সিরাজ প্রামাণিক : জমির রেজিষ্ট্রির পর দলিলে দাগ, খতিয়ান, মৌজা, চৌহদ্দি বা নামের বানানে কোন প্রকার ভুল ধরা পড়লে কি করবেন, কিভাবে সংশোধন করবেন, সংশোধন না করলে আপনি কি কি সমস্যায় পড়তে পারেন, আর সংশোধনের জন্য আপনাকে কোথায় যেতে হবে, কত টাকা খরচ হবে-সেসকল বিষয়ে আলোচনা জানুন।
শুরুতেই বলে রাখি দলিল রেজিস্ট্রির তারিখ থেকে ৩ বছরের মধ্যে দেওয়ানি আদালতে দলিল সংশোধনের মোকদ্দমা করতে হবে। ৩ বছর পর এই ধরনের মোকদ্দমা তামাদির কারণে বারিত হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে তখন আর দলিল সংশোধনের মোকদ্দমা করা যায় না, তখন ঘোষণামূলক মোকদ্দমা করা যায়। এক্ষেত্রে আদালত কর্তৃক মামলার যে রায় দেয়া হয়, সেটাই হচ্ছে সংশোধন দলিল। অর্থাৎ রায়ের একটি সার্টিফাইড কপি আদালত থেকে সংশ্লিষ্ট সাব-রেজিষ্টার এর কাছে পাঠানো হলে সাব-রেজিষ্টার উক্ত রায়ের আলোকে সংশ্লিষ্ট ভলিউম সংশোধন করে নিবেন। এক্ষেত্রে আর নতুন করে কোন দলিল করার প্রয়োজন নেই। আপনাদেরকে জানিয়ে রাখি সিভিল আদালতের অধিকাংশ মামলা ১৮৭৭ সালের সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন অনুসারে পরিচালিত হয়। যেমন-স্বত্বের মামলা, দখল উদ্ধারের মামলা, চুক্তির সুনির্দিষ্ট কার্য সম্পাদনের মামলা, দলিল সংশোধনের মামলা, চুক্তি বাতিলের মামলা, দলিল বাতিলের মামলা, ঘোষণামূলক মামলা, নিষেধাজ্ঞা মামলা ইত্যাদি।
১৮৭৭ সালের সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৩১ ধারায় বলা হয়েছে, যেক্ষেত্রে প্রতারণা অথবা পক্ষগণের পারস্পরিক ভুলের জন্য কোন লিখিত দলিল হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে দলিলের যে কোন পক্ষ অথবা তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধি দলিলটি সংশোধনের জন্য মামলা দায়ের করতে পারে। তবে মনে রাখবেন, দলিল সংশোধনের মামলায় প্রতারণা বা পারস্পরিক ভুল অবশ্যই থাকতে হবে। তা না হলে দলিল সংশোধনের মামলা দায়ের করা যাবে না। প্রতারণা বা পারস্পরিক ভুল আদালতের নিকট অবশ্যই প্রমাণিত হতে হবে। উভয় পক্ষের সাধারণ ভুল থাকতে হবে, যেকোন এক পক্ষের ভুল থাকলে চলবে না।
একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি আরও পরিস্কার হয়ে উঠবে। ধরুন, রহিম মিয়া লেখাপড়া জানে না। তার কুষ্টিয়ার খোকসা মৌজায় ৫১,৫২ ও ৫৩ দাগে তিন খন্ড জমি ছিল। অভাবের কারণে রহিম মিয়া ৫১ দাগের জমিটি আব্দুল ফজলু মিয়ার নিকট বিক্রি করে। ফজলু মিয়া গ্রামের চালাক প্রকৃতির লোক। তিনি দলিল লেখকের সাথে যোগসাজস করে দলিল রেজিস্ট্রির সময় ৫১ দাগের সাথে প্রতারণামূলকভাবে এবং সুকৌশলে রহিম মিয়ার বাকী দুটি ৫২ ও ৫৩ দাগের জমিও দলিলে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। নিয়ম অনুযায়ী দলিলটি রেজিস্ট্রি হয়ে যায়। সহজ সরল রহিম মিয়া পরবর্তী সময়ে ৫২ দাগের জমিটি তার ছোট ভাই সাদেক মিয়াকে দান করে দেন এবং ৫৩ দাগের জমিটি জনৈক রাশেদের নিকট বিক্রি করেন। সাদেক এবং রাশেদ জমির দখল নিতে গেলে সেই চালাক ফজলু মিয়া বাঁধার সৃষ্টি করে। তখনই প্রতারণার মূল রহস্য বেরিয়ে