদের ক্ষেত্রে নিম্ন আদালত ব্যবহার নিয়ে আইনজীবী, আইন শিক্ষার্থীসহ সংশ্লিষ্ট অনেকেই দ্বিমত পোষণ করেন। যুক্তি হচ্ছে যেহেতু সংবিধানে ও আইনে সুস্পষ্টভাবে ‘অধস্তন আদালত’ বলা আছে সেহেতু ‘অধস্তন’ এর স্থলে ‘নিম্ন’ শব্দটি ব্যবহার করা অগ্রহণযোগ্য এবং আইনসম্মত নয়।
পাঠক এ পর্যায়ে চলুন ‘অধস্তন’ শব্দের অর্থ কি তা জেনে নেওয়া যাক। ‘অধস্তন’ একটি বিশেষণ পদ, যার অর্থ অধীন, নিম্ন, অবর, অপ্রধান, অধঃস্থ। মাঝে মাঝে ছোট বোঝাতেও অধস্তন শব্দটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সে অর্থে উচ্চ আদালতের অধীনে থাকা আদালতসমূহকে নিম্ন আদালত বলতে বাধা নাই। অন্তত বাংলা ভাষাতে নাই।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে যদি নিম্ন আদালত বলা যেত তবে সংবিধানে কেন অধস্তন ব্যবহার করা হয়েছে? এর উত্তর হচ্ছে প্রথমত ভাষাগত মাধুর্যতা বজায় রাখতে কিংবা সংবিধান প্রণয়নকারীদের নিম্ন এর বদলে অধস্তন শব্দটি রুচিসম্মত কিংবা বেশি পছন্দ হয়ে থাকতে পারে।
কেউ আবার বলতে পারেন সুপ্রিম কোর্টের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আদালত ব্যবহার করা হয়েছে সে অনুযায়ী অধস্তনকে নিম্ন আদালত বলা গেলে সেটা উল্লেখ নাই কেন? এ প্রশ্নের জবাবে বলতে চাই হাইকোর্টের পরিবর্তে সংবিধানের কোথাও উচ্চ আদালত ব্যবহার করা না হলেও হাইকোর্টের বদলে ‘উচ্চ আদালত’ শব্দটি ব্যবহার সর্বজন স্বীকৃত। এছাড়া সংবিধান দেশ পরিচালনার ব্যাকরণ, ভাষা ব্যাকরণ নয় যে সমার্থক শব্দের সমাহার থাকবে।
এক্ষেত্রে একটি উদাহরণ হচ্ছে, কোন ব্যক্তি মারা গেলে, মৃত্যুর সংবাদে না ফেরার দেশ, দেহত্যাগ, ইন্তেকাল, মৃত্যুবরণ, পরলোকগমন ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এখন যদি না ফেরার দেশ আবার কি? এই দেশ কোথায় অবস্থিত? স্বাধীন নাকি পরাধীন? জাতীয় পতাকা আছে না নাই? থাকলে রং কি? তাদের ভাষা কি? সেখানে গিয়ে মানুষ কি করে? জাতীয় প্রশ্ন করলে প্রতিউত্তরে প্রশ্নকর্তার নিকট পাল্টা প্রশ্নে জানতে চাওয়া হবে আপনি কি পাগল? অথবা ছেলেমানুষি করছেন কেন? আবার দেখুন মৃত্যুকে কেউ বরণ করে? নববর্ষ, বধূবরণ ঠিক আছে, মৃত্যুকে কে বরণ করতে চায়?
এমন হাজার স্বীকৃত সমার্থক শব্দ নিয়ে অনর্থক আলোচনা হতে পারে। তাতে কোন ফায়দা হবে না। শব্দ হয় ব্যাকরণ সম্মত। আইন সম্মত শব্দ হয়না। আইনের ক্ষেত্রে বহুল ব্যবহত শব্দকে এক দৃষ্টিতে হয়তো আইনি শব্দ বা পরিভাষা বলা যেতে পারে কিন্তু উক্ত শব্দের সমার্থক শব্দ ব্যবহার করা অগ্রহণযোগ্য কিংবা বে-আইনি বলা যাবে কি?
কাজী ফয়েজুর রহমান: বার্তা সম্পাদক; ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম।