সিরাজ প্রামাণিক: আমাদের দেশে লক্ষ লক্ষ রেকর্ড সংশোধনের মোকদ্দমা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের অসহযোগিতা, আদালতে দীর্ঘসূত্রতা সেই সাথে প্রয়োজনীয় বিচারিক কর্তৃপক্ষের অভাবে এ মামলায় সাধারণ মানুষের ভোগান্তির যেন শেষ নেই। সিএস, আরএস, এসএ বা বিএস খতিয়ান আমাদের দেশে রয়েছে।
এসব খতিয়ানে বিশেষ করে শেষেরটিতে প্রচুর পরিমাণ ভুল রয়ে গেছে। একজনের জমি আরেকজনের নামে রেকর্ড হয়ে গেছে, জমির পরিমাণ ভুল উল্লেখ করা হয়েছে কিংবা জমির দাগ ভুলভাবে রেকর্ড করা হয়েছে। খতিয়ানে ভুল থাকার কারণে জমি কেনা-বেচার সময় নানারকম জটিলতা দেখা দিচ্ছে। এসব জটিলতা নিরসনে সরকার ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালসহ নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও পদে পদে রয়েছে নানা রকম বিড়ম্বনা। এবার খতিয়ানগুলো সম্পর্কে জেনে নিই।
সি. এস. খতিয়ান
১৮৮৮ সাল থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকারের তত্বাবধানে বাংলায় একটি ভূমি জরিপ হয় যাকে সি.এস. জরিপ বলে। কক্সবাজারের রামু থানা থেকে শুরু হয়ে দিনাজপুরে এ জরিপ শেষ হয়। প্রথম হলেও এ জরিপকে নির্ভুল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই জরিপের মাধ্যমে তৈরি নকশাকে সি. এস. নকশা এবং খতিয়ানকে সি. এস. খতিয়ান বলা হয়। সি. এস. খতিয়ান বাংলাদেশে প্রচলিত খতিয়ানসমূহের মধ্যে প্রথম। অধিকাংশ সময় মামলা-মোকদ্দমায় কিংবা বিবাদ মিমাংসার ক্ষেত্রে এ খতিয়ানকে ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়। সি.এস. শব্দের পূর্ণ রুপ হচ্ছে ক্যাডাষ্টারাল সার্ভে যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় তফসিলভুক্ত জরিপ।
এস. এ. খতিয়ান
রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহন ও প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫০ এর মাধ্যমে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ হবার পর জমিদারদের নিকট থেকে অধিগ্রহনকৃত জমির হিসাব নির্ণয়, বিলুপ্ত জমিদারীর ক্ষতিপূরন প্রদান, জমির দখলদার রায়তদের জমির মালিক হিসেবে সরকারের অধীনে আনয়ন ও মালিকানার স্বীকৃতি প্রদান প্রভৃতি কারনে ভুমি জরিপের প্রয়োজন দেখা দেয়। সি. এস. রেকর্ড সংশোধনের লক্ষে জমিদারদের নিকট থেকে কাগজপত্র সংগ্রহের পর ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৩ এর মধ্যে একটি সংক্ষিপ্ত জরিপের মাধ্যমে যে রেকর্ড প্রস্তুত হয়, তাকে এস. এ. জরিপ বা এস. এ. খতিয়ান বলে। সংক্ষিপ্ত সময়ে জমিদারদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এ জরিপের মাধ্যমে খতিয়ান প্রস্তুত হয় বলে এতে প্রচুর ভুল-ভ্রান্তি পরিলক্ষিত হয়। রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহন ও প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫০ এর ফলে মধ্যস্বত্ব প্রথার বিলোপ হয় এবং পরিবার প্রতি ভূমির সর্বোচ্চ সীমা ৩৭৫ বিঘা নির্ধারিত হয়। এস. এ. শব্দের পূর্ণ রুপ হচ্ছে ষ্ট্রেট এ্যাকুইজিসন যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ।
