কাজী শরীফ:
গত শুক্রবার একটা জরুরি কাজে ফেণী যাই। ফেণী থেকে আসার পথে যাত্রীদের মাগরিবের নামাজ আদায়ের উদ্দেশ্যে বাস মিরসরাই বাজারে যাত্রাবিরতি দেয়। নামাজের বিরতির পর যে যার মত বাসে উঠে বসে। আমিও বসলাম। দেখি একটা মানুষ “আমি এ বাসের যাত্রী” বলতে বলতে দ্রুত তার সিটে গিয়ে বসে। তাকে অনুসরণ করে আসা ছয় সাত জন লোক শার্টের কলার ধরে তাকে টেনেহিঁচড়ে নামাতে চায়। কেনো জানি মনে হলো লোকগুলো পাওনাদার। বাসের লোক টাকা মেরে দিয়ে লাপাত্তা হয়ে গিয়েছিল। আচমকা পেয়ে বাস থেকে নামিয়ে ফেলছে। পরক্ষণেই বুঝলাম ভদ্রলোক বলছেন “আমি এ বাসের লোক ভাই। আমার কথাটা শোনেন।”
তার কথা কেউ শোনে না। গালাগাল করতে করতে তাকে বাস থেকে নামিয়ে ফেলছে। আমি জোরের সাথে বললাম “কী হয়েছে ভাই? সমস্যা কী? ওনাকে এভাবে নামাচ্ছেন কেন?”
সঙ্গে সঙ্গে একজন উত্তেজিত হয়ে আমার দিকে তেড়ে এসে বলে “আপনি কে?”
অবস্থা বেগতিক দেখে নিজের পদবি বললাম। মুহুর্তেই শান্ত হয়ে গেল। বলল, ‘এ লোক জুতাচোর। প্রতিদিন এ মসজিদ থেকে চার পাঁচ জোড়া জুতা চুরি হয়। রাস্তার ওপর মসজিদ। চোর জুতা নিয়েই বাসে উঠে যায়।’
বলতে পারতাম “চোরের শাস্তি আপনারা কেন দেবেন। পাশেই মিরসরাই থানা। থানায় নিয়ে যেতে পারেন।”
বলিনি কারণ উত্তেজিত জনগণকে এ মুহুর্তে আইন বোঝানো যাবে না।
বললাম দুটো বিষয় পরিষ্কার হতে হবে।
১. তিনি এ বাসের যাত্রী কিনা?
২. তার কাছে জুতো পেয়েছেন কিনা?
সুপারভাইজারকে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন ভদ্রলোক এ বাসের। ফেণী থেকে রানিং বাসে উঠেছেন। টিকেট দেয়া হয়নি।
তার কাছে জুতো পেয়েছেন কিনা এ প্রশ্ন করার পর এক মহিলা পেছন থেকে বলেন তার কোমর থেকে নাকি চার পা জোড়া জুতো উদ্ধার হয়েছে।
আশ্চর্যের ব্যাপার হলো মহিলা বাসেই বসা ছিলেন। তিনি নামাজের বিরতিতে নামেন নি। তবু এ মন্তব্য করে ফেলেছেন। এটাকেই গুজব বলে। তাকে খুবই বকা দিলাম। উস্কানি দেয়ার জন্য বকাটা তার প্রাপ্যই ছিল।
যে তাকে কলার ধরে রেখেছিলেন তাকে জিজ্ঞেস করলাম “আপনি কি জুতোসহ তাকে পেয়েছেন?”
বলে না। তিনি নামাজের পর মসজিদের পেছনের দিকে যাচ্ছিলেন ইতস্তত হয়ে।
ভদ্রলোকের দিকে তাকাতেই বলল “ভাই প্রশ্রাব করতে যাচ্ছিলাম। টয়লেট কোন দিকে বুঝতে পারছিলাম না। মাগরিবের নামাজে সময় কম। ইমাম সাহেবকে জামাতে ধরতে তাড়াতাড়ি দাঁড়িয়ে যাই।”
আমি বললাম “দেখলেন তো! কোন প্রমাণ নাই। তবু একজনকে আজ চোর বানিয়ে ফেলছিলেন।”
তাকে নিয়ে বাসে উঠে গেলাম। বাস ছেড়ে দিল। লোকটা কেমন অপ্রস্তুত হয়ে গেল। চারপাশের মানুষ তার দিকে তাকিয়ে আছে।
সুপারভাইজারকে বললাম “বাসের লাইট বন্ধ করে দেন। আমি ঘুমাবো।”
আসলে কারো বিব্রত চেহারা দেখতে ভালো লাগে না।
আপনাদের কাছে অনুরোধ গুজবের কারণে বড় অঘটন ঘটতে পারে। একজন মহিলাকে ছেলেধরা বলে বছর দুয়েক আগে মেরে ফেলেছিল। যার চলে যায় সেই বোঝে হায় বিচ্ছেদের কী যন্ত্রণা!
আওয়াজ তুলবেন। জিজ্ঞাসা করবেন। পারলে মানুষকে বিপদ থেকে উদ্ধারের চেষ্টা করবেন। আপনার চুপ করে থাকায় যদি কোন নিরপরাধ মানুষ বিপদে পড়ে আপনি সে দায় এড়াতে পারেন না।
লেখক- সহকারী জজ, নোয়াখালী।