মোঃ কামাল হোসেন:
জনাব ইসমাইল হোসেন চাকরিতে যোগদানের সময় একটি ব্যাংকে নিজের একাউন্ট খোলেন। নিয়মানুসারে একাউন্ট খোলার সময় তিনি নমিনী হিসেবে তার বড় ভাইকে মনোনয়ন দেন। পরবর্তীতে তিনি আর নমিনী পরিবর্তন করেননি। অনেক বছর পর হঠাৎ করেই জনাব ইসমাইল হোসেন মারা গেলেন তার একাউন্টে অনেক টাকা রেখে। ইসমাইল হোসেনের বর্তমানে দুই সন্তান ও স্ত্রী রয়েছে।তারা ব্যাংক থেকে টাকা উঠানোর জন্য গিয়ে দেখেন নমিনী তারা কেউ না যার ফলে তারা টাকা উঠাতে পারবেন না।মৃত ব্যক্তির বড় ভাইয়ের সাথে কথা বললে তিনি বিভিন্ন ধরণের টালবাহানা শুরু করেন। এমতাবস্থায় মৃতের পরিবার অসহায় হয়ে পড়ে।
এরকম ঘটনা আমাদের সমাজে অনেক আছে।তাই আসুন জেনে নিই মৃত ব্যক্তির ব্যাংক একাউন্টে জমানো টাকা কে পাবে।
নমিনী সংক্রান্ত আইনী বিধান কি-
ব্যাংক কোম্পানী আইন, ১৯৯১ এর ১০৩ ধারায় বর্নিত বিধান অনুযায়ী-
(১) ব্যাংকে কোন ব্যক্তি আমানত জমা রাখলে তিনি/ তারা একজন বা একাধিক ব্যক্তিকে নমিনী মনোনীত করতে পারবেন।নমিনী মনোনীত করার উদ্দেশ্য হলো যাতে আমানতকারীর বা আমানতকারীগণের মৃত্যুর পর, আমানতের টাকা নমিনীকে প্রদান করা যেতে পারে।আমানতকারী বা আমানতকারীগণ যে কোন সময় পূর্বে মনোনীত নমিনী বাতিল করে অন্য কোন ব্যক্তিকে বা ব্যক্তিবর্গকে নমিনী মনোনীত করতে পারবেন।
(২) নমিনী নাবালক হলে, তাঁর নাবালক থাকা অবস্থায় আমানতকারীর বা আমানতকারীগণের মৃত্যু হলে, আমানতের টাকা কে গ্রহণ করবেন সেই সম্পর্কে আমানতকারী বা আমানতকারীগণ নির্দিষ্ট করে দিতে পারবেন৷
(৩) আপাততঃ বলবৎ অন্য কোন আইনের বা কোন উইলে বা সম্পত্তি বিলি বণ্টনের ব্যবস্থা সম্বলিত অন্য কোন প্রকার দলিলে যা কিছুই থাকুক না কেন, আমানতকারী বা আমানতকারীগণের মৃত্যুর পর আমানতের টাকার যাবতীয় অধিকার নমিনী লাভ করবেন। অন্য যে কোন ব্যক্তি উক্ত অধিকার দাবি করলেও সে ব্যক্তি উক্ত অধিকার পাবেন না।
(৪) এ ধারায় অধীনে ব্যাংক নমিনীকে টাকা পরিশোধ করলে সংশ্লিষ্ট আমানত সম্পর্কিত ব্যাংকের যাবতীয় দায় পরিশোধ হয়েছে বলে গণ্য হবে।তবে অন্য কেউ উক্ত অর্থের কোন অধিকার বা দাবী করলে সেটা তিনি করতে পারেন; সেক্ষেত্রে এই উপ-ধারার বিধান প্রয়োগ বাধা হবেনা।
সুতরাং ব্যাংক কোম্পানী আইন, ১৯৯১ (২০১৮ পর্যন্ত সংশোধিত) এর ১০৩ ধারা অনুযায়ী কোন একাউন্ট হোল্ডার/ আমানত জমাকারী যদি মৃত্যুবরণ করেন তাহলে একাউন্টে গচ্ছিত টাকা নমিনী পাবেন।
এক্ষেত্রে ব্যাংকের করনীয় হচ্ছে মৃত ব্যক্তির একাউন্টে গচ্ছিত টাকা নমিনীকে প্রদান করা। কোন ওয়ারিশ/ ওয়ারিশগণ উক্ত টাকার মালিকানা দাবি করলে তিনি/ তারা প্রচলিত আইন অনুযায়ী আদালতের মাধ্যমে উক্ত টাকার মালিকানা দাবি করতে পারবেন। ব্যাংক নমিনীকে গচ্ছিত টাকা প্রদান করবেন আর মালিকানা সংক্রান্ত কোন বিষয় থাকলে তা আদালত সিদ্ধান্ত প্রদান করবেন।এক্ষেত্রে, মালিকানার দাবিকারী/ দাবিকারীগন ব্যাংকে লিখিত অভিযোগ দিলেও সেটা গ্রহণযোগ্য নয়, ব্যাংক নমিনীকে টাকা প্রদান করে দিবেন। কেবল আদালতের চূড়ান্ত কোন নির্দেশনা থাকলে সেটা বিবেচ্য হতে পারে।একাউন্ট হোল্ডার/ আমানত জমাকারী যদি মৃত্যুবরণ করেন তাহলে একাউন্টে গচ্ছিত টাকা নমিনী পাবেন এটাই প্রশ্নাতীত ভাবে বহুকাল হতে চালু আছে। কিন্তু গত ০৩ এপ্রিল ২০১৬ তারিখে সঞ্চয়পত্রের অ্যাকাউন্টধারী মারা গেলে ওই সঞ্চয়ের টাকা নমিনীর (মনোনীত ব্যক্তির) পরিবর্তে ব্যক্তির উত্তরাধিকারী পাবেন বলে রায় দিয়েছিল মহামান্য হাইকোর্ট। রায় বলা হয়েছে, নমিনি হবেন একজন ট্রাস্টি। উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী নমিনি টাকাটা উত্তোলন করে উত্তরাধিকারীদের মাঝে বণ্টন করে দেবেন।পরবর্তীতে, হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল দায়ের করা হয়েছে। আপিল বিভাগ হাইকোর্টের দেয়া রায়কে স্থগিত করেন। মামলাটি বর্তমানে আপিল বিভাগে চলমান আছে। মামলার চুড়ান্ত রায় হলে নমিনী বনাম ওয়ারিশ বিষয়ের সিদ্ধান্ত জানা যাবে।
তবে হাইকোর্টের রায় স্থগিত থাকায় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নির্দেশনা প্রদান করে বলা হয় একাউন্টে থাকা টাকা নমিনীর কাছেই হস্তান্তর করতে হবে, তবে সেই টাকার মালিকানার বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।
তবে, অর্থের কোন অধিকার বা দাবী করলে তিনি প্রচলিত আইন অনুযায়ী আদালতের মাধ্যমে তা করতে পারেন। যেহেতু বর্তমানে এই বিষয়টি মহামান্য আপিল বিভাগে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে সুতরাং আমাদের সেই রায় না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত পৌঁছাতে।
লেখক- সহকারী ব্যবস্থাপক (আইন), বিজিডিসিএল, কুমিল্লা।