রওনক জাহান: কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা পৌরসভা নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকালে সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. মহসিন হাসানের সঙ্গে কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার এস এম তানভীর আরাফাতের দুর্বব্যবহারের ঘটনা ঘটেছে গত ১৬ জানুয়ারী। ঘটনাটিকে একটু নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করতে গেলে প্রথমে ঘটনাটিকে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে জানার চেষ্টা করতে হবে। এখানে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে ঘটনাটিকে জানার মাধ্যম হিসেবে প্রেসকে ব্যবহার করা যায়। কারণ আমি যদি পুলিশের কারো কাছ থেকে ঘটনাটি শুনে জানার চেষ্টা করি হতে পারে তা একপেষেভাবে পুলিশ সুপার তানভীর আরাফাতের পক্ষে একটু হেলে যাবে, আবার কোন বিজ্ঞ বিচারকের কাছ থেকে শুনে জানার চেষ্টা করি তাহলে হতে পারে তা সংশ্লিষ্ট বিচারকের পক্ষে একটু হেলে যাবে। বরং সংবাদ মাধ্যমের সংবাদটিকে শুধু রিডিং পড়ার মাধ্যমে ঘটনাটিকে বুঝতে চেষ্টা করা যাক।
ঘটনাটি সম্পর্কে সবগুলো সংবাদ মাধ্যমের বক্তব্য মোটামুটি এরকম যে, কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা পৌরসভার নির্বাচনে ১৪ই জানুয়ারী থেকে ১৮ই জানুয়ারী পর্যন্ত প্রথম শ্রেণীর জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন মহসিন হাসান। এরপর ১৬ই জানুয়ারী দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় সকাল দশটায় ভেড়ামারা পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে অবস্থানকালে জনৈক ভোটারের অবস্থানের ভিত্তিতে ভোট কেন্দ্রে প্রবেশ করেন। সেখানে কতিপয় ব্যক্তিকে ভোট কেন্দ্রের বুথের ভেতর লম্বা বেঞ্চে পুলিং এজেন্টের সাথে বসে থাকতে দেখেন। সে সময় তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র দেখতে চাইলে তারা পরিচয়পত্র না দেখিয়ে প্রিজাইডিং অফিসার কর্তৃক স্বাক্ষরিত এ ফোর সাইজের কাগজ দেখায়। তখন তিনি সংশিষ্ট প্রিজাইডিং অফিসারকে এ বিষয়ে কথা বলার জন্য বুথের বাইরে ডাকেন। কথা বলতে শুরু করতেই এই ভোট কেন্দ্রে কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার এস এম তানভীর আরাফাতসহ চল্লিশ/পঞ্চাশজন ফোর্সসহ প্রবেশ করেন। তিনি প্রবেশ করেই প্রিজাইডিং অফিসারকে উচ্চস্বরে তলব করেন। তখনই অতিরিক্ত পুলিশ সুপারসহ আরো কয়েকজন ফোর্স প্রিজাইডিং অফিসারকে নিয়ে যাওয়ার জন্য চাপাচাপি করেন। তখন জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মহসিন হাসান নিজের পরিচয় দিয়ে বলেন যে তিনি প্রিজাইডিং অফিসারের সাথে জরুরি বিষয় নিয়ে কথা বলছেন। কথা শেষ হলে উনাকে নিয়ে যান। এরপরও এ এসপি মোস্তাফিজুর রহমান ধমক দিয়ে প্রিসাইডিং অফিসারকে নিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশ সুপার তানভির আরাফাত সামনে এসে বলেন আপনি কে, এখানে কি করেন? তখন জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মহসিন হাসান নিজের পরিচয় দিলে তিনি আরও ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন- আপনি এখানে কি করেন? বেয়াদব, বের হয়ে যান এখান থেকে। এরপর উক্ত পুলিশ সুপার তার সঙ্গীয় ফোর্স নিয়ে তার সামনে দিয়ে চলে যাওয়ার সময় একাধিকবার বলেন– এসব লোককে কারা পাঠায়, বেয়াদব ছেলে।
ঘটনাটির পড়ার পর একজন আইনের ছাত্রী হিসেবে আইনের দৃষ্টিতে এবং রাষ্ট্রের সচেতন নাগরিক হিসেবে ঘটনাটিকে বিশ্লেষণ করার ছোটখাট একটা চেষ্টা করি।
প্রথমত, উক্ত জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আইনানুগভাবে ১৪-১৮ই জানুয়ারী সময়ের জন্য ভেড়ামারা পৌরসভা নির্বাচনে প্রথম শ্রেনীর ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। এবং ১৬ই জানুয়ারী নির্বাচন অনুষ্ঠানকালে দায়িত্ব পালনরত থাকেন। এবং কতিপয় সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে বুথের মধ্যে বসে থাকতে দেখে সে বিষয়ে প্রিজাইডিং অফিসারকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন যা একটি আইনানুগ কাজ এবং তার দায়িত্বেরই অংশ। এমতাবস্থায়, পুলিস সুপার তানভীর আরাভাত সাহেব তা দেখে, জেনে শুনেই প্রিজাইডিং অফিসারকে জোর করে নিয়ে যেতে চান যা উক্ত ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্বপালনে স্পষ্টরূপে বাধা সৃষ্টি। একইভাবে পুলিশ সুপার সাহেব নিজে নন, তার সঙ্গীয় ফোর্সসহ এসে উক্ত দায়িত্বপালনকারী ম্যাজিস্টেটের কাজে বাধা দেয় তার সামনে দিয়ে জোর করে নিয়ে যায়। দুটি কাজই