সিরাজ প্রামাণিক: পাঠক! নিশ্চয়ই আপনাদের মনে আছে পুলিশ প্রধান শাহাদুল হকের চাকুরিচ্যুতির গল্পের কথা। সেই ২০০৩ সালের ১৯ জুন। বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের মাননীয় বিচারপতি জনাব শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক সরকারী গাড়িযোগে বনানী কামাল আর্তাতুক এলাকা অতিক্রম করছিলেন। সে সময় পুলিশ সার্জেন্ট বিচারপতি মহোদয়ের গাড়ি থামিয়ে পুলিশের নীল রঙের একটা জীপগাড়ি আগে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন৷ একই সাথে পুলিশের গাড়ি লক্ষ্য করে স্যালুট প্রদান করেন।
বিষয়টি লক্ষ্য করে বিচারপতি মহোদয় গাড়ি থেকে নেমে সার্জেন্ট এর কাছে জিজ্ঞেস করেন, সুপ্রিম কোর্টের লোগো সম্বলিত গাড়ি ও কালো পতাকা দেখে সালাম না করার কারণ কি? সার্জেন্ট বলে যে, আমরা সুপ্রিম কোর্টের পতাকা স্যালুট করতে বাধ্য নই। আমাদের অত ঠ্যাকা পড়ে নাই! বিষয়টি নিয়ে সার্জেন্ট সোয়েবুর রহমান বিচারপতি মহোদয়ের সাথে তর্কে জড়ান। পরবর্তীতে আশেপাশে থাকা আরো কয়েকজন পুলিশ সার্জেন্টকে ডাকেন সোয়েবুর রহমান। ৫ জন পুলিশ অফিসার জুডিসিয়ারী নিয়ে নানাভাবে কটূক্তি করেন। মাননীয় বিচারপতি জনাব শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ৩০ জুন ২০০৩ ওই পাঁচ জন পুলিশ অফিসারকে স্বশরীরে আদালতে উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ দেন।
একইসাথে আইজিপি এবং পুলিশ ট্রেনিং কলেজের প্রিন্সিপালকে ১২ জুলাই ২০০৩ তারিখের মধ্যে নির্দেশ দেন চারটি প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য। প্রশ্নগুলি ছিল এরকম যে, (১) সার্জেন্ট শোয়েবের আদালতের প্রতি অবমাননার উক্তিতে পুলিশ সদস্যদের ট্রেনিং কলেজে আদালতের প্রতি সন্মান প্রদর্শনে কি জাতীয় ট্রেনিং দেয়া হয়েছে? (২) সকল র্যাংকের পুলিশ কর্মকর্তা মহামান্য হাইকোর্টের লোগো সম্বলিত গাড়ি বহনকারীকে স্যালুট দিতে বাধ্য কি-না? (৩) ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স বিষয়ে সকল পুলিশ কর্মকর্তা সকল ইভেন্টে অনুসরণ করতে বাধ্য কি-না? ও (৪) পুলিশ সদস্যদের প্রশিক্ষণে এমনটি শেখানো হয়েছে কি-না যে, কম গুরুত্বহীন ব্যক্তির গাড়িকে আগে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়া, ইত্যাদি?
এই নির্দেশনা দেওয়ার কিছুদিন পরে অস্থায়ী বিচারপতি জনাব শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের চাকুরী স্থায়ী না হওয়ায় তিনি আর বিচারপতি হিসেবে চাকুরীতে ছিলেন না। তবে পুলিশ প্রধান চারটি প্রশ্নের উত্তরে বলেন যে, ডিউটিরত অবস্থায় পুলিশ সার্জেন্ট বিচারপতিকে সালাম দিতে বাধ্য ছিলেন না। যে বিচারপতি ওই আদেশ দিয়েছিলেন সে এখন আর চাকুরীতে নেই। ওই বিচারপতিকেই বরং দেশের প্রচলিত আইনে সরকারি কাজে বাঁধা দেওয়ার ও পুলিশ অফিসারকে হুমকি দেওয়ার জন্য বিচার করা উচিত। একইসাথে আইজি বিচার বিভাগ ও সুপ্রিমকোর্ট নিয়ে বিভিন্ন আকার ইঙ্গিতে কটূক্তি করেন।
জবাবের কপি আমলে নিয়ে বিচারপতি জনাব মোঃ আব্দুল মতিন এবং বিচারপতি জনাব সৈয়দ রিফাত আহম্মেদ স্বপ্রনোদিতভাবে আইজিপির বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল ইস্যু করেন। একইসাথে আইজিপিকে সশরীরে আদালতে উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ দেন। আইজিপি সশরীরে উপস্থিত হয়েছিলেন। হাইকোর্ট ডিভিশন আইজিপি শাহাদুল হক সহ চার জন পুলিশ অফিসার এর জবাবে সন্তুষ্টি না হওয়ায় তাদেরকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা ও জরিমানা প্রদান করেন।
হাইকোর্ট ডিভিশন এর আদেশের পরে দেশের বিশিষ্ট আইনজ্ঞরা অভিমত দেন যে, দি পাবলিক সার্ভেন্ট অর্ডিন্যান্স, ১৯৮৫ অনুযায়ী পুলিশ প্রধান শাহাদুল হকের চাকুরীতে থাকার সুযোগ নেই। রায় প্রদানের সময় আইজিপি ফ্রান্সে ইন্টারপোলের সদর দপ্তরে ছিলেন একটা আন্তর্জাতিক সম্মেলনে। সে যখন দেশে আসেন সে সময় তাকে বিমানবন্দরে পুলিশ প্রধান হিসাবে প্রোটোকল দেওয়া হয়নি। তাকে সাময়িক পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে ডিএমপির কমিশনারকে চার্জে রাখা হয়। পরবর্তীতে সাসপেন্ড করা হয়। হাইকোর্ট ডিভিশন এই রায়ে জুডিশিয়ারির মর্যাদা ও অবস্থান সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু অবজারভেশন প্রদান করেন। পরবর্তীতে কলেবরে পাঠকের জ্ঞাতার্থে উক্ত পর্যবেক্ষণগুলো ব্যাখা করা হবে।
