২০১৮ সালে ‘ধর্ষণ আইন সংস্কার এখনই’ সংক্রান্ত প্রচারণা শুরু হয়। এই প্রচারণার অংশ হিসাবে ধর্ষণ সংক্রান্ত আইনে সংশোধনের দাবীর জন্য ‘ধর্ষণ আইন সংশোধন জোট’ গঠন করা হয়। প্রচারণার মূখ্য উদ্দেশ্য ছিল ধর্ষণ রোধে ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আইনি এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর ফাঁক-ফোকর সনাক্ত করা এবং এই ফাঁকগুলি কাটিয়ে ওঠার জন্য সংস্কার সংক্রান্ত প্রস্তাবনাসমূহ প্রণয়ন করা।
সম্প্রতি নারী নির্যাতন ও নারী প্রতি সহিংসতা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাওয়ায় দেশজুড়ে ধর্ষণ-বিরোধী বিক্ষোভের প্রতি সংহতি জানিয়ে ধর্ষণ আইন সংস্কার জোট ধর্ষণের ন্যায়বিচারের জন্য নিম্নরূপ দশ দফা দাবি জানিয়েছে।
আইনগত সংস্কার
১। মানবাধিকার মানদন্ডের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ধর্ষণ আইনের সংস্কার: ধর্ষণের শিকার ব্যক্তিদের (লিঙ্গ, জেন্ডার, যৌনতা, ধর্ম, বর্ণ, জাতি, জাতীয়তা, প্রতিবন্ধিতা ও বয়স নির্বিশেষে) সুরক্ষা ও ন্যায়বিচারে অভিগম্যতা নিশ্চিত করতে এবং নিরপেক্ষ বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সকলের অধিকার রক্ষা করতে বাংলাদেশের সংবিধানে স্বীকৃত মৌলিক অধিকার এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের (সিডো, সিআরসি এবং আইসিসিপিআর সহ অন্যন্য) সাথে সামঞ্জস্য রেখে ধর্ষণ আইন সংস্কার করতে হবে।
২। ধর্ষণের সংজ্ঞাকে বিস্তৃত করে তা বৈষম্যহীন করা: অপরাধী বা ধর্ষণের শিকার ব্যক্তিদের জেন্ডার নির্বিশেষে ধর্ষণকে পুনসংজ্ঞায়িত করতে হবে।
৩। ধর্ষণের আইনে ‘পেনিট্রেশন’কে সংজ্ঞায়িত করা: আইনের মধ্যে “পেনিট্রেশন” অর্থাৎ যোনি, মলদ্বার বা ধর্ষণের শিকার ব্যক্তির যৌনাঙ্গের মুখে বা ভেতরে বা বাইরে বা শরীরের অন্য কোন অংশে পুরুষাঙ্গ বা অন্য কোন বস্তুর প্রতিস্থাপনকে (পেনিট্রেশন) ধর্ষণের সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত করা।
৪। শাস্তির আনুপাতিকতা প্রদান করা এবং সাজা প্রদানের নির্দেশিকা প্রবর্তন করা: সাজা প্রদানের ক্ষেত্রে বিচারকদের সুবিবেচনা (discretion) প্রয়োগ করার জন্য আইন সংশোধন এবং প্রয়োজনীয় সাজা প্রদান নির্দেশিকা (sentencing guideline) প্রণয়ন করা যা শাস্তির আনুপাতিকতা নিশ্চিত করে এবং অন্যান্য যৌক্তিক বিষয়সমূহ (যেমন: অভিযুক্ত ব্যক্তির বয়স বা মানসিক স্বাস্থ্য) এবং উদ্বেগজনক পরিস্থিতির (যেমন: অস্ত্রের ব্যবহার, বলপ্রয়োগ বা সহিংসতা এবং ধর্ষণের শিকার ব্যক্তির স্থায়ী শারীরিক বা মানসিক ক্ষতি) বিবেচনা করে।
৫। ধর্ষণের শিকার প্রতিবন্ধী ব্যক্তির ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা: ধর্ষণের শিকার প্রতিবন্ধী ব্যক্তির ন্যায়বিচারের প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করতে হবে। ভাষা, শ্রবণ ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিগণ যেন প্রতিবন্ধিতার কারণে ধর্ষণের বিচারের ক্ষেত্রে কোন প্রতিবন্ধকতার শিকার না হন তার জন্য ১৮৭২ সালের স্বাক্ষ্য আইনের সংস্কার করতে হবে।
