কাজী শরীফ: আমার আদালতে স্বত্বসাব্যস্তে খাসদখলের মামলা বিচারাধীন। বাদী রফিকের (ছদ্মনাম) দাবি হলো তিনি ১৯৭৫ সালের তিনটি দলিলমূলে নালিশী ১৩১০ দাগে সাড়ে সাত শতক সম্পত্তির মালিক। মূলবিবাদী শফিক (ছদ্মনাম) অন্য বিবাদীদের সাথে নিয়ে হুমকি ধামকি দিয়ে তাকে চার শতক জায়গা থেকে বেদখল করেছে। বিএস খতিয়ানেও রফিকের নামে রেকর্ড হয়নি। তাই ঐ চারশতক বাবদ খাসদখল ও পুরো সাড়ে সাত শতক বাবদ স্বত্ব ঘোষণার প্রার্থনায় বাদী এ মোকদ্দমা আনয়ন করেন।
বিবাদী শফিক এ দাবি অস্বীকার করে বলেন এ সম্পত্তির মালিকানা তারই। বহুবছর ধরে তিনি ভোগদখল করছেন। আচমকা বাদী রফিক এসে এ মামলা করেছেন।
মামলার শুনানি পর্যায়ে বাদী তার দাবির স্বপক্ষে সাক্ষ্যপ্রদান করেন। বিবাদীর আইনজীবী জেরা করেন। জেরায় তার দাখিলি দলিল ভুয়া বলে বিজ্ঞ আইনজীবী দাবি করলেও বাদী তার অবস্থানে অনড় থাকেন। মোকদ্দমা প্রমাণের স্বার্থে তাকে বেদখলের সময় উপস্থিত সাক্ষীও আদালতে উপস্থাপন করেন। তারাও চিরায়ত নিয়মে বাদীর দাবির পক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করেন।
বাদীর সাক্ষ্য শেষে বিবাদী শফিকের আইনজীবী একখানা দরখাস্ত দাখিলক্রমে রফিকের মালিকানা প্রমাণে উপস্থাপিত তিনটি দলিল আদালতের নিরাপত্তা হেফাজতে রাখার প্রার্থনা করেন ও বালামের সাক্ষীকে সাক্ষ্য মান্য করেন। আমি দরখাস্ত মঞ্জুর করি।
পরবর্তী ধার্য তারিখে বালামের সাক্ষী সাক্ষ্য দেন। তিনি তিনটি দলিলের বালাম বই আদালতে নিয়ে আসেন ও সাক্ষ্য দিয়ে বলেন বালাম বইয়ে এ তিনটি দলিলের অস্তিত্ব নেই। এ তিনটি দলিলই জাল। এগুলো মামলার উদ্দেশ্যে সৃজিত। শফিকের আইনজীবী সামান্য জেরা করে বালামের সাক্ষীর আর সাক্ষ্য নেন না।
এরপরের তারিখে বিবাদী শফিক সাক্ষ্য দেন। পরবর্তী তারিখে দখলের সাক্ষীরা সাক্ষ্য দেন। তারা বিবাদী শফিকের দখল আছে মর্মে সাক্ষ্য দেন।
বালামের সাক্ষী সাক্ষ্য দেয়ার পর থেকে বাদী রফিক আর আদালতে আসেন না। তার বিজ্ঞ আইনজীবীও আর বিবাদী কিংবা বিবাদীর সাক্ষীকে জেরা করেন না। জাল দলিল ধরা পড়ে যাওয়ায় রফিক বুঝে যায় এ মামলায় আর জেতা যাবে না। সুতরাং জাল দলিল ইস্যুতে আদালতমুখী হওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবেনা!
যুক্তিতর্কের জন্য নির্ধারিত দিনেও বাদী রফিক কিংবা তার নিযুক্তিয় বিজ্ঞ আইনজীবীর দেখা পেলাম না। তিনি জাল দলিল দ্বারা বাদী তার প্রার্থিত দাবি করায় মামলা খারিজের প্রার্থনা করেন।
আমি দেখলাম বিজ্ঞ আইনজীবী থেকে পাঁচ ছয় হাত পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন এক শীর্ণকায় ব্যক্তি। হাতের উপর ভেসে ওঠা রগ গোনা যায় সহজেই। বুঝে গেলাম ইনি মামলার বিবাদী। যাকে শফিক নামে আপনারা চিনেছেন।
জিজ্ঞেস করলাম কী করেন?
-স্যার রিকশা চালাই।
মামলার খরচ চালাইছেন কীভাবে?
-স্যার অনেক কষ্ট হইছে। বলতে বলতেই কেঁদে দিলেন। এখন রিকশাটাও বেচে দিতে হইছে!বিজ্ঞ আইনজীবীর বাসা আমার আগের বাসার পাশে থাকায় আমি তার অর্থনৈতিক অবস্থা জানি৷ বললাম লার্নেড আল্লাহ আপনাকে সম্পদ দিয়েছে। আল্লাহর রহমতে তিনতলা বাড়ি করেছেন। এসব মক্কেলদের থেকে পারলে ফি কম নেবেন। আল্লাহ এর বদলে ভালো কিছু দিবেন।
বিজ্ঞ আইনজীবী কিছু বলার আগেই শফিক বলে উঠলো “স্যার উকিল সাব আমার কাছ থেকে টাকা নেয়না। মামলার কাগজ (দলিলের সহিমুহুরী নকল) তুলতেই আমার খরচ হয় সব!”
বিজ্ঞ আইনজীবীর দিকে ধন্যবাদের দৃষ্টি দিতেই তিনি বললেন “স্যার আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালো রাখছে আল্লাহ৷ আমি আসলেই ওর কাছ থেকে ফি নিই না। আমার গ্রামের বাড়ির পাশের মানুষ। রিকশা চালায়।”
বিবাদী শফিককে জিজ্ঞেস করলাম বাদী আপনার চাচাতো ভাই। মিথ্যা মামলা করলো কেনো?
শফিক বলে “স্যার আমাকে নিরীহ পেয়ে ক্ষমতা দেখায়। এলাকায় ওরা ত্রাস। জাল দলিল ধরা পড়ার পর কোর্টে ভয়ে আসেনা। আমাকে বাড়িতে ভয় দেখায়।”জিজ্ঞেস করলাম “রিকশাতো বেচে ফেলছেন। রিকশা বানাতে কত লাগে?”
বলল হাজার দশেক লাগে স্যার।
গতকাল রায় লিখলাম। বাদীর মামলা খারিজ। মিথ্যা ও অহেতুক মামলা করায় বিশ হাজার টাকা খরচসহ খারিজ করলাম। শফিক যেনো দুটো রিকশা কিনতে পারে। একটা নিজে চালাবে। অন্যটা ভাড়া দিয়ে কিছু টাকা পাবে। বিবাদী বাদী বরাবর বিশ হাজার টাকা দিতে বাধ্য থাকবে।
আর জাল দলিল উপস্থাপনের জন্য বাদী রফিকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হবে। জাল দলিল বাজেয়াপ্ত করে বিজ্ঞ চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট স্যার বরাবর অভিযোগ দায়ের করলাম। নিরীহ পেয়ে ক্ষমতা দেখানো, মিথ্যা মামলা করা বা জাল দলিল উপস্থাপনের শাস্তি না দিলে এসব চলতেই থাকবে। তাই শুধু মামলা খারিজ করিনি। বিশ হাজার টাকা খরচ দিয়েছি৷ ফৌজদারি মামলার উদ্যোগ নিয়েছি।
রায়টা লেখার পর শান্তি লাগছে। আল্লাহর নিকট শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি। বিবাদীপক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবীকে অশেষ ধন্যবাদ। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখলাম আর বিড়বিড় করে বললাম “কাজী শরীফ তুমি দেখি কঠোর হতেও শিখে গেছো!”
কাজী শরীফ: সহকারী জজ, নোয়াখালী।