আসে। এমতাবস্থায় সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৩১ ধারা অনুসারে দলিল সংশোধনের মামলা করলে ৫২ দাগের জমি সম্পর্কে দলিল সংশোধনের প্রতিকার পাবে। তার মানে ৫২ দাগ সম্পর্কে দলিল সংশোধিত হবে। কারণ এই জমি রহিম মিয়া তার ছোট ভাই সাদেক মিয়াকে দান করেছিল। কিন্তু ৫৩ দাগের ক্ষেত্রে দলিল সংশোধনের কোন প্রতিকার পাবে না। কারণ রাশেল সরল বিশ্বাসে মূল্যের বিনিময়ে ৫৩ দাগের জমি ক্রয় করেছে। তবে ৫৩ দাগের জমির জন্য রহিম মিয়া ফজলু মিয়ার নিকট থেকে ক্ষতিপূরণ পাবে। মনে রাখবেন দলিল সংশোধনের মামলায় আরজিতে ক্ষতিপূরণের বিকল্প প্রার্থনা রাখতে হবে। তবে আরজিতে ক্ষতিপূরণের বিকল্প প্রার্থনা না থাকলেও আদালত তার সুবিবেচনা প্রয়োগ করে ক্ষতিপূরণের আদেশ দিতে পারেন।
আমি আগেই বলেছি প্রতারণার ফলে, পক্ষগণের পারস্পরিক ভুলের জন্য কিংবা পক্ষগণের প্রকৃত মনোভাব যদি দলিলে ভুলভাবে লিখিত হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কারা দলিল সংশোধনের মামলা করতে পারে। সহজ উত্তর দলিলের যে কোন পক্ষ, স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিগণ, দলিলের যে কোন পক্ষের উত্তরাধিকারীগণ, দলিলের যেকোন পক্ষের নিকট হতে হস্তান্তর গ্রহীতাগণ, দলিলের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণ।
এবার আমরা জেনে নিই কখন দলিল সংশোধন করা যায় না। যখন তৃতীয় ব্যক্তি যথাযথ মূল্যের বিনিময়ে সরল বিশ্বাসে জমি ক্রয় করেন তখন তার অধিকার হস্তক্ষেপ করে দলিল সংশোধন করা যায় না। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আপনাদের মাঝে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে। ধরুন কুলসুম খাতুন ৪৯৬ দাগের সম্পত্তি হানিফা খাতুনের নিকট বিক্রি করেন। হানিফা খাতুন দলিল লেখকের সাথে যোগসাজশ করে কুলসুম খাতুনের ৪৯৭ দাগের সম্পত্তিটিও দলিলে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। পরবর্তী সময়ে হানিফা খাতুন ৪৯৭ দাগের সম্পত্তিটি চম্পা খাতুনের নিকট বিক্রি করে। চম্পা খাতুন সরল বিশ্বাসে জমিটি ক্রয় করে। এক্ষেত্রে কুলসুম খাতুন ৪৯৭ দাগের সম্পত্তির জন্য দলিল সংশোধনের প্রতিকার পাবে না। কারণ চম্পা খাতুন সরল বিশ্বাসে জমিটি ক্রয় করেছে। এখানে কুলসুম খাতুন ৪৯৭ দাগের সম্পত্তির জন্য হানিফা খাতুনের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ পাবে।
এখন আমরা জেনে নিই কোন কোন দলিল সংশোধনের জন্য আপনি আদালতে যেতে পারবেন। রেজিষ্ট্রি দলিল অর্থাৎ কবলা দলিল, লিখিত চুক্তিপত্র, বন্ধকী দলিল সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৩১ ধারা অনুসারে সংশোধন করা যায়। মনে রাখতে হবে, দলিল সংশোধনের মামলা করলেও আদালত কিন্তু তার বিবেচনামূলক ক্ষমতা প্রয়োগ করে দলিল সংশোধনের আদেশ দিবেন। তবে আদালতের বিবেচনামূলক ক্ষমতা কোন ক্রমেই স্বেচ্ছাচারী হবে না-এমনটিই সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ২২ ধারায় বলা আছে।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’।
Email: seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