মোঃ শহীদুল্লাহ মানসুর: শীতের আগমনী বার্তায় দেশের বিভিন্ন খাল-বিল ও আশপাশের এলাকাগুলোতে দেশি-বিদেশি, চেনা-অচেনা অসংখ্য পাখির কলকাকলিতে মুখরিত ও প্রাণবন্ত হয়ে উঠে। সচরাচর হেমন্তের শেষ দিকে এধরণের নাম না জানা হাজারো বিদেশি পাখির আগমন ঘটে আমাদের দেশে। এদের অতিথি পাখি বলাহয় কারণ শীতের তীব্রতা, তুষারপাত ও খাবারের অভাব সইতে না পেরে তুলনামূলক কম শীতের দেশ স্বল্প সময়ের জন্য বাংলাদেশে আসে আবার শীতের প্রভাব কমে গেলে ফিরে যায় তাদের দেশে।
এ সুযোগে সৌখিন ও পেশাদার পাখি শিকারিরা অবাধে বন্দুক, বিষটোপ, জাল ও বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ পেতে এসব পাখি নিধন করে। এই সুযোগ-সন্ধানী সৌখিন ও পেশাদার পাখি শিকারিরা শুধু যে অতিথি পাখি শিকার করে তা কিন্তু নয় বরং তাঁরা কম-বেশি সারা বছরেই দেশীয় বন্য পশু-পাখি শিকার করে যার অনেক প্রজাতিই এখন বিলুপ্তপ্রায়।
বিলুপ্তপ্রায় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে সরকার “বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২” প্রণয়ন করলেও আইনকে তোয়াক্কা না করে অবাধে চলছে বন্যপ্রাণী ওঅতিথি পাখি শিকার। এই আইনের ৪৩ ধারা অনুযায়ী ৩৬ ধারায় সংঘটিত অপরাধ ব্যতীত এই আইনের অধীনে সকল অপরাধ আমল অ-যোগ্য, জামিনযোগ্য ও ক্ষতিপূরণ সাপেক্ষে আপোষযোগ্য।
অপরাধ ও শাস্তিঃ
বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২ এর ২৪ ধারা অনুযায়ী, কোন ব্যক্তি কোন বন্যপ্রাণী বা তার দেহের অংশ, মাংস, ট্রফি, অসম্পূর্ণ ট্রফি বা কোন উদ্ভিদ বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে চাষ, আহরণ, উৎপাদন, লালন-পালন, আমদানি-রপ্তানি বা কোন বন্যপ্রাণী শিকার করতে চাইলে, উক্ত ব্যক্তিকে ফি প্রদান সাপেক্ষে লাইসেন্স গ্রহণ করতে হবে।
লাইসেন্সের মেয়াদ লাইসেন্স প্রদানের তারিখ হতে এক বছর পর্যন্তকার্যকর থাকবে এবংএরপরপুনরায় ফি প্রদান সাপেক্ষে লাইসেন্স নবায়ন করতে হবে। তবে লাইসেন্সের কোন শর্ত ভঙ্গ করলে লাইসেন্স গ্রহীতাকে যুক্তিসংগত কারণ দর্শানোর সুযোগ দিয়ে লাইসেন্স স্থগিত বা বাতিল করা যাবে।
যদি কোন ব্যক্তি এ বিধান লঙ্ঘন করে তবে এই আইনের ৪০ ধারা অনুযায়ী, ঐ ব্যক্তির সর্বোচ্চ ১ (এক) বছর পর্যন্ত কারাদন্ড বা সর্বোচ্চ ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ড অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন এবং একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটালে সর্বোচ্চ ২ (দুই) বৎসর পর্যন্ত কারাদন্ড অথবা সর্বোচ্চ ১ (এক) লক্ষ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন।
বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২ এর ৩৮ ধারা অনুযায়ী, যদি কোন ব্যক্তি বন্য বা অতিথি পাখি যা তফসিল ১ ও ২ এ উল্ল্যেখ আছে তা হত্যা করে তবে তিনি অপরাধ করেছেন বলে বিবেচিত হবেন এবং অপরাধের জন্য তিনি সর্বোচ্চ ১ (এক) বছর পর্যন্ত কারাদন্ড বা সর্বোচ্চ ১ (এক) লক্ষ টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন এবং একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটালে সর্বোচ্চ ২ (দুই) বছর পর্যন্ত কারাদন্ড বা সর্বোচ্চ ২ (দুই) লক্ষ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন।
