মোহাম্মদ ইয়াসিন আরাফাত সাজ্জাদ: ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স (রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাক্রম) সংক্রান্তে গত ২০জুলাই ২০২০ ইং তারিখের সংশোধনীর মত একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আইনের ছাত্রদের চোখ এড়িয়ে গেছে। এতদিন ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সের এক নম্বর নোটস-এ বলাছিল, “রাষ্ট্রীয় ও আনুষ্ঠানিক অনুষ্ঠান” এর পাশাপাশি “সরকারের অন্য সবক্ষেত্রে” ও এটি পালন করা হবে।
নতুন সংশোধনীতে সেই নোটসটি প্রতিস্থাপন করে বলা হয়েছে, এটি শুধু রাষ্ট্রীয় ও আনুষ্ঠানিক অনুষ্ঠানে পালন করা হবে। ‘সরকারের অন্য সবক্ষেত্রে’ কথাটি বাদ দেওয়া হয়েছে।
কারণ কি জানেন? এ-সংক্রান্ত মামলায় হাইকোর্টের সিদ্ধান্ত গ্রহণের অন্যতম একটা যুক্তি ছিল এটা যেসব ক্ষেত্রে এটা ব্যবহারিত হয়। সরকারপক্ষে প্রশাসন ক্যাডার এটা বাস্তবায়ন হতে দিতে চায় না। এমন কি সরকারপ্রধানও নিমরাজি৷ কটু মন্তব্য করেছেন। এখন সরকারের উদ্দেশ্য হলো চলমান রিভিউ এর আবেদন আপীল বিভাগকে মিসলিড করা। ভুল বুঝানোর জন্য এবং বিষয়টি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য এ সংশোধনী।
কিন্তু এ নিয়ে দুঃখজনকভাবে সংশ্লিষ্ট কারো প্রতিক্রিয়া বা লেখালেখি দেখলাম না। এমন কি সম্প্রতি জেলা জজ ও ডিসিকে একসাথে কো-চেয়ারম্যান করে প্রজ্ঞাপনও আমরা দেখেছি। আবার দেখলাম বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্ব কমিটি করেছে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি ও দীর্ঘসূত্রিতা নিয়ে কাজ করার জন্য।
আমার বিভিন্ন সরকারি অফিসে ও মন্ত্রণালয়ে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। খুব কাছ থেকে দেখেছি, জেলা জজ কিংবা অন্যান্য বিচারকদের আইন কর্মকর্তা হিসাবে কিভাবে অপদস্ত করা হয়। অবশ্যই এটাও ঠিক অনেকে ঢাকায় পোস্টিং এর জন্য নিম্নতর পদেও যেতে রাজি হবেন। অপ্রিয় সত্যি বললাম।
তো কিছু ঘটনা বলি, এক সরকারি কর্তৃপক্ষের অফিসে দেখলাম- প্রধান আইন কর্মকর্তা ও ল’ ম্যানেজার হচ্ছে যথাক্রমে প্রশাসনের যুগ্ম সচিব ও উপ সচিব। ওখানে একজন রিটায়ার্ড (অবসরপ্রাপ্ত) জেলা জজও আছেন লিগ্যাল কনসালটেন্ট হিসেবে। উনার সাথে উপসচিবরাও তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে কথা বলেন। সম্মান করেন না। উনার কোন পিয়ন বা টাইপিস্ট নাই। নিজে টাইপ করতে কষ্ট হয়। বুড়ালোক মেইল/ কম্পিউটার ব্যবহার করতেও ঝামেলা।
উনি কোন রুমে গেলে এডমিনের বা অন্য ক্যাডারের সহকারী সচিব থেকে শুরু করে উপরের কেউ দাঁড়িয়ে সম্মান জানায় না। যুগ্মসচিবরাও উনাকে রুমে ঢেকে পাঠায়। উনার রুমে যায় না। একজন টেক্স ক্যাডার থেকে পরিবর্তন করে বর্তমানে অতিরিক্ত সচিব পিয়ন দিয়ে উনাকে ডেকে পাঠান “এই যাও, লিগ্যাল সাহেবকে এখন আসতে বল। দ্রুত।”
বেচারা হাঁপাতে হাঁপাতে আসলেন, অতিরিক্ত সচিবের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। অতিঃ সচিব উনাকে বসতেও বলছে না। দাঁড়িয়ে স্যার স্যার বলে কথা বলছেন। আমিও বসা ছিলাম। আমার লজ্জা করছিল। উঠে বললাম, স্যার বসেন। সাবেক জেলা জজ ইতস্তত বোধ করছিলেন। পরে একটা চেয়ার টেনে একটু দূরে বসলেন। পরে আমি উনার রুমে গেলাম। অফিসের সবচেয়ে ছোটরুম। বললেন “কপালের দায় সব”। পূর্ববর্তী ক্যারিয়ার নিয়ে জিজ্ঞেস করলে লজ্জা পাচ্ছিলেন।
আরেক অফিসেও দেখলাম একজন রানিং জজ সাহেব আইন কর্মকর্তা। চাকরের মত তার সাথে অফিসের সিনিয়ররা আচার-ব্যবহার করেন। কোর্টের পেশকারকেও আমরা এরচেয়ে বেশি ইজ্জত করি।
মাসদার হোসেন মামলার সব রায়, পত্রিকার রিপোর্ট পড়ার সময় এবং ক্লাসে স্যারদের লেকচার শোনার সময় থেকে আমি রানিং জজ সাহেবদের প্রেষণে সরকারি দপ্তরে আইন কর্মকর্তা হিসেবে বলবৎ থাকা নিয়ে পক্ষেবিপক্ষে মতামত পড়তাম। নিজেও মনে মনে সমর্থন করতাম।
কিন্তু আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ বলে, প্রত্যেক সরকারি অফিসে নিজস্ব আইন কর্মকর্তা থাকা উচিত। পারলে পৃথক বিসিএস (আইন ও ভূমি) ক্যাডার দরকার। যাদের মধ্যে থেকে এসিল্যান্ডও পোস্টিং দেওয়া যাবে। কোন বিচারককে এসব প্রশাসনিক অফিসে পোস্টিং পুরোপুরি বন্ধ করে দরকার। চয়েজ হবে- আপনি বিচারক হবেন নাকি কেরানী হবেন? বিচারকদের ইজ্জত সম্মান ধরে রাখতে হবে। নচেৎ আপনাদের দিয়ে বিচার হবে না।
পাশাপাশি পাবলিক প্রসিকিউটর ক্যাডার বা সার্ভিসও আবশ্যক। নতুন এডভোকেটরা বিসিএস (আইন ও ভূমি) ক্যাডারে যাবে। ৫ বছরের বেশি অভিজ্ঞতা সম্পন্নরা যাবে পাবলিক প্রসিকিউটর ক্যাডার বা সার্ভিসে। ১০ বছরের বেশি অভিজ্ঞতা সম্পন্ন আইনজীবী কিংবা প্রসিকিউটর/আইন ক্যাডাররা মোট ১০ বছরের বেশি অভিজ্ঞতা হলে যাবেন বিচারক হিসেবে।
যাই হোক আরেকটা উপলব্ধি হচ্ছে অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজদের সরকারি/ বেসরকারি অফিসে এডভাইজর বা কনসালটেন্ট হিসেবে চাকুরীতে যাওয়া অনুচিত। অপমানিত হবেন। আপনাদের দিয়ে কাজের চেয়ে অকাজ বেশি করাবে। লিংক/তদবিরের জন্য উচ্চ বেতনে নিয়ে যাবে। তারচেয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা কিংবা উচ্চ আদালতে উকালতি করা শ্রেয়।
মোহাম্মদ ইয়াসিন আরাফাত সাজ্জাদ: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট