লাশকাটা ঘরের নাম শুনলেই অজানা ভয় আর আতঙ্কে অনেক সাধারণ মানুষের গা ছমছম করে ওঠে। লাশকাটা ঘর মর্গ বা ডোমঘর নামেও পরিচিত। অস্বাভাবিকভাবে যারা মারা যান, লাশ কাটাকাটি করে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তাদের মৃত্যুরহস্য উন্মোচন করা হয়। লাশকাটা ঘরে ফরেনসিক মেডিসিনের চিকিৎসকদের সহকারীরা ডোম নামে পরিচিত। এই লাশকাটা ঘরেই এমন একটি বীভৎস ঘটনা ঘটল, যা সাধারণ কল্পনাকেও হার মানায়। একাধিক মৃত তরুণীর শরীরে মিলল একজন ডোমের শুক্রাণু।
আত্মহত্যা বা অন্য অপমৃত্যুজনিত ঘটনায় মারা যাওয়ার পর এসব তরুণীর লাশ ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে নেওয়া হয়েছিল। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ডিএনএ টেস্টে তরুণীদের মৃতদেহে শুক্রাণুর উপস্থিতি পাওয়ার পর চাঞ্চল্য তৈরি হয়। কেন, কী কারণে আত্মহত্যাজনিত ঘটনায় উদ্ধার তরুণীদের শরীরে শুক্রাণুর উপস্থিতি মিলবে- শুরু হয় এই তদন্ত। এরপর বেরিয়ে আসে মর্গে থাকা একাধিক মৃত তরুণীর শরীরে আবার একই ব্যক্তির শুক্রাণু।
এটা জানার পর রহস্য আরও ঘনীভূত হয়। পরে বেরিয়ে আসে অবিশ্বাস্য এক ঘটনা। মর্গের একজন ডোম দিনের পর দিন মৃত তরুণীর লাশের সঙ্গে এমন বিকৃত ও কুরুচিপূর্ণ জঘন্য কাজ করেছে। একটি সূত্র জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত অন্তত সাত তরুণীর ডেডবডিতে ওই ডোমের শুক্রাণু মিলেছে।
গত বৃহস্পতিবার (১৯ নভেম্বর) পর্যন্ত এ ঘটনায় জড়িত ওই ডোমের নাম-পরিচয় প্রকাশ করেনি সিআইডি। তবে তারা খুদে বার্তা পাঠিয়ে এটা জানিয়েছে, ‘একজন জঘন্য ক্রিমিনালকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যে মর্গে ডেডবডিকে ধর্ষণ করত।’
তবে গতকাল শুক্রবার সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, ডোম জতন কুমার লালের ভাগিনা মুন্না ভগত। সে মামার সঙ্গেই ওই হাসপাতালের মর্গে সহযোগী হিসেবে কাজ করতো। দুই-তিন বছর ধরে মুন্না মর্গে থাকা মৃত নারীদের ধর্ষণ করে আসছিল। এ অভিযোগের সত্যতা পেয়ে বৃহস্পতিবার তাকে আটক করে সিআইডি।
এদিকে গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বুধবার থেকে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একজন ডোম ‘নিখোঁজ’ রয়েছে। সে ২০১৭ সাল থেকে তার মামার সঙ্গে ওই হাসপাতালের মর্গে লাশ কাটাছেঁড়ায় অংশ নিয়ে আসছিল।
ওই ডোমের মামার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি গণমাধ্যমকে জানান, সর্বশেষ গত বুধবার সকালেও মর্গে এসেছিল তার ভাগ্নে। তবে দুপুরের পর থেকে তার কোনো খোঁজ নেই। তার মোবাইল ফোন নম্বরও বন্ধ আছে। তার খোঁজ নিতে স্থানীয় থানায় যোগাযোগ করা হলেও পুলিশ কোনো তথ্য দিতে পারেনি। নিখোঁজ থাকায় শেরেবাংলা নগর থানায় একটি জিডিও করা হয়েছে।
লাশের সঙ্গে এমন বিকৃত কাজে তার ভাগ্নের জড়িত থাকার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মর্গে প্রতিদিন গড়ে তিন-চারটি লাশ আসে। লাশ কাটাছেঁড়ায় তার ভাগ্নে নিয়মিত অংশ নেয়। সেখানে অন্য কর্মচারীরাও থাকে। এ ধরনের ঘটনায় ভাগ্নে জড়িত থাকতে পারে, এটা তার কল্পনার বাইরে। তবে জড়িত থাকলে প্রমাণসাপেক্ষে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চান তিনি।
ওই ডোম এটাও জানান, তার ভাগ্নে নিয়মিত ইয়াবা সেবন করত। তাকে নিষেধ করা হলেও সেই পথ থেকে দূরে সরানো যায়নি।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. খলিলুর রহমান বলেন, মৃতদেহের সঙ্গে যৌন ক্রিয়াকলাপ বা আকর্ষণ এক ধরনের মানসিক রোগ। মেডিকেল টার্মে একে বলা হয় ‘নেক্রোফিলিয়া’। বিশ্বে এ ধরনের বিকৃত ঘটনার অনেক নজির রয়েছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এক ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ জানান, লাশকাটা ঘর নিয়ে অনেক মিথ রয়েছে। আবার বাস্তবেও অনেক অবিশ্বাস্য ঘটনার তথ্য তারা বিভিন্ন সময় ঘটতে দেখেছেন। সত্যি সত্যি এমন ঘটনাও ঘটেছে, তা ভৌতিক কোনো সিনেমার গল্পকেও হার মানায়।
আরেকজন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ বলেন, লাশ কাটতে সহযোগী হিসেবে কাজ করা ডোমদের কেউ কেউ মাদক সেবন করে, এটা অনেকে জানে। তবে মৃত তরুণীদের লাশের সঙ্গে কোনো ডোমের এমন আচরণ, এটা মেনে নেওয়া কঠিন। দেশের কোনো কোনো জেলায় মর্গে নির্দিষ্ট ডোম থাকে না। মর্গে লাশ গেলে মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের খবর দিয়ে এনে লাশ কাটানো হয়।
মর্গ সংশ্নিষ্টরা জানান, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড মর্গে ঘুরে ঘুরে মৃত মানুষের মাংস ও কলিজা খেতেন খলিলুল্লাহ নামের এক ব্যক্তি। ১৯৭৫ সালের ৪ এপ্রিল দৈনিক বাংলায় তাকে নিয়ে সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হয়। সাপ্তাহিক বিচিত্রায় একই বছরের ১৮ এপ্রিল প্রচ্ছদ হিসেবে এ কাহিনি ছাপা হলে সারাদেশে হইচই পড়ে যায়।
আড়াই দশক আগেও ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে আরও একজন ছিলেন, যার মৃত মানুষের মাংস খাওয়ার অভ্যাস ছিল। এ ছাড়া তরুণীদের কবর খুঁজে বিকৃত মানসিকতার পরিচয় দিত- এমন একটি চক্র নিয়ে মর্গ সংশ্নিষ্টদের মধ্যে নানা আলোচনা রয়েছে। সূত্র: সমকাল