অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে বাংলাদেশের সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ও বিশিষ্ট আইনজীবী ড. কামাল হোসেন বলেছেন, অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম অত্যন্ত অমায়িক ও নম্র মানুষ ছিলেন। আইনজীবী হিসেবে তিনি আমাদের সঙ্গে অনেক কাজ করেছেন। ভালো আইনজীবী ছিলেন। আইনের দক্ষতা ও সততা ছিল তার মাঝে। দক্ষতার কারণে তিনি আইন পেশার প্র্যাকটিস জীবনে ভালো সফলতা পেয়েছেন। তার বিকল্প এ মুহূর্তে ভাবা যায় না।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান এই আইনজীবী আরও বলেন, একজন অ্যাটর্নি হিসেবে যে দক্ষতা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হয়, বর্তমানে তা কারও মাঝেই সেভাবে প্রতীয়মান নয়। তাই মাহবুবে আলমের বিকল্প খুঁজতে আরও সময় লেগে যাবে।
দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ মেয়াদে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা ছিলেন অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম। দেশের আইন অঙ্গনে দীর্ঘ ৪৫ বছর ৭ মাস ২৮ দিন নিয়োজিত ছিলেন। গত ৩ সেপ্টেম্বর থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট ২৩ দিন হাসপাতালে অসুস্থতার সঙ্গে লড়াই করে হেরে হেলেন। গতকাল রোববার শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
মাহবুবে আলম পেশাগত জীবনে একদিকে যেমন ছিলেন বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘসময়ে পদে থাকা অ্যাটর্নি জেনারেল, তেমনি নিষ্ঠা, কর্তব্য ও আন্তরিকতা দিয়ে স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার বিচার, জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচার, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াত ও বিএনপিসহ শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনায় ছিলেন কঠোর। তিনি কোনো হুমকি-ধমকিকে তোয়াক্কা না করে এসব ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ মামলা পরিচালনা করেছিলেন।
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম মেয়াদে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ এসব মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে আইনি লড়াই করেছেন তিনি। এসব মামলা পরিচালনা করে সমাদৃত হয়েছেন প্রথিতযশা আইনজীবী হিসেবে। তাই মাহবুবে আলমের জীবদ্দশায় তার বিকল্প খোঁজা হয়নি কখনো। অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ১১ বছর ৮ মাস ১৪ দিন। অবশেষে মৃত্যুর কাছে অবসান ঘটল তার সে দীর্ঘ রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ১৯৪৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি মুন্সিগঞ্জ জেলার লৌহজং উপজেলার মৌছামান্দ্রা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৮ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স ও ১৯৬৯ সালে পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর ১৯৭২ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন।
মাহবুবে আলম ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ বার কাউন্সিল থেকে আইন পেশা পরিচালনার অনুমতিপ্রাপ্ত হয়ে ঢাকা আইনজীবী সমিতির সদস্য হন। এরপর ১৯৭৫ সালে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ও ১৯৮০ সালে আপিল বিভাগে আইন পেশা পরিচালনার অনুমতি পান। ১৯৯৮ সালে আপিল বিভাগের সিনিয়র অ্যাডভোকেট হিসেবে তালিকাভুক্ত হন তিনি।
মাহবুবে আলম সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির ১৯৯৩-৯৪ সালে সম্পাদক ও ২০০৫-২০০৬ সালে সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি ২০০৪-২০০৭ বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের নির্বাচিত সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি ১৯৭৯ সালে ভারতের নয়াদিল্লির ইনস্টিটিউট অব কনস্টিটিউশনাল অ্যান্ড পার্লামেন্টারি স্টাডিজ থেকে সাংবিধানিক আইন ও পার্লামেন্টারি বিষয়ে ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর ১৯৯৮ সালের ১৫ নভেম্বর থেকে ২০০১ সালের ৪ অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশের অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
২০০৯ সালের ১৩ জানুয়ারি বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন মাহবুবে আলম এবং পদাধিকারবলে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাহবুবে আলমের আগে খন্দকার আবু বকর দীর্ঘদিন অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৭৬ সালের ১১ মে নিয়োগ পান এবং ১৯৮৫ সালের ১৩ মার্চ পর্যন্ত প্রায় ৮ বছর ১০ মাস ২ দিন দায়িত্ব পালন করেন।
ব্যক্তিজীবনেও মাহবুবে আলম একজন সফল মানুষ ছিলেন। এক পুত্র ও এক কন্যা সন্তানের জনক। পুত্র সুমন মাহবুব পেশায় সাংবাদিক। কন্যা শিশির কনা ও জামাতা শেখ রিয়াজুল হকও আইনপেশায় আছেন। তার স্ত্রী বিনতা মাহবুব একজন স্বনামধন্য চিত্রশিল্পী।
মাহবুবে আলম একজন ভ্রমণপ্রিয় মানুষ ছিলেন। তিনি বিভিন্ন সেমিনার, সিম্পোজিয়ামসহ বেড়ানোর উদ্দেশ্যে ভারত, শ্রীলঙ্কা, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, মিশর, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, হংকং, কোরিয়া ও তানজানিয়াসহ বিশ্বের অনেক দেশ সফর করেছেন।
বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল পদে থাকাকালে মাহবুবে আলম জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের বিচারের জন্য সংবিধানের পঞ্চম, সপ্তম, ত্রয়োদশ ও ষোড়শ সংশোধনী মামলা, বিডিআর বিদ্রোহ হত্যা মামলা, মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত মতিউর রহমান নিজামী, দেলোয়ার হোসেন সাঈদী, কাদের মোল্লা, মো. কামরুজ্জামান, আলী আহসান মুজাহিদ, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ অনেকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষে থেকে সুপ্রিম কোর্টে মামলা পরিচালনা করেছেন।
আইনজীবী মাহবুবে আলম রোববার (২৭ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যা ৭টা ২৫ মিনিটে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন।
জ্বর ও গলাব্যথা নিয়ে গত ৪ সেপ্টেম্বর তিনি সিএমএইচ হাসপাতালে ভর্তি হন। ওইদিনই করোনা পরীক্ষা করালে রিপোর্ট পজিটিভ আসে। এরপর থেকে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় গত ১৯ সেপ্টেম্বর তাকে আইসিইউতে স্থানান্তর নেয়া হয়।
এরপর আর তিনি সুস্থ হয়ে উঠতে পারেননি। ২৩ দিন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় রোববার তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, এক ছেলে, এক মেয়ে ও অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। সূত্র- জাগো নিউজ