আর. এস. খতিয়ান
রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহন ও প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫০ এর পরবর্তী প্রস্তুতকৃত এস.এ. খতিয়ানে প্রচুর ভুল-ভ্রান্তি পরিলক্ষিত হয় বিধায় তা সংশোধনের লক্ষে সরকার একটি কমিটি গঠন করে। এই কমিটির সুপারিশের ভিত্তেতে তৎকালিন সরকার ১৯৬৩ সাল থেকে যে সংশোধনী জরিপ পরিচালনার মাধ্যমে খতিয়ান প্রস্তুত করে, তাই আর, এস, খতিয়ান নামে পরিচিত। ইতোমধ্যে দেশের অধিকাংশ এলাকায় এ জরিপ শেষ হয়েছে এবং কিছু এলাকায় এখনো চলছে। এখানে উল্লেখ্য যে, বি. এস. খতিয়ান, বি.আর.এস খতিয়ান সিটি খতিয়ান মূলতঃ আর. এস. খতিয়ান এর অন্তর্ভুক্ত। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশ আমলে জরিপ শুরুর পর এর মাধ্যমে প্রস্তুতকৃত আর. এস. খতিয়ান অনেক অঞ্চলে বি. এস. খতিয়ান নামে পরিচিত এবং কোন কোন সিটি কর্পোরেশন এলাকায় সিটি খতিয়ান নামে পরিচিত। আর. এস. শব্দের পূর্ণ রুপ হচ্ছে রিভিশনাল সার্ভে যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় সংশোধিত জরিপ। বিএস বলতে বোঝায় বাংলাদেশ সার্ভে এবং বিআরএস বলতে বোঝায় বাংলাদেশ রিভিশনাল সার্ভে।
রেকর্ডে ভুল সংশোধনের উপায় ও সীমাবদ্ধতা
চূড়ান্তভাবে রেকর্ড প্রকাশ হওয়ার পর সেটি সংশোধনে ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালের শরণাপন্ন হতে হয়। স্টেট অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড টেনান্সি অ্যাক্ট-১৯৫০’র ১৪৫(এ) ধারা অনুযায়ী ২০১২ সালে ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করে। এসব ট্রাইব্যুনালের বিচার কাজ পরিচালনা করেন যুগ্ম-জেলা জজ পদমর্যাদার একজন বিচারক। কিন্তু ট্রাইব্যুন্যালেও রয়েছে জটিলতা। সব জেলাতে এ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়নি। আবার কোথাও অতিরিক্ত বিচারক দিয়ে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আবার রেকর্ড সংশোধনের মামলা করে আদালত থেকে কোনো ব্যক্তি ডিক্রি পেলে সেই মোতাবেক রাজস্ব কর্মকর্তা রেকর্ড সংশোধনের উদ্যোগ নেবেন এটাই আইন। আদালতের রায় বা ডিক্রিমূলে নামজারি করতে গেলে আবেদনকারীর স্বত্ব সম্পর্কিত কোনো প্রশ্ন বা আপত্তি রাজস্ব কর্মকর্তা করতে পারেন না। কারণ রাজস্ব কর্মকর্তা বা এসিল্যান্ড এর কোনো বিচারিক ক্ষমতা নেই। তিনি জমির স্বত্ব নির্ধারণ করতে পারেন না। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, ডিক্রি পাওয়ার পরও দখল ও স্বত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে রাজস্ব কর্মকর্তা আবেদনকারীকে হয়রানি করেন ও উৎকোচ প্রদানে বাধ্য করেন। আবার আপিল ট্রাইব্যুনাল না থাকায় বিচারুপ্রার্থীরা ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালের কোনো রায়ে সংক্ষুব্ধ হলে আপিল করতে পারছেন না। আপিলের পরিবর্তে হাইকোর্টে রিট মামলার মাধ্যমে প্রতিকার চাইতে হচ্ছে।
তবে চূড়ান্তভাবে প্রকাশিত রেকর্ড সংশোধনের বিষয়ে তিন ধরনের কর্তৃপক্ষ তিন ধরনের আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণে আইনত ক্ষমতাবান। প্রথমত, সংশ্লিষ্ট রাজস্ব কর্মকর্তা বা সহকারী কমিশনার (ভূমি) স্টেট অ্যাকুইজেশন অ্যান্ড টেনান্সি অ্যাক্ট ১৯৫০’র ১৪৩ ধারামতে এবং প্রজাস্বত্ব বিধিমালা ১৯৫৫-এর বিধি ২৩(৩) অনুযায়ী চূড়ান্তভাবে প্রকাশিত রেকর্ডের করণিক ভুল (ক্ল্যারিকাল মিসটেকস) যেমন- নামের ভুল, অংশ বসানোর হিসেবে ভুল, দাগসূচিতে ভুল, ম্যাপের সঙ্গে রেকর্ডের ভুল ইত্যাদি নিজেই সংশোধন করতে পারেন। দ্বিতীয়ত, স্টেট অ্যাকুইজেশন অ্যান্ড টেনান্সি অ্যাক্ট ১৯৫০’র ১৪৯(৪) ধারামতে ভূমি প্রশাসন বোর্ড বোনাফাইড মিসটেক যেমন- জরিপকালে পিতার মৃত্যুর কারণে সন্তানদের নামে সম্পত্তি রেকর্ড হওয়ার কথা থাকলেও জরিপকারকদের ভুলে তা হয়নি- এমন ভুল সংশোধন করতে পারেন। আবার ভূমি আপিল বোর্ডেরও এ ধরনের ভুল সংশোধনের ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এগুলোর কোনো প্রয়োগ নেই। ভুক্তভোগীরা এসব জায়গার প্রতিকার চাইতে গেলে তাদের ট্রাইব্যুনালে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
খাসজমি হিসেবে রেকর্ড হলে ভোগান্তির শেষ নেই
ভুলক্রমে কোনো ব্যক্তির জমি ১ নাম্বার খাস খতিয়ানে (গ্রামের ভাষায় ডিসি’র নামে) অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেলে অর্থাৎ সরকারি খাস জমি হয়ে গেলে তাকে আদালতের মাধ্যমেই নাম সংশোধন করতে হয়। এতে ডিক্রিপ্রাপ্ত ব্যক্তি অহেতুক লাঞ্ছনা ও হয়রানির শিকার হয়। আদালত ও প্রশাসনের কাজের দীর্ঘসূত্রতার কারণে বছরের পর বছর মূল মালিক তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হন। আদালতের রায় মানা সরকারের জন্য বাধ্যতামূলক হলেও এডিসি (রেভিনিউ) অনুমোদনের জন্য অহেতুক সময়ক্ষেপণ করেন। অথচ এ বিষয়ে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের একটি সিদ্ধান্ত রয়েছে যে দেওয়ানি আদালতের রায় সরকার মানতে বাধ্য, যদি না তা উপযুক্ত আদালত দ্বারা বাতিল হয়। (৪৫ ডিএলআর-৫)।
আদালতে ভুক্তভোগী পক্ষ থেকে মামলা দায়েরের পর অনেক সময় সমন পাওয়ার পরও সরকারের পক্ষ থেকে ( জেলা প্রশাসনের পক্ষে) কেউ আদালতে হাজির হয় না। ফলে সরকারের বিপক্ষে একতরফা ডিক্রি হয়ে যায়। কিন্তু সরকারের বিপক্ষে একতরফা ডিক্রি গ্রহণযোগ্য নয় বলে এডিসি (রেভিনিউ) নামজারি প্রক্রিয়া বন্ধ রেখে আপিল দায়ের করেন। যেসব কর্মকর্তার গাফিলতির কারণে একতরফা ডিক্রি হয়, তাদের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা তো নেয়াই হয় না বরং ডিক্রি প্রাপ্ত ব্যক্তিকে মামলার ডিক্রির ফলভোগ হতে বিরত রাখা হয়।