স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) নির্বাচন বিধিমালা,২০১০ এর ৭৪(খ) ও ৭৪ (গ) নং বিধির অধীনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) নির্বাচন বিধিমালা,২০১০ এর ৮১ বিধিতে বলা আছে, প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত কোন ব্যক্তি অন্যূন ৬ মাস এবং অনধিক ৫ বছরের কারাদন্ডে দন্ডিত হবেন যদি সে নির্বাচনের ফলাফলকে প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে তার পদমর্যাদা ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে থাকে। আলোচিত ঘটনাটিতে দায়িত্বপালনরত ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট মনে হয়েছে কতিপয় সন্দেহভাজন ব্যক্তি নির্বাচন আইন লংঘন করে বুথের মধ্যে বসে ছিল। সেটা নিরুপনার্থেই তিনি প্রিজাইডিং অফিসারকে জিজ্ঞাসাবাদ করছিলেন। এমন সময় পুলিশ সুপার সাহেবের ফোর্সসহ এসে দায়িত্বপালনরত ম্যাজিস্ট্রেটকে তার পদমর্যাদার অপব্যবহার করে বাধা প্রদান করেছেন যা উক্ত ৮১ নং বিধির অধীনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, উক্ত পুলিশ সুপারও তো দায়িত্ব পালনরত ছিলেন। এখানে লক্ষণীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজ হল ভোট কেন্দ্রে শৃঙ্খলা বজায় রাখা। বাইরে থেকে যাতে কোন ব্যক্তি যারা ভোটার নয় বা যারা নির্বাচনের ফলাফলকে প্রভাবিত করতে পারে তারা ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে সে দিকে নজর রাখা, ভোট কেন্দ্রে যেন কোন আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি না ঘটে সেদিকে নজর রাখা এবং এরূপ পরিস্থিতির উদ্ভব হলে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে জড়িত ব্যক্তিকে বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতারসহ অন্যান্য আইনানুগ ক্ষমতা প্রয়োগ করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।
এছাড়া উক্ত পুলিশ সুপারের ফোর্সসহ নির্বাচনী কেন্দ্রের ভেতরে প্রবেশ করার কোন এখতিয়ার নেই। আলোচিত ঘটনাটিতে পুলিশ সুপার বিনা কারণে ফোর্সসহ এসে প্রিজাইডিং অফিসারকে জোর করে নিয়ে গেছেন। এখানে তিনি উক্ত দায়িত্বপালনরত ম্যাজিস্ট্রেটের কাজে বাধা সৃষ্টি করেছেন তো বটেই, আবার প্রিজাইডিং অফিসারের দায়িত্বপালনে বাধা সৃষ্টি করেছেন।
এছাড়াও তার এরকম কর্মকান্ড দন্ডবিধির ১৮৬, ১৮৭, ১৮৯, ২২৮ ধারার অধীনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
এরপরে আসা যাক উক্ত পুলিশ সুপার দায়িত্বপালনরত ম্যাজিস্ট্রেটকে কি কি ভাষা ব্যবহার করে তার পদমর্যাদার অপব্যবহার করেছেন? সংবাদ মাধ্যম থেকে জানতে পারা যায়- তিনি বলেছেন – আপনি কে? এখানে কি করছেন? ভোট কেন্দ্রে উক্ত ম্যাজিস্ট্রেটের প্রবেশের ও বিচরণের আইনানুগ এখতিয়ার রয়েছে। পুলিশ সুপারের ফোর্সসহ বিনা কারণে প্রবেশের এখতিয়ার আছে কি? এবং উক্ত ম্যাজিস্ট্রেট স্পষ্টভাবে তার পরিচয় জানিয়ে দেওয়ার পরও উক্ত পুলিশ সুপার বলেছেন– বেয়াদব, আপনি এখান থেকে বের হয়ে যান।
এ থেকে বোঝা যায় পুলিশ সুপার সরল বিশ্বাসে এ কথা বলেন নি। বরং জেনে শুনেই বলেছেন। এরপর তিনি একাধিকবার বলেছেন যে, এসব লোককে কারা পাঠায়, বেয়াদব! পুলিশ সুপারের এরকম বক্তব্য উক্ত ম্যাজিস্ট্রেটের নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ তথা নির্বাচন কমিশনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার সামিল। পুলিশ সুপার এক্ষেত্রে শুধু এখতিয়ারবিহীনভাবেই কাজই করেছেন তা নয় বরং উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের তথা নির্বাচন কমিশনের সাথে অসদাচরণ করেছে। সেই সাথে একজন দায়িত্ব পালনরত ম্যাজিস্ট্রেটকে বেয়াদব বলা professional etiquette এর বাইরে। রেগুলেশন ৩. পি আর বি ১৯৪৩ এর বিধান লংঘনে করেছেন তিনি যা পুলিশ আইন,১৯৬১ এর ২৯ ধারার অধীনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
এছাড়া মহসিন হাসান একজন প্রথম শ্রেনীর জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে ভোট কেন্দ্রে গেছেন। একজন প্রথম শ্রেনীর ম্যাজিস্ট্রেট একজন বিচারক এবং আদালত। তার সাথে জেনে বুঝে পুলিশ সুপারের এরকম আচরণই বরং বেয়াদবি, অসদাচারণ ও আদালত অবমাননার সামিল।
একজন বিচারক হিসেবে নয়, বরং আইনের ছাত্রী হিসেবে ঘটনাটিকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি। প্রত্যেক সচেতন নাগরিকের উচিত আইনের লংঘনে আলোচনা–সমালোচনা করে বাংলাদেশকে সফল গণতান্ত্রিক রাষ্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠা করায় অংশগ্রহণ করা। অন্যথায়, জনগণ, জনগণের সেবকের বদলে মাস্তান পাবে।
রওনক জাহান: সহকারী জজ, পাবনা।