স্বকৃত গালিব: মূলত হিল্লা বিয়ে বলতে বোঝায় তালাক দেওয়ার পর তৃতীয় কোন ব্যক্তির কাছে একটি নিয়মের মাধ্যমে বিয়ে দেওয়ার পর ওই নারীকে পুনরায় আগের স্বামীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করা। এ সম্পর্কে মুসলিম আইনে যথাযথ বিধান থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। ২০০১ সালে হাইকোর্ট ডিভিশনের একটি বেঞ্চ থেকে ফতোয়াকে অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণা করা হয়।
হিল্লা বিয়ে সম্পর্কে এই রায়ে বলা হয়, হিল্লা বিয়ের ফতোয়া ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ধারা ৭ এবং বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৪৯৪, ৪৯৮, ৫০৮ ও ৫০৯ ধারা লঙ্ঘন করে।
বাংলাদেশের আইনে যেমন হিল্লা বিয়ে অবৈধ তেমনি ভাবে ইসলামেও হিল্লা বিয়ে অবৈধ। আমাদের নবী হিল্লাকারী ও যার জন্য হিল্লা করা হয়, উভয়ের ওপর অভিশাপ দিয়েছেন।
হাদিসের ভাষায়: হজরত ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ (সা.) হিল্লাকারী এবং যার জন্য হিল্লা করা হয়, উভয়কে লানত করেছেন। (জামে আত তিরমিজি, ২য় খণ্ড, হাদিস নং ১১২০)
অন্য হাদিসেও পাওয়া যায়, ‘রসুলুল্লাহ (সা.) হিল্লাকারী এবং যার জন্য হিল্লা করা হয়, উভয়কে লানত করেছেন।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, ২য় খণ্ড, হাদিস নং ১৯৩৫)।
ইসলামিক আইনে হিল্লা বিয়ে
আভিধানিক ভাবে হিল্লা বলতে উপায়, গতি, ব্যবস্থা, আশ্রয় ও অবলম্বন বিভিন্ন অর্থে ব্যবহূত হয়। কিন্তু প্রচলিত পরিভাষায় হিল্লা বলতে কোনো স্বামীর তিন তালাক প্রাপ্ত স্ত্রীকে এই শর্তে বিয়ে করা যে, বিয়ের পর সহবাস শেষে স্ত্রীকে তালাক দেবে, যেন সে আগের স্বামীর জন্য হালাল হয়, সে তাকে পুনরায় বিয়ে করতে পারে। একথা সবাই স্বীকার করবেন যে, অপরাধ হোক বা না হোক, সেটা করেছে স্বামী। অথচ হঠাৎ তালাক দিলে নিরপরাধ স্ত্রীর জীবন ধ্বংস হয়ে যায়। সে হারায় তার স্বামী, সংসার ও সন্তান। কিন্তু একজনের অপরাধে অন্যের শাস্তি হওয়া (হিল্লা বিয়ে) চরম অন্যায়। সে জন্যই কোরআনে চমৎকারভাবে বলা হয়েছে, ‘একে অপরের কৃতকর্মের জন্য দায়ী হবে না।’ (সুরা নজম: ৩৮)।
হিল্লা বিয়ে নবী করিম (সা.)-এর ওফাতের পর যখন মানুষ ধীরে ধীরে ধর্ম থেকে দূরে সরে আসে, ঠিক তখন থেকে মুসলিম সমাজে তালাকের প্রবণতা বেড়ে যায়। ফলে এর সমাধানের জন্য একশ্রেণির অল্পশিক্ষিত মৌলভী দ্বারা হিল্লা বিয়ের মতো কুপ্রথা সমাজে চালু হয়। আর এর জন্য কোরআনের আয়াতকে অপব্যবহার করা করে থাকে।‘‘তারপর যদি সে স্ত্রীকে তালাক দেয়, তবে সে স্ত্রী যে পর্যন্ত তাকে ছাড়া অপর কোনো স্বামীর সঙ্গে বিয়ে করে না নেবে, তার জন্য হালাল নয়। অতঃপর যদি দ্বিতীয় স্বামী তালাক দিয়ে দেয়, তাহলে তাদের উভয়ের জন্যই পরস্পরকে পুনরায় বিয়ে করাতে কোনো পাপ নেই, যদি আল্লাহর হুকুম বজায় রাখার ইচ্ছা থাকে। আর এই হলো আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সীমা; যারা উপলব্ধি করে তাদের জন্য এসব বর্ণনা করা হয়।‘’ (সুরা বাকারা, আয়াত নং ২৩০) ।
কিন্তু এ আয়াতের ব্যাখ্যা ওইসব নারীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যারা তালাকপ্রাপ্ত হওয়ার পর স্বেচ্ছায় দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ করে এবং পরবর্তী সময়ে আবার আগের স্বামীর কাছে ফিরে যেতে চায়।ওই অল্পশিক্ষিত মৌলভীরা উপরের আয়াতের দোহাই দিয়ে হিল্লা বিয়ে জায়েজ করতে চান। কিন্তু পরবর্তী ২৩২ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন,‘‘তোমরা যখন স্ত্রীদের তালাক দাও এবং তারা তাদের ইদ্দতকাল পূর্ণ করে তবে স্ত্রীরা নিজেদের স্বামীদের পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে বিয়ে করতে চাইলে তাদের বাধা দিও না। এ উপদেশ তাকেই দেওয়া হচ্ছে, যে আল্লাহ ও কেয়ামত দিনের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করেছে। এর মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে একান্ত পরিশুদ্ধতা ও অনেক পবিত্রতা। আর যা আল্লাহ জানেন, তোমরা জানো না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত নং ২৩২)।
উল্লেখিত দুটি আয়াতে বিরোধপূর্ণ ভাব দেখা যাচ্ছে; কিন্তু বাস্তবে তা নয়। এ দুটি আয়াত বোঝার জন্য এখন হাদিস শরিফ লক্ষ করলে দেখা যায় নবীজি (সা.) কী করেছেন। হজরত মা’কাল বিন ইয়াসার (রা.) বলেন, ‘আমার কাছে আমার বোনের বিয়ের প্রস্তাব এলে আমি তার বিয়ে দিই। তার স্বামী কিছুদিন পর তাকে তালাক দেয়। ইদ্দত অতিক্রান্ত হওয়ার পর পুনরায় সে আমার কাছে বিয়ের প্রস্তাব করে। আমি তা প্রত্যাখ্যান করি। আমি শপথ করি যে, তার সঙ্গে আমার বোনের বিয়ে দেব না। তখন সুরা বাকারার ২৩২ নং আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। এটা শুনে হজরত মা’কাল (রা) বলেন, শপথ করা সত্ত্বেও আমি আল্লাহর নির্দেশ শুনেছি এবং মেনে নিয়েছি। অতঃপর তিনি তার বোনকে ডেকে পাঠিয়ে পুনরায় তার (আগের স্বামী) সঙ্গে তার বোনের বিয়ে দিয়ে দেন এবং নিজের কসমের কাফ্ফারা আদায় করেন। তার বোনের নাম ছিল জামিল বিনতে ইয়াসার (রা.) এবং তার স্বামীর নাম ছিল আবুল বাদাহ (রা)।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির, সহিহ বুখারি শরিফ, ৭ম খণ্ড, হাদিস নং ৪১৭৩)।
এ ছাড়া হিল্লা নাজায়েজ বলে আরেকটি হাদিস উল্লেখ করা যায়। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) ও ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘নবী করিম (সা.) হজরত হাফসা (রা.)-কে তালাক দেন। এরপর তিনি তাকে পুনরায় স্বীয় স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন।’ (আবু দাউদ, ৩য় খণ্ড, হাদিস নং ২২৭৭ এবং সুনানে নাসাঈ, ৩য় খণ্ড, হাদিস নং ৩৫৬১) হিল্লা বিয়ের কোনো অস্তিত্বই নেই এবং তা হারাম, নাজায়েজ ও লজ্জাজনক কাজ বলেই উপরের বর্ণনায় পাওয়া যায়। তাই হিল্লা বিয়ে ছাড়াই তালাকের পর পুনরায় স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনতে নতুন করে দেনমোহর ধার্য করে বিয়ে করা আবশ্যক। নতুবা স্বামী-স্ত্রী হিসেবে উভয়ের বসবাস জায়েজ হবে না।
বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে হিল্লা বিয়ে
১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ধারা ৭-এ বলা আছে, কোনো লোক যদি তাঁর স্ত্রীকে তালাক দিতে চান, তাহলে স্থানীয় চেয়ারম্যানের কাছে যত শিগগির সম্ভব লিখিত নোটিশ প্রদান করতে হবে এবং এর একটি কপি স্ত্রীকে দিতে হবে।নইলে তালাক কার্যকর হবে না।সুতরাং এখানে মৌখিক তালাকের অকার্যকরতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এ ধারায় বলা হয়েছে, নোটিশ জারি হওয়ার পর ৯০ দিন অতিবাহিত না হলে তালাক কার্যকর হবে না।
