যেসব মহাসড়ক চার লেনে এবং এক্সপ্রেসওয়েতে উন্নীত হয়েছে, সেগুলোতে চলাচলকারী যানবাহন থেকে টোল আদায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। কত হারে, কীভাবে টোল নেওয়া হবে- তা নির্ধারণে কাজ করছে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর। এরই মধ্যে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের খসড়া টোলহার নির্ধারণ করা হয়েছে।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, দুই পাশে ধীরগতির লেনসহ নির্মাণাধীন জয়দেবপুর-চন্দ্রা-এলেঙ্গা (সাসেক-১) এবং এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর (সাসেক-২) মহাসড়ক ছয় লেনে উন্নীত হওয়ার পর টোল নেওয়া হবে। ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে একই সুবিধা চালুর পর চলাচলকারী যানবাহনকে টোল দিতে হবে।
সড়ক রক্ষণাবেক্ষণের খরচ জোগাতেই সরকার টোল নিতে চায় বলে জানিয়েছেন সংশ্নিষ্টরা। তবে মহাসড়কের পাশে ধীরগতির লেনে টোল ছাড়া গাড়ি চালানোর সুযোগ থাকবে।
সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে (পিপিপি) নির্মাণাধীন প্রবেশ নিয়ন্ত্রিত ছয় লেনের ভোগড়া-ধীরাশ্রম-পূর্বাচল-ভুলতা-মদনপুর (ঢাকা বাইপাস) এবং রামপুরা-আমুলিয়া-ডেমরা মহাসড়কেও টোল দিতে হবে। এরই মধ্যে ঢাকা বাইপাসের টোলহার অনুমোদন করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এক্সপ্রেসওয়ে, মহাসড়কে টোল নেওয়া হয়। দেশে বিভিন্ন সেতু ছাড়াও চট্টগ্রাম বন্দর সড়ক, চলনবিল মহাসড়ক এবং ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের একাংশে টোল নেওয়া হচ্ছে। চার লেনে উন্নীত মহাসড়ক এবং ছয় লেনের এক্সপ্রেসওয়েতে টোল নিতে গত আগস্টে একনেক সভায় নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, টোলের ভালো-খারাপ দুই দিকই রয়েছে। কিন্তু সড়কের রক্ষণাবেক্ষণের স্বার্থে টোল নিতেই হবে। পরিবহন মালিকরা অবশ্য প্রকাশ্যে বিরোধিতা না করলেও টোলের পক্ষে কথা বলছেন না।
দুই পাশে ধীরগতির লেনসহ ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে পদ্মা সেতু হয়ে দক্ষিণবঙ্গকে রাজধানীর সঙ্গে যুক্ত করবে। ৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ মহাসড়কে ঢাকা বাইপাসের জন্য অনুমোদিত হার অনুযায়ী টোল নির্ধারণ করা হবে বলে জানিয়েছেন সওজ’র ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা।
দেশের প্রথম এই এক্সপ্রেসওয়েতে টোল নির্ধারণে গঠিত কমিটি ‘টোল নীতিমালা-২০১৪’ অনুযায়ী ‘ভিত্তিহার’ পদ্ধতিতে টোল আদায়ের প্রস্তাব করেছিল। এ পদ্ধতিতে কোথাও অল্প দূরত্বে বেশি টাকা, আবার কোথাও বেশি দূরত্বে কম টাকা টোল দিতে হবে বিধায় প্রস্তাবটি বাতিল করা হয়।
ওই কমিটির প্রধান সওজ’র তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (রক্ষণাবেক্ষণ সার্কেল) মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ বলেন, নীতিমালা অনুযায়ী ‘ভিত্তিহার’ পদ্ধতিতে টোল নির্ধারণের মতামত বাদ দিয়ে কিলোমিটার হিসেবে টোল নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে অংশীজনদের মতামত এবং সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী টোলহার চূড়ান্ত করা হবে।
কমিটি সূত্র জানিয়েছে, ঢাকা বাইপাসে প্রতি কিলোমিটারে পণ্যবাহী ট্রেইলারে (তিন এক্সেলের বেশি) ৩৩ টাকা ১০ পয়সা, বড় ট্রাকে ২৬ টাকা ৫০ পয়সা, মাঝারি ট্রাকে ১৬ টাকা ৫০ পয়সা, বড় বাসে (৩১ আসনের বেশি) ১৪ টাকা ৪০ পয়সা, মিনিবাসে ৭ টাকা ৪০ পয়সা, মাইক্রোবাসে ৬ টাকা ৬০ পয়সা, প্রাইভেট কারে ৫ টাকা ৮০ পয়সা টোল দিতে হবে।
এ হিসাবে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর দোলাইপাড় থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত ৫৫ কিলোমিটার পথে ট্রেইলারকে টোল দিতে হবে এক হাজার ৮২০ টাকা। বড় ট্রাকে এক হাজার ৪৫৮ টাকা, বড় বাসে ৬৮২ টাকা টোল দিতে হবে। বাসের টোলের টাকা যাত্রীদের ভাড়ার সঙ্গে আদায় করা হবে। প্রাইভেটকারে দিতে হবে ৩২০ টাকা।
ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েতে পাঁচটি ফ্লাইওভার রয়েছে। ফ্লাইওভার ব্যবহারের জন্য বাড়তি মাশুল ধরলে টোল আরও বাড়বে। পোস্তগোলা ও ধলেশ্বরী সেতুর টোল সমন্বয় করলে এ অঙ্ক বেড়ে যাবে। মাঝে পদ্মা সেতুতে আলাদা টোল দিতে হবে। সেই টোলহার এখনও চূড়ান্ত হয়নি।
ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে অযান্ত্রিক যান, তিন চাকার যানবাহন এবং কৃষি যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ। এসব যানবাহন দুই পাশের ধীরগতির লেনে চলাচল করবে।
সওজের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (ঢাকা জোন) সবুজ উদ্দিন খান টোলহার নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে তিনি জানিয়েছেন, ঢাকা-মাওয়ায় টোল আদায় শুরুর পর পোস্তগোলা সেতু, ধলেশ্বরী সেতুতে আর টোল দিতে হবে না এক্সপ্রেসওয়ের গাড়িকে। তবে ধীরগতির লেনের গাড়িকে সেতু পারাপারের জন্য আগের মতোই টোল দিতে হবে।
কোনো গাড়ি এক্সপ্রেসওয়ের ‘এন্ট্রি পয়েন্ট’ দিয়ে প্রবেশ করে ‘এক্সিট পয়েন্ট’ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার মাঝখানে যত কিলোমিটার পথ চলবে, ঠিক তত দূরত্বের জন্যই টোল দিতে হবে বলেও জানান সওজের ঢাকা জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী।
ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে চারটি ‘এন্ট্রি’ এবং চারটি ‘এক্সিট পয়েন্ট’ নির্ধারণ করেছে টোলহার নির্ধারণ কমিটি। ঢাকা থেকে মাওয়ামুখী যানবাহন রাজধানীর দোলাইপাড় দিয়ে প্রবেশ করে চারটি স্থানে টোল দিয়ে এক্সপ্রেসওয়ে থেকে বেরিয়ে যেতে পারবে।
এগুলো হলো- কেরানীগঞ্জের আবদুল্লাহপুর, ধলেশ্বরী, মালিগ্রাম এবং আড়িয়াল খাঁ। ঢাকামুখী গাড়ি ভাঙ্গা ইন্টারচেঞ্জ থেকে প্রবেশ করে আড়িয়াল খাঁ, শ্রীনগর, ধলেশ্বরী এবং আবদুল্লাহপুরে টোল দিয়ে এক্সপ্রেসওয়ে থেকে বেরিয়ে যেতে পারবে। এসব এক্সিট পয়েন্ট দিয়ে এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ি প্রবেশেরও সুযোগ থাকবে। নির্ধারিত স্থান ছাড়া এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ি প্রবেশ ও বহির্গমনের সুযোগ থাকবে না।
সচিব নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের গত নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসের সমন্বয় সভায় টোল নির্ধারণ নিয়ে আলোচনা হয়। ১০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সভাসূত্র জানিয়েছে, সওজ’র প্রধান প্রকৌশলী কাজী শাহারিয়ার হোসেন সভায় জানান, ঢাকা-ময়মনসিংহ এবং জয়দেবপুর-চন্দ্রা-এলেঙ্গা মহাসড়কে টোল আদায়ের কার্যক্রম চালুর বিষয়টি আরও পর্যালোচনা করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। মহাসড়ক ও সেতুর টোল সমন্বয় করারও সিদ্ধান্ত হয় সভায়।
আগের মাসের সভায় সিদ্ধান্ত হয়, প্রকল্প সমাপ্তের পর সাসেক-১ এবং সাসেক-২ মহাসড়কে টোল আদায় হবে। এছাড়া গাবতলী-নবীনগর মহাসড়ককে এক্সপ্রেসওয়েতে উন্নীত করার পর টোল আদায় করা হবে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, অবশ্যই টোল নেওয়া উচিত। টোলের ভালো দিক হলো, শুধু ব্যবহারকারীকেই টাকা গুনতে হয়। অন্যদের করের টাকা সড়কের ব্যয় ও রক্ষণাবেক্ষণে ঢালতে হয় না। সরকারের উচিত টোল থেকে পাওয়া টাকায় সড়ক নির্মাণের ব্যয় মেটানোর পাশাপাশি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পৃথক তহবিল করা, যা দিয়ে নিয়মিত মেরামত করে নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেছেন, টোলের হার নির্ধারণে তাকেসহ পরিবহন নেতাদের বৈঠকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। সওজ’র প্রস্তাব জানার পর তিনি টোল নিয়ে মন্তব্য করবেন।
একই কথা বলেছেন পণ্যবাহী যানবাহনের মালিক সংগঠনের সভাপতি রুস্তম আলী। তিনি মন্তব্য করেন, যে অবস্থা করা হচ্ছে তাতে তো গাড়ি ঘর থেকে বের হলেই টোল দিতে হবে। সূত্র- সমকাল