মহামান্য হাইকোর্ট ডিভিশন সুস্পষ্ট বলেন যে, সংবিধানের ১১২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী পুলিশসহ নির্বাহী বিভাগ আদালতকে সহায়তা করতে বাধ্য। তাছাড়া আদালত বলতে কেবল গম্বুজাকৃতির বিল্ডিংকেই বুঝাবে না, বরং ফৌজদারি কার্যবিধি এর ২৫ ধারা অনুয়ায়ী সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির এখতিয়ার সমগ্র বাংলাদেশ। সমগ্র বাংলাদেশেই এখতিয়ার প্রয়োগের ক্ষমতা রয়েছে। এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে যায় পুলিশ প্রধান সহ বিবাদীপক্ষ। আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায়ে হস্তক্ষেপে কোন যুক্তি না থাকায় আপিল খারিজ করে দেন।
বিচার বিভাগের প্রয়োজনীয়তার কথা বিবেচনায়, ১৮৯৮ সালে ফৌজদারী কার্যবিধি প্রণয়নের সময় ২২-২৫ ধারায় জাস্টিস অব পিস সংক্রান্ত বিধান আলোচনা করা হয়। ক্রিমিনাল ল’ এ্যামেন্ডমেন্ট এ্যাক্ট, ১৯২৩ এর ৪ ধারার বিধান অনুযায়ী ১৯২৩ সালে ২৩ ও ২৪ ধারা বাতিল করা হয়। ২৫ ধারায় পদাধিকারবলে জাস্টিস অব পিস হিসেবে কাজ করার বিধান রাখা হয়।
ফৌজদারী কার্যবিধি ১৮৯৮ এর ২৫ ধারায় বিধান অনুযায়ী, পদাধিকারবলে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকগণ সারা বাংলাদেশের জন্য, দায়রা বিচার, চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, মেট্টোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট নিজ নিজ অধিক্ষেত্রের মধ্যে জাস্টিস অব পিস হিসেবে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন।
অথচ পত্রিকার পাতায় খবর এসেছে, নির্বাচনি দায়িত্ব পালনকালে কুষ্টিয়ার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. মহসিন হাসানের সঙ্গে কুষ্টিয়া জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) এস এম তানভীর আরাফাত অনৈতিক ও বেআইনি কার্যকলাপ, আক্রমণাত্মক ও বিশৃঙ্খলামূলক আচরণ দ্বারা ভয়ভীতি প্রদর্শন ও সরকারি দায়িত্বপালনে পদমর্যাদার অপব্যবহার করেছেন।
বিচারকের সঙ্গে পুলিশের অসদাচরণের চাক্ষুষ সাক্ষীকে ভয়ভীতি দেখানোয় ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ওই প্রিজাইডিং অফিসার কে ও তার পরিবারের নিরাপত্তা বিধানের জন্য পুলিশ মহাপরিদর্শককে নির্দেশ দিয়েছেন মহামান্য হাইকোর্ট।
সেই সাথে ‘অসৌজন্যমূলক আচরণ’ এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচন বিধিমালা ‘লঙ্ঘনের’ অভিযোগের বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে হবে পুলিশ সুপার এস এম তানভীর আরাফাতকে।
উল্লেখ্য, পুলিশ সুপার ও তার সঙ্গীয় ফোর্সদের আচরণ স্থানীয় সরকার নির্বাচন বিধিমালা ২০১০-এর ৬৯, ৭০, ৭৪, ৮০ ও ৮১ বিধির সরাসরি লঙ্ঘন। আইন অনুযায়ী নির্বাচন কেন্দ্রের আশেপাশে যেকোন প্রকার অস্ত্র বহন করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
কিন্তু প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায়, তিনি ৩০-৪০ জন সশস্ত্র পুলিশসহ নির্বাচন কেন্দ্রে প্রবেশ করেছেন। ভোটকেন্দ্রে ভোটগ্রহণ এর সাথে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং ভোটার ছাড়া শুধুমাত্র দায়িত্ব পালনরত বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট প্রবেশ করার অধিকার রাখেন। কোন পুলিশ সদস্যের সেখানে যাওয়ার কোন প্রকার সুযোগ নেই। এটা তাদের কাজও না।
সংশ্লিষ্ট পুলিশ সুপার কি প্রয়োজনে এবং কোন এখতিয়ার বলে ভোট কেন্দ্রে গিয়ে বিচারকের সাথে এহেন আচরণ করেছেন। এ বিষয়ে অতীতের মতো দেশের সর্বোচ্চ আদালত কি ব্যবস্থা নেন সেই প্রতীক্ষার পথ চেয়ে…।
সিরাজ প্রামাণিক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা, আইন গবেষক ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল। ই-মেইল: seraj.pramanik@gmail.com
তথ্য সংগ্রহ
*Shahudul Haque, IGP, police and others Vs state, 35 CLC (AD) (1092)
*Government of Bangladesh Vs Sergeant Shoaibur Rahman and others 10 BLC 325.
*Miscellaneous Suo moto Rule No. 12166 of 2003 (HCD)