কাজী শরীফ: ঘটনাটা গত বৃহস্পতিবারের। সকাল থেকে আমার শরীর ভীষণ খারাপ। আগের দিন নানা ধরনের খাবার খাওয়ায় হজমে সমস্যা হয় ৷ ফলশ্রুতিতে সকালে বমিটমি করে একাকার ৷ এরপরও অফিসে যাই। যথাসময়ে এজলাসেও উঠি। এমনিতে বৃহস্পতিবার এজলাস করতে আমার ভালোই লাগে। কারণ সেদিন অফিস শেষে চাটগাঁ আসব ৷ দেড়শত কিলোমিটার পাড়ি দিলেই পরিবারের সদস্যদের সাথে দেখা হবে সে আনন্দে কাজ করতে একদমই মন্দ লাগে না।
গত সপ্তাহের বৃহস্পতিবার কাজ করছিলাম সারাহর ভাত খাওয়ার মত করে। ওর মা ওকে জোর করে খাওয়ায়। ওর খেতে ইচ্ছে করে না ৷ এক প্রকার বাধ্য হয়ে গিলে কিন্তু স্বাদ লাগে না ৷ আমিও তেমনি বিরসমুখে সাক্ষীদের জেরা জবানবন্দি লিখেই যাচ্ছি।
তখন দুপুর প্রায় দেড়টা। বিবাদীর জেরা চলছে। জেরা চলার সময় সাক্ষীর নিজপক্ষের আইনজীবীও দাঁড়িয়ে থাকেন। তার দাঁড়িয়ে থাকার আসলেই কোন প্রয়োজন নেই। জেরা করছেন অপরপক্ষের আইনজীবী। তিনি কেন দাঁড়িয়ে থেকে কষ্ট করেন এমন বোকাবোকা ধরনের প্রশ্ন একদিন আমি এক বিজ্ঞ আইনজীবীকে করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন “স্যার আমি থাকলে সাক্ষীর সাহস লাগে।”
বললাম “সাহস লাগে মানে ? যিনি উত্তর দিবেন তিনিতো তার দাবি সম্পর্কে জানেনই। প্রশ্ন করলে কেবল উত্তর দিবেন। না জানলে জানি না বলবেন। আর প্রশ্নকর্তা সত্যের বিপরীত প্রশ্ন করলে তিনি সত্য নয় বলবেন।” খুবই সহজ কাজ বলে আমার মনে হলো।
উত্তরে বিজ্ঞ আইনজীবী বলেছিলেন “স্যার প্রতিপক্ষের আইনজীবী সিনিয়র মানুষ। আমার সাক্ষীকে পেঁচাই ধরবে। আমি থাকলে সাহস পাবে।” এটা বলেই তিনি প্রতিপক্ষের আইনজীবীর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন।
উভয় আইনজীবীর পারষ্পরিক হৃদ্যতাপূর্ণ খুনসুটির ফাঁকে মনে হলো যুক্তিটা খারাপ না। আমার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার সময় আমার জেঠাতো ভাইয়ের বিয়ে ছিল। বাসার সবাই গিয়েছিল। আম্মা যায়নি। আম্মা বলছিল “আমি থাকলে আমার ছেলের সাহস লাগবে।”
আইনজীবী ও মক্কেলের সম্পর্ক যেহেতু বিশ্বাসের সেহেতু আইনজীবী থাকলে জেরার কঠিন রাস্তা পার হতে মক্কেলের সাহস লাগা অস্বাভাবিক নয়।
কিন্তু এর কিছুদিন পর আবিষ্কার করলাম জেরায় লিডিং কোয়েশ্চেন ( ইঙ্গিতপূর্ণ প্রশ্ন) করলে সাহস দেয়া আইনজীবী মাথা নেড়ে হ্যাঁ /না উত্তর দিতে সাক্ষীকে ইঙ্গিত করেন। এতে জেরাকারী আইনজীবী বিরোধিতা করেন। আমি সাক্ষীর পক্ষের আইনজীবীকে বসতে বলি। তিনি একটু গড়িমসি করে বসেন। দু/চার মিনিট পর তার ভাষায় “সাক্ষীকে সাহস দিতে” আবার উঠে দাঁড়ান ও মাথা নাড়া শুরু করেন। আগেই বলে রাখি এ কাজ সবাই করেন না। কেউ কেউ করেন।
তেমন একদিনের ঘটনা। একজন বিজ্ঞ আইনজীবী বলছেন “বিবাদী পক্ষের উকিল সাহেব তো এলেন না। আজ তাহলে জেরা হবে না!”
আমি বললাম আপনারতো বিশেষ কাজ নেই। আপনি চলে যেতে পারেন। উনি এলে সাক্ষীকে জেরা করবেন। সাক্ষী থাকলেই চলবে।”
তিনি বললেন “তবু স্যার আমি থাকা অবস্থায় জেরা করলে ভালো হয়।”
আমি বললাম “মাথা নাড়ানোর জন্যই তো। আচ্ছা আমিই নাড়িয়ে দেবো!” এটা বলার সঙ্গে সঙ্গে ঐ উকিল সাহেবসহ পুরো কোর্টে হাসির রোল পড়ে গেলো!”
উল্লেখ্য সে উকিল সাহেবের মাথা নাড়ানোর অভ্যাস আমার ও তার সহকর্মীদের জানা!
যাহোক বৃহস্পতিবারের ঘটনায় আসি। বিবাদীপক্ষের সাক্ষীর জেরা চলছে। সাক্ষীও জবাব দিচ্ছেন। বাদীপক্ষের আইনজীবীও দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি সাক্ষীকে “সাহস দিচ্ছেন” না!
কিছুক্ষণ পর বাদীপক্ষের উকিল সাহেব বলছেন “স্যার লার্নেড সিনিয়র সাক্ষীকে সিগনাল দিচ্ছেন!”
আমি বললাম কী বলেন! উনিতো কিছুই বলছেন না।
বাদীপক্ষের আইনজীবী বলেন, “স্যার, সিনিয়র মাস্কে হাত দিলে বা মাস্ক খুললে সাক্ষী প্রশ্নের উত্তরে না বলে আর সিনিয়র নরমাল থাকলে সাক্ষী হ্যাঁ বলে!”
আমি খুবই অবাক হলাম। বাদীপক্ষের আইনজীবীর দিকে অবাক চোখে তাকাতেই তিনি বলেন ” আমি আবার কী করলাম! মাস্কও খোলা যাবে না স্যার!”
মাস্ক নিয়ে এমন অভিনব অভিযোগ পেয়ে ক্লান্ত শরীরেও আমার হাসি আসছিল। সর্বোচ্চ চেষ্টা করে হাসি লুকিয়ে বললাম আচ্ছা লার্নেড আপনি বসুন।
জেরা চলুক।
উনি কিছুক্ষণ পর সম্ভবত “সাক্ষীকে সাহস দিতে” উঠে দাঁড়ালেন।
কয়েক সেকেন্ডর মধ্যে জেরাকারী আইনজীবী একটা প্রশ্ন করলেন যার উত্তর হ্যাঁ / না দিয়ে দেয়া যায়। সাক্ষী জবাবে না বলার সাথে সাথেই বাদীপক্ষের তরুণ আইনজীবী বলছেন “স্যার দেখেন আমার কথা সত্য কি না। সিনিয়রের হাতে মাস্ক ৷ উনি মাস্ক খুললেই বা মাস্কে হাত দিলেই সাক্ষী প্রশ্নের জবাবে না বলে!”
আমি খুবই অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম ৷ কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। বিবাদীপক্ষের উকিল সাহেবকে বললাম “লার্নেড আপনি বারবার মাস্ক খোলেন কেন ? করোনা বেড়ে গেছে। মাস্ক খুলবেন না!”
তিনি বললেন “স্যার মাস্কে দমবন্ধ হয়ে আসে!”
বললাম “মাস্ক না পরলে চিরদিনের জন্য যদি দমবন্ধ হয়ে যায় ! সেটা কী ভালো হবে!”
তরুণ আইনজীবীকে বললাম “আজ আর জেরা হবে না। আগামী তারিখে আবার জেরা হবে।”
তিনি বললেন “স্যার আপনি সিনিয়রকে বলে দেন তিনি যেন আগামী তারিখে মাস্ক নিয়ে এমন না করেন।”
আচ্ছা বলে দেবো বলেই বাদীপক্ষের আইনজীবীকে বললাম “লার্নেড বাঁচতে হলে মাস্ক পরতে হবে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনাও তা। আগামীদিন থেকে আর কেউ মাস্ক খুলবেন না। এমন মাস্ক বিষয়ক আপত্তির মুখে আর পড়তে চাই না।”
এরপর হাসতে হাসতে বললাম “নিক্সনের ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির কথা জেনেছি, অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দলের তৎকালীন অধিনায়ক স্টিভেন স্মিথ গং এর স্যান্ডপেপার কেলেঙ্কারি দেখেছি আর আজ জানলাম ঐতিহাসিক “মাস্ক কেলেঙ্কারি! নোয়াখালী কত অভিজ্ঞতা আমায় দিল!”
এ কথা বলার পর দুই আইনজীবীই আমার সাথে হাসতে শুরু করলেন।
পিয়ন “আদালত নামছে” বলে জোরে হাঁক দিল। আমিও মাস্ক বিষয়ক বিচিত্র অভিজ্ঞতা নিয়ে এজলাস থেকে নামলাম।
একদিন পিয়নের এ ডাক থাকবে না। আমি চলে যাব অবসরে, বিজ্ঞ আইনজীবীরাও হয়তো বয়সের ভারে নুজ হবেন। ততদিনে জীবন থেকে অবসরে না গেলে নাতি নাতনিদের নিয়ে গল্প করব আর হো হো করে হাসতে হাসতে বলব ঐতিহাসিক মাস্ক কেলেঙ্কারির কথা !
কাজী শরীফ – সহকারী জজ, নোয়াখালী।