মুহম্মদ আলী আহসান: সন্তান কর্তৃক পিতা-মাতার ভরণ পোষণ নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে পিতা-মাতার ভরণ পোষণ আইন, ২০১৩ প্রণীত হয়েছে। উক্ত আইনের ২ ধারায় বলা হয়েছে, পিতা অর্থ এমন ব্যক্তি যিনি সন্তানের জনক, মাতা অর্থ এমন ব্যক্তি যিনি সন্তানের গর্ভধারিনী। তবে সৎ পিতা ও সৎ মাতাকে পিতা-মাতার সংজ্ঞায় অন্তর্ভূক্ত করা হয়নি। অর্থাৎ উক্ত আইন অনুযায়ী সৎ পিতা-মাতা ভরণ পোষণ পাওয়ার অধিকারী নন।
উক্ত ধারায় ভরণ পোষণের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ভরণ পোষণ অর্থ খাওয়া-দাওয়া, বস্ত্র, চিকিৎসা, বসবাসের সুবিধা ও সঙ্গ প্রদান। সন্তান অর্থ পিতার ঔরষে ও মাতার গর্ভে জন্ম নেয়া সক্ষম ও সামর্থ্যবান পুত্র বা কন্যা।
উক্ত আইনের ৩ ধারায় পিতা-মাতার ভরণ পোষণ সম্পর্কে বিধান দেয়া হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, প্রত্যেক সন্তান (সক্ষম ও সামর্থ্যবান পুত্র-কন্যা) তার পিতা-মাতার ভরণ পোষণ নিশ্চিত করবেন। তবে একাধিক সন্তান থাকলে সন্তানগণ নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে পিতা-মাতার ভরণ পোষণ নিশ্চিত করবেন।
উক্ত আইনে আরো শর্ত দেয়া হয়েছে যে, সন্তানকে পিতা-মাতার সঙ্গে একই সঙ্গে বসবাস করতে হবে। তবে পিতা-মাতা কিংবা পিতা বা মাতা কিংবা উভয়ে পৃথকভাবে বসবাস করলে সন্তানকে নিয়মিতভাবে তার বা তাদের সাথে সাক্ষাৎ করতে হবে এবং সন্তানকে তার দৈনন্দিন আয়-রোজগার বা মাসিক বা বাৎসরিক আয় হতে যুক্তিসঙ্গত পরিমাণ অর্থ পিতা বা মাতা বা উভয়কে নিয়মিত প্রদান করতে হবে। তবে কোন সন্তান তার পিতা বা মাতা বা উভয়কে তাদের বিরুদ্ধে কোন বৃদ্ধ নিবাস কিংবা অন্য কোথায় একত্রে কিংবা আলাদাভাবে বসবাস করতে বাধ্য করতে পারবেন না।
তাছাড়া, প্রত্যেক সন্তান তার পিতা-মাতার স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখবেন এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা ও পরিচর্যা প্রদান করবেন। পিতা-মাতার অবর্তমানে প্রত্যেক সন্তান তার দাদা-দাদী ও নানা-নানীর ভরণ পোষণ করতে বাধ্য।
উক্ত আইনের ৫ ধারায় পিতা-মাতার ভরণ পোষণ না করার দণ্ড বর্ণিত আছে। তাতে বলা হয়েছে, কোন সন্তান তার পিতা-মাতা এবং পিতা-মাতার অবর্তমানে দাদা-দাদী ও নানা-নানীর ভরণ পোষণ না করলে অপরাধ বলে গণ্য হবে এবং উক্ত অপরাধের জন্য অনুর্ধ্ব ১,০০,০০০/- (এক লক্ষ) টাকা অর্থদণ্ড এবং উক্ত অর্থদণ্ড অনাদায়ে ৩ (তিন) মাস কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবে।
এছাড়া, কোন সন্তানকে তার স্ত্রী বা স্বামী কিংবা পুত্র-কন্যা বা অন্য কোন নিকটাত্মীয় পিতা-মাতা বা দাদা-দাদী ও নানা-নানীর ভরণ পোষণ দিতে বাধা প্রদান করলে বা ভরণ পোষণ প্রদানে অসহযোগিতা করলে তারাও অপরাধ সংঘটনে সহায়তা করেছে মর্মে গণ্য হবে এবং উল্লেখিত দণ্ডে দণ্ডিত হবে।
উক্ত আইনের অধীনে অপরাধসমূহ আমলযোগ্য, জামিনযোগ্য ও আপোষযোগ্য। উক্ত আইনের ৮ ধারায় আপোষ নিষ্পত্তির বিধান বর্ণিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, আদালতে উক্ত আইনের অধীনে প্রাপ্ত অভিযোগ আপোষ নিষ্পত্তির জন্য সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বা মেম্বার কিংবা সিটি কর্পোরেশন বা পৌরসভার মেয়র বা কাউন্সিলর কিংবা অন্য যেকোন উপযোগী ব্যক্তির নিকট প্রেরণ করবেন। উক্ত অভিযোগ আপোষ নিষ্পত্তির জন্য প্রাপ্ত হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যান, মেয়র, মেম্বার বা কাউন্সিলর উভয়পক্ষকে শুনানীর সুযোগ প্রদান করে তা নিষ্পত্তি করবেন এবং এভাবে নিষ্পত্তিকৃত অভিযোগ উপযুক্ত আদালত কর্তৃক নিষ্পত্তি বলে গণ্য হবে।
উক্ত আইনের ৭ ধারায় অপরাধ বিচারার্থে গ্রহণ ও বিচার সম্পর্কে বলা হয়েছে। উক্ত আইনের অধীন সংঘটিত অপরাধ ১ম শ্রেণির জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক বিচার্য হবে। তবে কোন আদালত এই আইনের অধীনে সংঘটিত অপরাধ সংশ্লিষ্ট সন্তানের পিতা বা মাতার লিখিত অভিযোগ ব্যতীত আমলে গ্রহণ করবেন না। পিতা-মাতার ভরণ পোষণ আইন, ২০১৩ কোন নির্দিষ্ট ধর্মানুসারীদের জন্য প্রণীত হয়নি। তাই, উক্ত আইন সকল ধর্মানুসারীদের জন্য প্রযোজ্য হবে।
বাংলাদেশে পিতা-মাতার ভরণ পোষণ সম্পর্কে এর আগে সুনির্দিষ্ট কোন আইন ছিল না। অত্র আইনটি সে অভাব পূরণ করলেও অর্থদণ্ড আদায়ের কোন সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি উক্ত আইনে বর্ণিত হয়নি। যার ফলে, আদালত অর্থদণ্ড প্রদান করলেও তা আদায়ে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। তবে সরকারকে বিধান প্রণয়নের ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। যার মাধ্যমে উক্ত আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে সরকার যেকোন সময় বিধি প্রণয়ন করতে পারবেন।
উক্ত আইনটি ২০১৩ সনে প্রণীত হলেও উক্ত আইনের অধীনে মামলা খুবই সীমিত। সে জন্য পিতা-মাতার ভরণ পোষণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে উক্ত আইনটি প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ব্যাপক ব্যবহার করা হলে বাংলাদেশে অসংখ্য পিতা-মাতা ভরণ পোষণের অভাবে যে দুর্বিসহ জীবন-যাপন করছে তা লাঘব হবে এবং আইনের উদ্দেশ্য পূরণ হবে।
মুহম্মদ আলী আহসান: চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, মৌলভীবাজার।