আবার এধরণের পাখির ট্রফি বা অসম্পূর্ণ ট্রফি, মাংস, দেহের অংশ সংগ্রহ করলে, দখলে রাখলে বা ক্রয় বা বিক্রয় করলে বা পরিবহন করলে উক্ত ব্যক্তির সর্বোচ্চ ৬ (ছয়) মাস পর্যন্ত কারাদন্ড বা সর্বোচ্চ ৩০ (ত্রিশ) হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন এবং একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটালে সর্বোচ্চ ১ (এক) বছর পর্যন্ত কারাদন্ড বা সর্বোচ্চ ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন।
বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২ এর ৪১ ধারা অনুযায়ী, যদি কোন ব্যক্তি এই আইনের অধীন কোন অপরাধ সংঘটনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহায়তা করলে বা উক্ত অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা প্রদান করলে এবং উক্ত সহায়তা বা প্ররোচনার ফলে অপরাধটি সংঘটিত হলে, উক্ত সহায়তাকারী বা প্ররোচনাকারী তার সহায়তা বা প্ররোচনা দ্বারা সংঘটিত অপরাধের জন্য প্রকৃত অপরাধীর সাথে একই দন্ডে দন্ডিত হবেন।
বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২ এর ৪১ ধারা অনুযায়ী, যদি কোন কর্মকর্তা এই আইনের বিধান লঙ্ঘন করে কোন দ্রব্য বা সামগ্রী জব্দ বা কোন ব্যক্তিকে হয়রানি করলে উক্ত কর্মকর্তার সর্বোচ্চ ৬ (ছয়) মাসের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা হবে।
আবার এই আইনে দায়ের করা মামলায় কোন ব্যক্তিকে খালাসের রায় হলে এবং বিচারকের নিকট যদি মনে হয় উক্ত মামলা ইচ্ছাকৃতভাবে হয়রানি বা মিথ্যা ও ভিত্তিহীন, তবে মামলাকারী ব্যক্তির সর্বোচ্চ ১ (এক) বছরের কারাদণ্ড বা ১ (এক) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন।
বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২ এর ৪৬ ধারা অনুযায়ী, যদি কোন কোম্পানী এই আইনের অধীন কোন অপরাধ সংঘটিত করে উক্ত অপরাধের সাথে প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কোম্পানীর এমন প্রত্যেক পরিচালক, ব্যবস্থাপক, সচিব, অংশীদার, কর্মকর্তা এবং কর্মচারী উক্ত অপরাধ সংঘটন করেছেন বলে বিবেচনা করা হবে, যদি না তিনি প্রমাণ করতে পারেন যে,ঐ অপরাধ তাহার অজ্ঞাতসারে সংঘটিত হয়েছে বা ঐ অপরাধ রোধ করার জন্য তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন।
বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২ এর ১৩ ধারা অনুযায়ী, সরকার গেজেট আকারে বন্যপ্রাণীর নিরাপদ আবাসস্থলের জন্য অভয়ারণ্য ঘোষণা করতে পারবে এবং ১৪ ধারা অনুযায়ী, অভয়ারণ্যে চাষাবাদ,কারখানা, উদ্ভিদ সংগ্রহ, অগ্নিসংযোগ, বন্যপ্রাণীকে বিরক্ত, গোলাবর্ষণ, রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার, খনিজ পদার্থ সংগ্রহ, জলপ্রবাহের গতি পরিবর্তন বা বন্ধ করা যাবে না।
যদি কোন ব্যক্তি উপরিউক্ত কাজগুলো করলে তা এই আইনের ৩৫ ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হবে যার শাস্তি সর্বোচ্চ ২ (দুই) বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ১ (এক) লাক্ষ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন এবং একই অপরাধ বারবার করলে সর্বোচ্চ ৫(পাঁচ) বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ৪ (চার) লাক্ষ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন।
এছাড়াও বাঘ, হরিণ, হাতি,চিতাবাঘ, লাম চিতা, উল্লুক, সাম্বার হরিণ, কুমির, ঘড়িয়াল, তিমি, ডলফিনসহ ইত্যাদি বন্য ও বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী হত্যা, আহত বা সংগ্রহ, সংরক্ষণ, ক্রয়, বিক্রয় আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
মোঃ শহীদুল্লাহ মানসুর: শিক্ষার্থী; আইন বিভাগ, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি