সিরাজ প্রামাণিক: ফৌজদারি বিচারের ক্ষেত্রে মূলনীতি হলো সাক্ষী প্রমাণ দ্বারা আসামী দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত আসামীকে নির্দোষ ধরে নিতে হবে। আরেকটি নীতি হলো, বিচারের ক্ষেত্রে কোন আবেগ, অনুভব কিংবা বিশেষ কোন ধারণা গ্রহণ করা যাবে না বা এগুলো এড়িয়ে চলতে হবে এবং মামলার সাক্ষীসহ বিষয়বস্তু বিবেচনা করে আইকে অনুসরণ করে রায় প্রদান করতে হবে। মহামান্য উচ্চ আদালত বিচারিক কাজকে স্বর্গীয় কাজ হিসাবে বিবেচনা করে বলেছেন এরূপ কাজ থেকে সরে যাওয়ার অর্থ হলো স্বর্গীয় কাজ থেকে সরে দাঁড়ানোর সামিল।
কোনো ফৌজদারী মামলার ঘটনা বা পারিপার্শ্বিক অবস্থা যদি কোনো ধরণের সন্দেহের সৃষ্টি করে তাহলে আইনানুযায়ী সেই সন্দেহের সকল সুবিধা আসামীপক্ষ পেতে হকদার। তবে যে সকল কারণে মামলার ঘটনা সম্পর্কে সাধারণত সন্দেহের সৃষ্টি করে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আসামীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সাক্ষীর দ্বারা সমর্থিত না হওয়া, এজাহারের বিবরণ গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীর দ্বারা সমর্থিত না হওয়া, আসামীর নিকট থেকে উদ্ধারকৃত আলামত জব্দ তালিকার সাক্ষীর দ্বারা সমর্থিত না হওয়া, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের জব্দ তালিকার সাক্ষী না হওয়া, আসামীর দাখিলীয় কাগজাদি বাদীর অভিযোগকে মিথ্যা প্রমাণ হওয়া।
তবে মনে রাখতে হবে, মামলা প্রমাণের দাবী বাদীর। উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত রয়েছে, আসামীকে তার নির্দোষিতা প্রমাণের আবশ্যকতা নেই। প্রসিকিউশন পক্ষকেই আসামীর অপরাধ প্রমাণ করতে হবে, ব্যর্থতায় আসামী খালাস পেতে হকদার। সাক্ষ্য প্রমাণাদি পরীক্ষার পর আদালত যদি মনে করেন যে, আসামী কর্তৃক উপস্থাপিত ব্যাখ্যা সত্য হওয়ার যৌক্তিক সম্ভাবনা আছে তাহলে আদালতের এরূপ অভিমত সম্পূর্ণ মামলায় প্রভাবিত হয়। এরূপ পরিস্থিতিতে আসামী তার অধিকারবলে সন্দেহের সুবিধা লাভের অধিকারী। (রনি আহম্মেদ লিটন বনাম রাষ্ট্র, ৬১ ডিএলআর (এইচসিডি) ১৪৭)।
ফৌজদারী মামলায় আদালতের দায়িত্ব হচ্ছে বাদী এবং আসামীপক্ষের উপস্থাপিত সমগ্র প্রমাণাদি পরিপূর্ণভাবে নিরীক্ষণ করা। সম্পূর্ণ সাক্ষ্য পর্যালোচনার পর আদালত যদি মত দেয় যে, আসামীর যুক্তি সত্য হতে পারে তবে আদালতের এরকম অভিমত সম্পূর্ণ মামলায় প্রভাবিত হয়। এমন পরিস্থিতিতে আসামী দয়া হিসেবে নয় স্বীয় অধিকারবলে সন্দেহের সুযোগ পাওয়ার হকদার, কেননা রাষ্ট্র পক্ষ সন্দেহাতীতভাবে মামলা প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে। (মোঃ খায়রুল বনাম রাষ্ট্র, ১৬ বিএলটি ৪৮০)। কারণ, ফৌজদারী আইনবিজ্ঞানের মৌলিক সূত্র হচ্ছে, যদি দুটি সম্ভাবনাময় পরিস্থিতির সাক্ষ্যে বাস্তব বিষয়টি উত্থাপিত হয় তার মধ্যে একটি আসামীর দোষ এবং অপরটি নির্দোষ সম্পর্কিত। তাহলে আদালতের উচিত আসামীর পক্ষাবলম্বন করা।
অপরাধ সংঘটনের তিন দিন পরে অভিযোগকারী প্রাথমিক তথ্যবিবরণী দাখিল করেন এবং তা দাখিলে বিলম্বের কারণ উল্লেখ করেন নাই। এ ক্ষেত্রে বাদীর মামলা সন্দেহমূলক হয়ে পড়ে।
সিরাজ প্রামাণিক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। ই-মেইল: seraj.pramanik@gmail.com