জরিপ চলাকালীন ভুল ধরা পরলে
জরিপ চলাকালীন সময়ে খতিয়ানে কোন ভুল ধরা পরলে তখন সেটেলমেন্ট অফিসারের নিকট ৩০ ধারা / ৩১ ধারায় আপিল করে খুব সহজেই ভুলগুলো সংশোধন করে নেওয়া যায়। কিন্তু যদি এই সময়ের মধ্যে ভুলগুলো সংশোধন করা না হয় এবং চূড়ান্ত খতিয়ান প্রকাশিত হয়ে যায়, তবে উক্ত খতিয়ান সংশোধনের ক্ষমতা আর সেটেলমেন্ট অফিসারের থাকে না তখন এই খতিয়ান সংশোধন করতে হয় কোর্টে মামলা করে। তবে চূড়ান্ত রেকর্ড প্রকাশিত হয়ে গেলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে সেটেলমেন্ট অফিসার রেকর্ড সংশোধন করতে পারে, যেমন উক্ত ভুলগুলো যদি হয় শুধুমাত্র কারণিক ভুল/ প্রিন্টিং -এ ভুল সেক্ষেত্রে এ ধরনের সামান্য ভুলগুলো অবশ্য সেটেলমেন্ট অফিসার সংশোধন করতে পারে। খতিয়ান বা খসড়া খতিয়ানে কোন ভুল-ত্রুটি থাকলে বা এ সম্পর্কে কারও কোন আপত্তি বা দাবি থাকলে, প্রজাস্বত্ব বিধি ৩০ অনুযায়ী আপত্তি দাখিল করতে হবে। অত্র আপত্তি দাখিল করতে হবে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত ফরমে ৪০ টাকার কোর্ট ফি দিয়ে। অফিসার প্রয়োজন মনে করলে খতিয়ান ও নকশা সংশোধন, পরিবর্তন বা পূর্বাবস্থায় বহাল রাখার বিষয়ে রায় প্রদান করবেন এবং অবশ্যই রায় মোতাবেক রেকর্ড সংশোধন করবেন। আপত্তি কেসের রায়ে যদি কেউ অসন্তুষ্ট হয় তবে সেই প্রেক্ষিতে তিনি প্রজাস্বত্ব বিধিমালার ৩১ বিধি অনুসারে রায় প্রদানের ৩০ দিনের মধ্যে নির্ধারিত ফরমে ও নির্ধারিত ফি প্রদান করে সেটেলমেন্ট অফিসারের নিকট আপিল করতে পারেন। আপীল আবেদনের সাথে আপত্তি কেসের রায়ের কপি দাখিল করতে হবে। সেটেলমেন্ট অফিসার বা তার মনোনীত অন্যকোন আপিল অফিসার সংশ্লিষ্ট পক্ষগণকে নোটিশ প্রদান করে শুনানীর মাধ্যমে দ্রæত আপিল নিষ্পত্তি করবেন। সর্বশেষ আপিল রায় মোতাবেক খতিয়ান ও নকশা সংশোধন করা হয়।
খতিয়ান সংশোধন করতে যা দরকার
উক্ত জমিতে আপনার মালিকানার সকল দলিল পত্র (যেমন-মূল দলিল, বায়া দলিল, পূর্বের খতিয়ানের কপি)। চূড়ান্তভাবে প্রকাশিত ভুল রেকর্ডের কপি। নিজের আইডি কার্ডের ফটো কপি। প্রয়োজনীয় সকল কাগজপত্র নিয়ে এখতিয়ারধীন কোর্টে গিয়ে একজন দক্ষ সিভিল লইয়ার কে উক্ত খতিয়ানটি সংশোধানের দায়িত্ব দিতে হবে। তিনি এক্ষেত্রে ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালে কিংবা দেওয়ানী আদালতে রেকর্ড সংশোধনীর জন্য একটি “ঘোষণামূলক” মোকদ্দমা করবেন। খতিয়ান সংশোধন না করলে জমির নামজারি করা যাবে না, আর মিউটেশন না করতে পারলে জমি বিক্রয় করা যাবে না।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email: seraj.pramanik@gmail.com