পূর্ণভাবে তালাক কার্যকর হওয়ার পর স্ত্রী যদি স্বামীর কাছে ফিরে যেতে চান,তবে কাবিনের মাধ্যমে যথাযথ আইনগত পদ্ধতিতে পুনরায় বিয়ে করলেই যথেষ্ট হবে।এক্ষেত্রে তৃতীয় ব্যক্তির সঙ্গে সাময়িক বিয়ের প্রয়োজন নেই এবং তা তিন বার পর্যন্ত প্রযোজ্য হবে। তবে ১৯৬১ সালের অধ্যাদেশে হিল্লা বিয়ের কিছু সংশোধিত বিধি লিপিবদ্ধ আছে। দম্পতির মধ্যে পূর্ণাঙ্গ তালাক হয়ে যাওয়ার পর যদি উভয় পক্ষ মনে করেন তাঁরা পূর্বাবস্থা ফিরতে ইচ্ছুক, তবে বিয়ের কাবিন মোতাবেক তৃতীয় বার পর্যন্ত পুনর্বিবাহ করা যায়। কিন্তু তৃতীয়বারের পরে হিল্লা বিয়ের প্রয়োজন হবে।ধারা ৭ উপধারা ৬ অত্র ধারা অনুযায়ী তালাক দ্বারা যে স্ত্রীর বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটেছে সেই স্ত্রী, এই জাতীয় তালাক তিনবার এইভাবে কার্যকরী না হলে, কোন তৃতীয় ব্যক্তিকে বিবাহ না করে পুনরায় একই স্বামীকে বিবাহ করতে পারবে। ১৯৬১ সালের এই আইনের কিছু বিধান নিয়ে মতভেদও রয়েছে। কিন্তু এই আইনের ৩ ধারায় বলা আছে, এ আইন দেশে বলবৎ অন্য যে কোনো আইন,বিধি অথবা প্রথা থেকে প্রাধান্য পাবে।
মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ ১৯৬১ তেই হিল্লা বিয়েকে শুধু বেআইনি বলা হয়নি বাংলাদেশের প্রচলিত দন্ডবিধি ১৮৬০ সালের আইনেও হিল্লা বিয়েকে অপরাধ হিসেবে দেখা হয়েছে।দন্ডবিধির ৪৯৪ ধারায় বলা আছে,স্বামী বা স্ত্রী জীবদ্দশায় যদি পুনরায় বিবাহ করে তাহলে সে বিবাহ অবৈধ হবে।এবং এই অপরাধের জন্য সাত বছর জেল জরিমানা হতে পারে।৪৯৮ ধারায় বলা হয়েছে,কোন ব্যক্তি জানে যে নারী বিবাহিত এবং তা জানা সত্তে¡ও বিবাহিত নারীকে অপরাধমূলক উদ্দেশ্যে প্রলুদ্ধ করা বা অপহরণ বা আটক করে তাহলে তার দুই বছর জেল ও জরিমানা হতে পারে।৫০৮ ধারায় বলা আছে কোন ব্যক্তিকে বিধাতার রোষভাজন হবে এইরুপ বিশ্বাস করিয়ে কোন কাজ সম্পাদন করায় তাহলে এক বছর পর্যন্ত জেল জরিমানা হতে পারে।৫০৯ ধারায় বলা হয়েছে,কোন নারীর শীলতাহানির উদ্দেশ্যে কথা,অঙ্গভঙ্গি বা কোন কাজ করে তবে তার এক বছর পর্যন্ত জেল জরিমানা হতে পারে।
আমাদের সমাজে তিন তালাকের ব্যাপক অপব্যবহার হচ্ছে। এদেশে অধিকাংশ তালাকদাতা একসঙ্গে তিন তালাক দেন। কিন্তু তালাক দেওয়ার পর উদ্ভূত পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল হওয়ায় তারা পুনরায় বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হতে চান। তাই সমাজে ইসলামবহির্ভূত হিল্লা বিয়ের মাধ্যমে আগের স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনার প্রচলনও দেখা যায়। এই হিল্লা বিয়ে শুধু বাংলাদেশ, পাকিস্তান আর ভারতে নয়, পৃথিবীর সব মুসলিম অধ্যুষিত দেশেই কম-বেশি প্রচলিত আছে। হিল্লা এমন একটি লজ্জাজনক কাজ, যা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। তারপরও হাদিস শরিফে বিশ্বনবী (সা.) বিশ্ববাসীকে সামান্য উপমা দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন। হাদিসের ভাষায় : উকবা ইবনে আমের (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আমি কি তোমাদের ভাড়া করা পাঁঠা সম্পর্কে বলব? তারা (সাহাবায়ে কেরাম (রা.) বললেন, অবশ্যই হে আল্লাহর রসুল (সা.)! তিনি বললেন, হিল্লাকারী। অতঃপর রসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, আল্লাহ হিল্লাকারী ও যার জন্য হিল্লা করা হয়, উভয়কে অভিসম্পাত করেছেন।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, ২য় খণ্ড, হাদিস নং ১৯৩৬)। ইসলামিক আইন ও বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে হিল্লা বিয়েকে একটি জঘন্ন অপরাধ হিসেবে দেখা হয়েছে।আর এই পাপ থেকে নিজে ও দেশের ধর্মভিরু মানুষকে সচেতন করা সকলের নৈতিক দায়িত্ব।
স্বকৃত গালিব: শিক্ষার্থী; আইন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।