উপজেলা পরিষদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন ও আর্থিক শৃঙ্খলা আনয়নসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের (ইউএনও) সাচিবিক দায়িত্বপালনের বিধান সম্বলিত উপজেলা পরিষদ আইনের ৩৩ ধারা কেন বেআইনি ও অবৈধ ঘোষণা করা হবে তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট।
এ সংক্রান্ত রিটের শুনানি নিয়ে বুধবার (৬ ডিসেম্বর) হাইকোর্টের বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মহিউদ্দিন শামীমের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ রুল জারি করেন।
এছাড়া, বিভিন্ন আমন্ত্রণপত্রে উপজেলা পরিষদ না লিখে উপজেলা প্রশাসন লেখার সিদ্ধান্ত কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না তাও জানতে চাওয়া হয়েছে।
একইসঙ্গে জনগণের ভোটে নির্বাচিত উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের বাদ দিয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসাররা (ইউএনও) কীভাবে উপজেলা পরিষদের বিভিন্ন স্থায়ী কমিটির সভাপতি হন তাও জানতে চাওয়া হয়।
উপজেলার বিভিন্ন কমিটিতে ইউএনওকে সভাপতি এবং উপজেলা চেয়ারম্যানকে উপদেষ্টা করা সংক্রান্ত পরিপত্র কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না তাও জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট।
আগামী ১০ দিনের মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, স্থানীয় সরকার সচিব, আইন সচিবসহ সংশ্লিষ্ট ১৬ জনকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
আদালতে এদিন রিটকারী সংগঠন বাংলাদেশ উপজেলা পরিষদ অ্যাসোসিয়েশনের নেতৃবৃন্দের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট হাসাম এমএস আজিম। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষের শুনানিতে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার নওরোজ মো. রাসেল।
রিটকারী পক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার হাসান এম এস আজিম সাংবাদিকদের বলেন, মাঠ প্রশাসন কোনো চিঠিপত্র লিখলে বা অনুষ্ঠান করলে দাওয়াতপত্র বা ব্যানারে উপজেলা পরিষদ না লিখে উপজেলা প্রশাসন লিখছে। এর মাধ্যমে ইউএনওরা স্থানীয় সরকারের ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন।
ব্যারিস্টার হাসান বলেন, এছাড়া, সরকারি কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে যতগুলো কমিটি গঠন করা হয় তার সবগুলোতে ইউএনওকে চেয়ারম্যান করা হয় এবং উপজেলা চেয়ারম্যানদের করা হয় উপদেষ্টা।
আবার স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় উল্লেখ থাকে ইউএনও ইচ্ছে করলেই আরও সদস্য অন্তর্ভুক্ত করতে পারবেন। এর মধ্য দিয়ে উপজেলা পরিষদের কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণকে প্রায় নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়। এমনি অনেক ক্ষেত্রে আয়-ব্যয়ের হিসাবও তাদেরকে দেয়া হয় না। যা সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক ও স্থানীয় সরকার পদ্ধতির চেতনার পরিপন্থী বলেও জানান রিটকারী পক্ষের আইনজীবী।
উপজেলা পরিষদ আইনের ৩৩ (১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হবেন এবং তিনি পরিষদকে সাচিবিক সহায়তা প্রদান করবেন।’ ৩৩ এর (২) উপধারায় বলা হয়েছে, ‘পরিষদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন, আর্থিক শৃঙ্খলা প্রতিপালন এবং বিধি দ্বারা নির্ধারিত অন্যান্য কার্যাবলী পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা সম্পাদন করবেন।’ কিন্তু তা সঠিক ভাবে হচ্ছে না।
তাই এই ৩৩ ধারাসহ একটি পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের সংগঠনের সভাপতি পটুয়াখালীর দুমকি উপজেলা চেয়ারম্যান হারুন-অর-রশিদ ও সাধারণ সম্পাদক উপজেলা চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম খান বীরু, উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট রিনা পারভীন, ভাইস চেয়ারম্যান সেলিম আহম্মেদ ও ভাইস চেয়ারম্যান রাশেদা আক্তার।
আদালতে রিটের শুনানিতে আইনজীবী হাসান এম এস আজিম বলেন, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কোনো সিদ্ধান্ত দিলে তা ইউএনও বাস্তবায়ন না করলে পরিষদের করণীয় কিছু থাকে না। উপজেলা পরিষদের কাছে ইউএনওর জবাবদিহিতার বাধ্যবাধকতা আইনে রাখা হয়নি। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার স্বাধীনতাকে এই একটি ধারার মাধ্যমে কেড়ে নেয়া হয়েছে।
এই ৩৩ ধারা সংবিধানের ৭ ও ৫৯ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। ৫৯(১)-এ স্থানীয় শাসন সম্পর্কে বলা হয়েছে, আইনানুযায়ী নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের ওপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের স্থানীয় শাসনের ভার প্রদান করা হবে। শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট রুল জারি করেন।
রিট আবেদনে উপজেলা পরিষদ আইনের যে ৩৩ ধারা চ্যালেঞ্জ করা হয়। এই ধারায় ইউএনওদের উপজেলা পরিষদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন ও আর্থিক শৃঙ্খলা আনয়নসহ সাচিবিক দায়িত্ব পালনের বিধান রাখা আছে।
এছাড়াও রিটে ইউএনওরা বিভিন্ন আমন্ত্রণপত্রে উপজেলা পরিষদ না লিখে উপজেলা প্রশাসন লিখে থাকেন, তারও বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। পাশাপাশি মন্ত্রণালয় থেকে সরকারি আদেশ বাস্তবায়নে যেসব কমিটি গঠন করা হয়, সেসব কমিটিতে ইউএনওকে চেয়ারম্যান করার বৈধতাও চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে।
এদিকে উপজেলা পরিষদ আইন, ১৯৯৮ (সংশোধিত ২০১১) অনুযায়ী উপজেলায় থাকা ১৭টি দপ্তরের কর্মকর্তা, কর্মচারী ও তাদের কাজ উপজেলায় হস্তান্তরিত। কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ওই ১৭টি বিভাগের যেসব কমিটি করা হয়েছে এর সবগুলোতেই সভাপতি নির্বাহী কর্মকর্তা।
আর উপদেষ্টা করা হয়েছে উপজেলা চেয়ারম্যানকে। একইভাবে আয়ন-ব্যয়ন কর্মকর্তা হচ্ছেন ইউএনও এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তা। অথচ একই প্রজ্ঞাপনে ইউনিয়ন ও পৌরসভায় আয়ন-ব্যয়ন কমিটির সভাপতি হচ্ছেন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও পৌরসভার মেয়র।
অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা জানিয়েছেন, দেশের ৪৯২টি উপজেলা পরিষদে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি রয়েছেন ১ হাজার ৪৭৬ জন। গত ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে নির্বাচিত এই জনপ্রতিনিধিরা সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী তাদের কোনো দায়িত্বই যথাযথভাবে পালন করতে পারছেন না। চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানদের অভিযোগ, উল্টো সব ক্ষমতা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা নিজেদের হাতে কুক্ষিগত করে রেখেছেন।