৬। ধর্ষণ মামলায় অভিযোগকারী ধর্ষণের শিকার ব্যক্তির চরিত্রগত সাক্ষ্যের ব্যাবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা: সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারা এবং এ সংক্রান্ত অন্যান্য ধারা সংশোধনের মাধ্যমে ধর্ষণ মামলার বিচারে অভিযোগকারীর চরিত্রগত সাক্ষ্য বিবেচনায় আনা বন্ধ করতে হবে। এরূপ সংস্কারের মাধ্যমে বিচারকগণ যাতে নিশ্চিত করতে পারেন যে আসামী পক্ষের আইনজীবীগণ জেরার সময় অভিযোগকারীকে ও সাক্ষীকে অভিযোগকারীর চরিত্র সম্পর্কে কোন অবমাননাকর বা অবজ্ঞামূলক প্রশ্ন না করে।
৭। সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন: খসড়া ভিকটিম ও সাক্ষী সুরক্ষা বিল (২০০৬ সালে আইন কমিশন প্রথম খসড়া তৈরী করেছিল এবং পরবর্তীতে ২০১১ সালে এটি পর্যালোচনা করা হয়েছে) পুনর্বিবেচনা করে এই বিলটি পাস করা যাতে করে ভিকটিম ও সাক্ষীগণ প্রাতিষ্ঠানিক সুরক্ষা, জরুরি আশ্রয়, জীবিকা নির্বাহের সহায়তা, মনো-সামাজিক সহায়তা এবং প্রয়োজন অনুসারে তাদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা করে এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ভিকটিম ও সাক্ষীর নিরাপত্তা যেন হুমকীর মুখে না পড়ে তাদের নিরাপত্তার জন্য সন্তোষজনক বিকল্প ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত এ জাতীয় সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
৮। ধর্ষণের শিকার ব্যক্তিদের জন্য রাষ্ট্র পরিচালিত একটি ক্ষতিপূরণ তহবিল গঠন করা: রাষ্ট্র পরিচালিত একটি “ক্ষতিপূরণ তহবিল” গঠন করা, যেন ধর্ষণ প্রমাণ হওয়া সাপেক্ষে ধর্ষণের শিকার ব্যক্তি ক্ষতিপূরণ পেতে পারেন। ক্ষতিপূরণ দেয়ার ক্ষেত্রে অপরাধী চিহ্নিত হয়েছে কিনা বা তার বিচার হয়েছে কিনা তা বিবেচিত হবে না। এই ধরনের তহবিল হতে ধর্ষণের ফলে জন্ম নেয়া শিশুর ভরণপোষণের ব্যবস্থা করা।
প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার
৯। বিচার ব্যবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জেন্ডার সংবেদনশীলতা বিষয়ক প্রশিক্ষণ: জনপ্রতিনিধি, পুলিশ, আইনজীবী (প্রসিকিউশন/ডিফেন্স), বিচারক, ডাক্তার, ধর্মীয় নেতা, শিক্ষক, সাংবাদিক এবং সমাজ কর্মীদের জন্য জেন্ডার সংবেদনশীলতা বিষয়ক প্রশিক্ষণের আয়োজন করা, যেন বিচার পাওয়ার প্রক্রিয়ায় ধর্ষণের শিকার ব্যক্তির সঙ্গে সংবেদনশীল আচরণ করা হয়।
১০। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠক্রমে সম্মতি সম্পর্কিত বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা: জেন্ডার এবং নারীর প্রতি সহিংসতা সম্পর্কে ধারণা এবং প্রচলিত নেতিবাচক সামাজিক রীতি-নীতি পরিবর্তন করার জন্য সম্মতি ও পছন্দের ধারণাসহ লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা (বিশেষতঃ ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতার অন্যান্য ধরন) সম্পর্কিত তথ্য প্রাথমিক শিক্ষাস্তর থেকে পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা।