বিচারপতি মোঃ আশরাফুল কামাল:
পৃথিবীর ইতিহাসে কোন জাতি রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে এত দ্রুত তথা মাত্র নয় মাসের মধ্যে স্বাধীনতা লাভ করেনি। তেমনি মাত্র নয় মাসের মধ্যে পৃথিবীর কোন জাতি সংবিধান প্রণয়ন করতে সক্ষম হয়নি। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙ্গালী জাতি পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম জাতি যারা একটি রক্তাক্ত সংগ্রামের মাধ্যমে মাত্র নয় মাসের মধ্যে একটি স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র অর্জন করেছে। তেমনি স্বাধীনতা লাভের মাত্র নয় মাসের মধ্যে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম শাসনতন্ত্র তথা আমাদের পবিত্র সংবিধান সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে প্রণীত হয়েছিল। যেখানে সংবিধান প্রণয়নে ভারতের লেগেছিল সাড়ে তিন বৎসর এবং পাকিস্তানের লেগেছিল নয় বৎসর।
৪ নভেম্বর, ১৯৭২, সংবিধান গৃহীত হওয়ার বৈঠক তথা গণপরিষদের সপ্তদশ বৈঠকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ভাষণে বলেছিলেন-
“নয় মাসের মধ্যে যে শাসনতন্ত্র দেওয়া হয়েছে, এটা হল আর একটি নতুন সষ্টি। আমি আগেই বলেছি, শাসনতন্ত্র ছাড়া, মৌলিক অধিকার ছাড়া দেশের অবস্থা হয় মাঝিহীন নৌকার মতো। তাই মানুষের মৌলিক অধিকার যাতে তাড়াতাড়ি ফিরে আসে, তার জন্য আমাদের পার্টি এই শাসনতন্ত্র প্রদান করল। আশাকরি, জনগণ এই শাসনতন্ত্র গ্রহণ করবেন এবং করেছেন। কারণ আমরা জনগণের প্রতিনিধি। নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা এসেছি। কেউ আমাদের পকেট থেকে বের করে দেন নাই। আর, আমরা আসমান থেকে পড়ি নাই বা কেউ এসে আমাদের ‘মার্শাল ল’ জারী করে বসিয়ে দেন নাই।
‘মার্শাল ল’ জারী আমরাও করতে পারতাম। যেদিন আমার বন্ধুরা, সহকর্মীরা এখানে এসে সরকার বসান, সেদিন তারা বলতে পারতেন, emergency! No democracy! No talk for three years! এবং সেটা মানুষ গ্রহণ করতেন। কোন সমালোচনা চলবে না! কোন মিছিল হবে না! কোন পার্টির কাম চলবে না! কারণ, দেশের যা অবস্থা ছিল, তাতে এটা করা যেত। সব দেশে, সব যুগে, বিভক্তের পরে তাই হয়েছে। কিন্তু আমরা সেটা চাই নাই। শক্তি আমাদের ছিল। আমাদের শক্তি আমাদের জনগণ।”
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান রচনা ও বিধিবদ্ধ করে গ্রহণের দিন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উপরোল্লিখিত বক্তব্য সহজ সরল পাঠে এটি কাচের মত স্পষ্ট যে, তিনি ভারতের মত সাড়ে তিন বৎসর তথা ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত অথবা পাকিস্তানের মত নয় বৎসর তথা ১৯৮১ সাল পর্যন্ত সংবিধান প্রণয়নের জন্য ক্ষমতায় থাকতে পারতেন। তারপর ১৯৭৬ সাল কিংবা ১৯৮১ সালের পরে সংবিধান প্রণয়ন করে নির্বাচন দিতে পারতেন। সে সময় বাংলাদেশের জনগণ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সংবিধান প্রণয়নের জন্য কোনরূপ তাগাদা তো প্রদান করেননি বরং ১৯৮১-৮২ সাল পর্যন্ত যদি বঙ্গবন্ধু সংবিধান প্রণয়নের জন্য সময় নিতেন তাতেও বাংলাদেশের জনগণ বিন্দুমাত্র আপত্তি করতেন না।
তাহলে কেন তিনি শাসনতন্ত্র তথা সংবিধান প্রণয়নের জন্য ১৯৮১-৮২ সাল পর্যন্ত সময় নিলেন না? কারণ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের ক্ষমতায়নে বিশ্বাসী ছিলেন এবং তাঁর ক্ষমতার উৎস সব সময়ই ছিল জনগণ। তাইতো তিনি গণপরিষদের উপরিল্লিখিত সপ্তদশ বৈঠকে তার ভাষণে বলেছিলেন,
“আমি স্বীকার করি, আমার দল স্বীকার করে, শক্তির উৎস হলো জনগণ।”
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গণপরিষদের উপরোল্লিখিত সপ্তদশ বৈঠকে তার ভাষনে বলেছিলেন,
“জনাব স্পীকার সাহেব, চারটা স্তম্ভের উপর এই শাসনতন্ত্র রচিত হয়েছে।”
অর্থাৎ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গণপরিষদ চারটি স্তম্ভের উপর ভিত্তি করে আমাদের শাসনতন্ত্র তথা সংবিধান রচনা করেন। সে চারটি স্তম্ভ হলো জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম স্তম্ভ জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে গণপরিষদের উপরোল্লিখিত সপ্তদশ বৈঠকে তার ভাষনে ব্যাখ্যা প্রদান করেন নিম্নরূপভাবে,
“জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে বাঙ্গালী জাতি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল চরম মরণ-সংগ্রামে। জাতীয়তাবাদ না হলে কোন জাতি এগিয়ে যেতে পারে না। এই মূলনীতির উপর ভিত্তি করে আামরা এগিয়ে গিয়েছি। আমরা জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করি। জাতীয়তাবাদের অনেক সংজ্ঞা অছে। অনেক ঋষি, অনেক মনীষী, অনেক বুদ্ধিজীবী, অনেক শিক্ষাবিদ অনেক রকম সংজ্ঞা দিয়েছেন। সুতরাং এ সম্বন্ধে আমি আমার নতুন সংজ্ঞা না-ই দিলাম। আমি শুধু বলতে পারি, আমি বাংলাদেশের মানুষ, আমি একটা জাতি।
এই যে জাতীয়তাবাদ, সে সম্পর্কে আমি একটা কথা বলতে চাই। ভাষাই বলুন, শিক্ষাই বলুন, সভ্যতাই বলুন, আর কৃষ্টিই বলুন-সকল কিছুর সঙ্গে একটা জিনিস রয়েছে। সেটা হল অনুভূতি। এই অনুভূতি যদি না থাকে, তাহলে কোন জাতি বড় হতে পারে না এবং জাতীয়তাবাদ আসতে পারে না। অনেক জাতি দুনিয়ায় আছে, যারা বিভিন্ন ভাষাবলম্বির এক জাতি হয়েছে। অনেক দেশ আছে, একই ভাষা, একই ধর্ম, একই সবকিছু নিয়ে বিভিন্ন জাতি গড়ে উঠেছে-তারা এক জাতিতে পরিণত হতে পারে নাই। জাতীয়তাবাদ নির্ভর করে অনুভূতির উপর।
সে জন্য আজ বাঙ্গালী জাতি যে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা নিয়েছে, যার উপর ভিত্তি করে আমরা স্বাধীনতা নিয়েছি, যার উপর ভিত্তি করে আমরা সংগ্রাম করেছি, সেই অনুভূতি অছে বলেই আজকে আমি বাঙ্গালী, আমরা বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ। এর মধ্যে যদি কেউ আজকে দ্বিতীয় কোন প্রশ্ন তুলতে চান, তাহলে তাকে আমি অনুরোধ করব, মেহেরবানি করে আগুন নিয়ে খেলবেন না।”
জাতির জনকের উপরোল্লিখিত বক্তব্য থেকে এটি কাঁচের মত স্বচ্ছ যে আমাদের জাতীয়তাবাদ বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ। এ নিয়ে যে কোন বিতর্ককে তিনি ‘আগুন’ নিয়ে খেলার সাথে তুলনা করেছেন।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গণতন্ত্র সম্পর্কে উপরোল্লিখিত গণপরিষদের সপ্তদশ বৈঠকে তার ভাষণে বলেন যে-
“আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। গণতন্ত্র সেই গণতন্ত্র, যা সাধারণ মানুষের কল্যাণ সাধন করে থাকে। মানুষের একটা ধারণা এবং আগেও আমরা দেখেছি যে, গণতন্ত্র যে সব দেশে চলেছে দেখা যায় সে সব দেশে গণতন্ত্র পুঁজিপতিদের protection দেওয়ার জন্য কাজ করে এবং সেখানে শোষকদের রক্ষা করার জন্যই গণতন্ত্র ব্যবহার করা হয়। সে গণতন্ত্রে আমরা বিশ্বাস করি না।
আমরা চাই শোষিতের গণতন্ত্র এবং সেই শোষিতের গণতন্ত্রের অর্থ হল, আমার দেশের যে গণতন্ত্রের বিধিলিপি আছে, তাতে যে সব provision করা হয়েছে, যাতে এ দেশের দুঃখী মানুষ protection পায়, তার জন্য বন্দোবস্ত আছে-ঐ শোষকের। যাতে protection পায়, তার ব্যবস্থা নাই। সে জন্য আমাদের গণতন্ত্রের সঙ্গে অন্যের পার্থক্য আছে। সেটা আইনের অনেক schedule-এ রাখা হয়েছে, অনেক বিলে রাখা হয়েছে, সে সম্বন্ধে আপনিও জানেন।”
পৃথিবীতে দুধরনের গণতন্ত্র চর্চা এবং এর ব্যবহার সম্পর্কে জাতির জনক তার উপরিল্লিখিত বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে একটি হল পুঁজিবাদিদের তথা ধনীদের রক্ষার গণতন্ত্র এবং অপরটি হল শোষিতের তথা গরীব মানুষকে, অসহায় মানুষকে, নিপড়িত মানুষকে রক্ষার গণতন্ত্র। যে গণতন্ত্র ধনী শ্রেনীদের রক্ষা করে তিনি সে গণতন্ত্র প্রত্যাখান করে শোষিত তথা গরীর, দুঃখী মানুষের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছেন।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সমাজতন্ত্র সম্পর্কে উপরোল্লিখিত গণপরিষদের সপ্তদশ বৈঠকে তার ভাষণে বলেন যে-
“আমরা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি। এবং বিশ্বাস করি বলেই আমরা এগুলি জাতীয়করণ করেছি। যারা বলে থাকেন, সমাজতন্ত্র হল না, সমাজতন্ত্র হল না, তাদের আগে বুঝা উচিত, সমাজতন্ত্র কী।
সমাজতন্ত্রের জন্মভূমি সোভিয়েট রাশিয়ায় ৫০ বছর পার হয়ে গেল অথচ এখনও তারা সমাজতন্ত্র বুঝতে পারে নাই। সামজতন্ত্র গাছের ফল না-অমনি চেখে খাওয়া যায় না। সমাজতন্ত্র বুঝতে অনেক দিনের প্রয়োজন, অনেক পথ অতিক্রম করতে হয়। সেই পথ বন্ধুরও হয়। সেই পথ অতিক্রম করে সমাজতন্ত্রের পৌছানো যায়।
সে জন্য পহেলা step, যাকে প্রথম step বলা হয়, সেটা আমরা গ্রহণ করেছি-শোষণহীন সমাজ। আমাদের সমাজতন্ত্রের মানে শোষণহীন সমাজ। সমাজতন্ত্র আমরা দুনিয়া থেকে হাওলাত করে আনতে চাই না। এক এক দেশ, এক এক পন্থায় সমাজতন্ত্রের দিকে এগিয়ে চলেছে। সমাজতন্ত্রের মূল কথা হল শোষণহীন সমাজ। সেই দেশের কী climate, কী ধরনের অবস্থা, কী ধরনের মনোভাব, কী ধরনের আর্থিক অবস্থা, সবকিছু বিচেনা করে step by step এগিয়ে যেতে হয় সমাজতন্ত্রের দিকে এবং তা আজকে স্বীকৃত হয়েছে।
রাশিয়া যে পন্থা অবলম্বন করেছে, চীন তা করে নাই-সে অন্যদিকে চলেছে। রাশিয়ার পার্শ্বে বাস করেও যুগোস্লোভিয়া, মানিয়া, বুলগেরিয়া তাদের দেশের environment নিয়ে, তাদের জাতির background নিয়ে সামজতন্ত্রের অন্য পথে এসেছে। মধ্যপ্রাচ্যে যান-ইরাক একদিকে এগিয়ে চলেছে, অবার মিসর অন্যদিকে চলেছে।
বিদেশ থেকে হাওলাত করে এনে কোনদিন সামজতন্ত্র হয় না, তা যারা করেছেন, তারা কোনদিন সমাজতন্ত্র করতে পারে নাই। কারণ, লাইন, কমা, সেমিকোলন পড়ে সমাজতন্ত্র হয় না-যেমন আন্দোলন হয় না।
সে জন্য দেশের environment, দেশের মানুষের অবস্থা, তাদের মনোবৃত্তি, তাদের ‘কাস্টম’, তাদের আর্থিক অবস্থা, তাদের মনোভাব, সবকিছু দেখে step by step এগিয়ে যেতে হয়। এক দিনে সমাজতন্ত্র হয় না। কিন্তু আমরা নয় মাসে যে পদক্ষেপগুলি নিয়েছি, তা আমার মনে হয়, দুনিয়ার কোন দেশ, যার বিভক্তের মাধ্যমে Socialism করেছে, তারাও আজ পর্যন্ত তা করতে পারে নাই-আমি চ্যালেঞ্জ করছি। কোন কিছু করলে কিছু সমস্যা সৃষ্টি হয়ই। সেটা process-এর মাধ্যমে ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যায়।”
জাতির জনক এখানে নতুন সমাজতন্ত্র উপস্থাপন করেন। জাতির জনকের সমাজতন্ত্র হল “শোষনহীন সমাজতন্ত্র।” তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন সমাজতন্ত্র বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকমের। সুতরাং তিনি অন্য দেশের সমাজতন্ত্র সরাসরি আমাদের দেশে গ্রহণ না করে সম্পূর্ণ নতুন ধারার বাংলাদেশী সমাজতন্ত্র তথা “শোষনহীন সমাজের” সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করেন।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে গণপরিষদের উপরোল্লিখত সপ্তদশ বৈঠকে তার ভাষণে বলেন যে,
“জনাব স্পীকার সাহেব, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীন তা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্ম-কর্ম করার অধিকার থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মকে বন্ধ করতে চাই না এবং করব না।
ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। মুলসমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে-তাদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রে কারও নাই। হিন্দু তাদের ধর্ম পালন করবে-কারও বাধা দেওয়ার ক্ষমতা নাই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে-তাদের কেউ বাধাদান করতে পারবে না। খ্রীষ্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে-কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমাদের শুধু আপত্তি হল এই যে, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে পারবে না।
২৫ বৎসর আমরা দেখেছি, ধর্মের নামে জুয়াচুরী, ধর্মের নামে শোষণ, ধর্মের নামে বেঈমানী, ধর্মের নামে অত্যাচার, ধর্মের নামে খুন, ধর্মের নামে ব্যভিচার-এই বাংলাদেশের মাটিতে এ সব চলেছে।
ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা চলবে না।
যদি কেউ বলে যে, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে, আমি বলব, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়নি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মীয় অধিকার রক্ষা করার ব্যবস্থা করেছি।”
ধর্ম নিরপেক্ষতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে জাতির জনক স্পষ্ট করে বলেছেন যে, ধর্মকে যেন কেহ রাজনৈতিক অস্ত্র কিংবা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে না পারে সে জন্য তিনি ধর্ম নিরপেক্ষতাকে অন্যতম সংবিধানের স্তম্ভ হিসেবে রেখেছেন। তাঁর মতে এতে কোন ব্যক্তির ধর্মীয় অধিকার ক্ষুন্নের নূন্যতম কোন অংশকা নাই, বরং সত্যিকার ভাবেই ধর্মীয় অধিকার রক্ষা হবে।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উপরোল্লিখিত গণপরিষদের সপ্তদশ বৈঠকে ৭ই মার্চকে ঐতিহাসিক দিন এবং সেদিন নির্বাচনের তারিখ নির্দিষ্ট করতে তার ভাষণে বলেন যে,
“স্পীকার সাহেব, আপনার কাছে আজ আর একটা জিনিস ঘোষণা করতে চাই। আমি ইলেকশন কমিশনারের সঙ্গে কথা বলেছি। সরকারের সমস্ত সাহায্য তাকে দেব। আমি আশা করি, তিনি তা গ্রহণ করবেন। আমি উল্লেখ করছি যে, নির্বাচনের তারিখ নির্দিষ্ট করা হোক ঐ ঐতিহাসিক ৭ই মার্চে। কারণ, সেই দিন, সেই ৭ই মার্চে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের পক্ষ থেকে আমি ঘোষণা করেছিলাম ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ সেই দিন, সেই ৭ই মার্চ তারিখে বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।”
উপরোল্লিখিত বক্তব্য পাঠে এটি স্পষ্ট প্রতীয়মান যে জাতির জনক ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম” ঘোষণাকে কতটা গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি ঐ দিনকে ঐতিহাসিক দিন হিসেবে ঘোষনার আহবান জানিয়ে সে দিনকে স্মরণীয় করে রাখতে বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচনের তারিখ ৭ই মার্চ নির্ধারণ করেন।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উপরিল্লিখিত গণপরিষদের সপ্তদশ বৈঠকে তার বক্তব্য শেষ করেন এই বলে যে-
“তার চেয়ে বড় কথা আমার জীবনের আজকে সবচেয়ে আনন্দের দিন সে আনন্দ আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।
এই শাসনতন্ত্রের জন্য কত সংগ্রাম হয়েছে এই দেশে। আজকে, আমার দল যে ওয়াদা করেছিল, তার এক অংশ পালিত হল। এটা জনতার শাসনতন্ত্র। সে কোন ভাল জিনিস না দেখলে, না গ্রহণ করলে হয় না, তার ফল বোঝা যায় না।
ভবিষ্যৎ বংশধররা যদি সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, তাহলে আমার জীবন সার্থক হবে, শহীদদের রক্তদান সার্থক হবে।
আবার আপনাকে ধন্যবাদ জানাই, জনাব স্বীকার, আজকে বিদায় নেওয়া হচ্ছে। তবে সদস্যরা অবার সংবিধানে স্বাক্ষর করতে আসবেন। তারপর, যারা পাচ বছরের জন্য এসেছিলাম, তারা সেই পাচ বছর মেয়াদ পূর্ণ না হতেই চলে যাবেন। এইভাবে তারা যে ত্যাগের প্রমাণ দিলেন, উদারতা দেখালেন, সেটা পার্লামেন্টের ইতিহাসে বিরল। এর জন্য সকলকে ধন্যবাদ দিয়ে আমি বিদায় নিচ্ছি।
খোদা হাফেজ, জয় বাংলা।”
এদিন আরেকটি ইতিহাস বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গণপরিষদ করল তা হলো গণপরিষদের সকল সদস্যরা তাদের পাঁচ বৎসর মেয়ার পূর্তির তিন বৎসর আগেই স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে পৃথিবীর একমাত্র দেশ হিসেবে নজীর স্থাপন করে।
বঙ্গবন্ধু জনগণের শাষনতন্ত্রের জন্য তাঁর সমগ্র জীবন সংগ্রাম করেছেন। জনগণকে “জনগণের শাসনতন্ত্র” দেওয়ার ওয়াদা পূরণ করতে পেরে তাঁর আনন্দের কোন সীমা ছিলনা। তিনি তার শেষ ইচ্ছা প্রকাশ করে বলেছেন, যদি ভবিষৎ বংশধররা সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে শোষনহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারে তাহলে তার সারা জীবনের পরিশ্রম, সাধনা সার্থক হবে।
সংবিধানের এসকল মূলনীতি রক্ষা করার জন্য বঙ্গবন্ধু একটি স্বাধীন বিচার বিভাগের বিধান প্রনয়ণ করেছেন সংবিধানে। সদ্য পাকিস্তান থেকে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হওযা একটি দেশের জন্য তা ছিল বিস্ময়কর। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক অঙ্গীকারের জীবনাবরণ পড়লে কাঁচের মত স্পষ্ট হয়ে যায় যে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা তাঁর রাজনৈতিক সংগ্রামের অন্যতম অংশ ছিল। তাইতো তিনি ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান গণপরিষদের ভাষণে পরিস্কার করে বলেছিলেন, “In order to do justice to the people, Judiciary must be separated from the Executive.”। তিনি তাঁর কথা রেখেছিলেন। তাইতো আমাদের পবিত্র সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২২-এ রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি হিসেবে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ কথা লেখা হয় যা অবিকল নিম্নে অনুলিখন হলোঃ-
“নির্বাহী বিভাগ হইতে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ-
২২। রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গসমূহ হইতে বিচারবিভাগের পৃথকীকরণ রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন।”
মুজিব বর্ষে দাঁড়িয়ে, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে জাতির পিতার সোনার বাংলাদেশ তথা একটি শোষনহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার শপথ হোক আজ আমাদের সকলের অঙ্গীকার।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু
বাংলাদেশ চিরজীবি হোক।
লেখক: বিচারক; হাইকোর্ট বিভাগ, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট