খুরশিদ কামাল তুষার: স্কুলে থাকতে বাংলায় রচনা লিখছি, সমাজবিজ্ঞানে প্রশ্নের উত্তরে মাদকাসক্তি নিয়ে লিখছি। সামাজিক অপরাধের এই বিষয়গুলোর ব্যাপারে ছেলেবেলা থেকেই ধারণা দেয়া হয়, বিপথে যাওয়ার থেকে বাচানোর জন্য। কিন্তু বছরের পর বছর অসংখ্য কিশোর তরুন যুবক সেই মাদকাসক্তই হচ্ছে, বাড়িয়ে চলছে সামাজিক অপরাধ।
মাদকের অর্থের জোগান দিতে কিংবা খুব সহজে টাকা উপার্জনে সাম্প্রতিককালে চাঁদাবাজদের দৌরাত্ব চোখে পড়ার মত। কথায় বলে নিজ এলাকায় কুকুরও বাঘ, সেরকমই এলাকার প্রভাব খাটিয়ে অথবা বিভিন্ন ক্ষমতার জোর দেখিয়ে অর্থ সম্পদ হাতিয়ে নেয়া যেন একপ্রকার রীতি হয়ে দাড়িয়েছে।
উঠতি বয়সের তরুন-যুবকদের মাঝে এ প্রবণতা আরো বেশি। একদিকে সরকার আইন তৈরী ও তার প্রয়োগে কঠোর হচ্ছে, অন্যদিকে সেই আইনকেই যেন বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে দিনকে দিন বেড়েই চলেছে অপরাধ, তৈরী হচ্ছে কিশোর গ্যাং এর মত ভয়ানক সব চাঁদাবাজের দল। গ্রাম কিংবা শহর কোন এলাকাই রেহাই পাচ্ছে না এদের দৌরাত্ব থেকে।
একুশ শতক যখন নারীর ক্ষমতা, সমতা নিয়ে কথা বলে, নারীর স্বাধীনচেতা স্বভাবকে তখনও চোখ রাঙ্গায় সমাজ। আর কখনো কখনো তারই সুযোগ নেয় এসব কিশোর অপরাধীরা। অচেনা ছেলেমেয়ে একসাথে চলতে দেখলেই যেন অর্থের নেশা মাথা চাড়া দেয়। তখন টাকা পাবার জন্য বলপূর্বক চাদাবাজি করে। অপরিচিত কাউকে দেখলেই ফাঁদে ফেলে, ভয় দেখিয়ে টাকা-মোবাইল বা মূল্যবান জিনিস হাতিয়ে নেয়া যেন নৈমিত্তিক কাজ এদের।
>> এ ধরনের অপরাধের স্বীকার হলে একজন ভুক্তভোগী যা করতে পারেঃ
সম্ভব হলে ঘটনাস্থল থেকেই পুলিশকে জানাতে পারে অথবা পরবর্তীতে নিকটস্থ থানায় মামলা করতে পারে। যদি কোন কারনে থানায় মামলা নিতে পুলিশ অস্বীকৃতি জানায় কিংবা পরিস্থিতি এমন হয় যে থানায় মামলা করতে গেলে পথে বিপদের শঙ্কা আছে, সেক্ষেত্রে ভুক্তভোগী সরাসরি লিখিতভাবে মেজিস্ট্রেটের নিকট মামলার জন্য আবেদন করতে পারে। মেজিস্ট্রেট ফৌজদারী কার্যবিধির ধারা ২০০ অনুসরণ করে মামলা আমলে নেবেন এবং ধারা ১৭৫ মতে পুলিশকে তদন্তের নির্দেশ দিলে তবেই মামলা আমলে নেয়া বলে গণ্য হবে এবং মামলা শুরু হবে।
>> অপরাধ সংঘটনের শাস্তিঃ
এই ধরনের অপরাধ বিষয়ে দন্ডবিধি, ১৮৬০ এর ধারা ৩৮৩ -৩৮৯ পর্যন্ত বর্ণ্না রয়েছে। ধারা ৩৮৩ বলে, যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে কাউকে ক্ষতি করার ভয় দেখিয়ে কোন মূল্যবান কিছু হাতিয়ে নেয়, তা বলপূর্বক গ্রহন হবে এবং ধারা ৩৮৪ মতে এ অপরাধের জন্য ৩ বছরের কারাদন্ড বা জরিমানা অথবা কারাদন্ডসহ জরিমানায় দন্ডিত হতে পারে।
আবার যদি জখম করে বা জখম করার ভয় দেখিয়ে মূল্যবান সম্পদ আদায় করে তবে ৩৮৫ ধারা মতে ৫-১৪ বছর পর্যন্ত কারাবাস বা জরিমানা বা জরিমানা সহ কারাবাস হতে পারে।
একই কাজ মৃত্যুভয় দেখিয়ে করলে ধারা ৩৮৬ মতে জরিমানা ও দশ বছর পর্যন্ত কারাবাস হতে পারে।
তবে এসব ক্ষেত্রে দেখা যায় মামলা তদন্তের দীর্ঘসূত্রিতা সহ বিভিন্ন কারনে বিচার পেতে অনেক দেরী হয়ে যায়। আসামিপক্ষ প্রভাবশালী হলে ভয় দেখিয়ে মামলা তুলে নেয়ার ঘটনাও ঘটে।
তবে ভুক্তভোগী চাইলে আইন-শৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ (দ্রুত বিচার) আইন, ২০০২ এর অধিনে মামলা করতে পারে। এ আইনের ধারা ২ এ যে সাত ধরনের অপরাধকে আইন-শৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ বলা হয়েছে তার প্রথমেই চাঁদাবাজির কথা রয়েছে। এ আইনে মামলা হলে ধারা ৪ ও ৫ মতে অপরাধী ও অপরাধে সহায়তাকারীর জরিমানা সহ ২-৭ বছরের কারাদন্ড হতে পারে। আর ধারা ১০ বলে মামলা ৩০-৬০ কর্মদিবসের মধ্যে নিস্পত্তির বিধান রয়েছে।
এসব অপরাধ দমনে জেল-জরিমানা যতটা না কার্যকর , তার চেয়ে বেশি কার্যকরী ভুমিকা রাখতে পারে আমাদের সমাজ, পরিবার। সন্তান বিপথে যাবার আগেই লাগাম টেনে ধরতে হবে পরিবারকে। মাদক বা চাঁদাবাজি বন্ধে এগিয়ে আসতে পারে সমাজ।
কথায় আছে কাঁচায় না নোয়ালে বাঁশ , পাকলে করে টাসটাস। তাই সময় থাকতেই বিপথে যাওয়া না রুখলে, আজ ভয় দেখিয়ে চাঁদাবাজি করা ছেলেটি কাল মানুষ খুন করতেও পিছপা হবেনা।
হোক প্রতিবাদ। সচেতন হোক জনতা। সুন্দর হোক সমাজ, রাষ্ট্র।
লেখক: খুরশিদ কামাল তুষার, আইন, তৃতীয় বর্ষ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।