সিরাজ প্রামাণিক :
সম্প্রতি গুলশানের ফ্ল্যাট থেকে মোসারাত জাহান নামে কলেজ পড়ুয়া এক ষোড়শীর লাশ উদ্ধার আর বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহান আনভীরকে জড়িয়ে আত্মহত্যার প্ররোচনার মামলা বিষয়ে আইন কি বলে-সেসব বিষয়ে আজকের নিবন্ধ।
এজাহার থেকে জানা যায়, দুই বছর আগে মামলার আসামি সায়েম সোবহান আনভীরের সঙ্গে মোসারাতের পরিচয় হয়। পরিচয়ের পর থেকে তাঁরা বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় দেখা করতেন এবং সব সময় মোবাইলে কথা বলতেন। একপর্যায়ে দুজনের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এরপর ২০১৯ সালে মোসারাতকে স্ত্রী পরিচয় দিয়ে আসামি রাজধানীর বনানীতে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেন। সেখানে তাঁরা বসবাস করতে শুরু করেন। ২০২০ সালে আসামির পরিবার এক নারীর মাধ্যমে এই প্রেমের সম্পর্কের বিষয়টি জানতে পারে। এরপর আসামির মা মোসারাতকে ডেকে ভয়ভীতি দেখান এবং তাঁকে ঢাকা থেকে চলে যেতে বলেন। আসামি কৌশলে মেয়েটিকে কুমিল্লায় পাঠিয়ে দেন এবং পরে বিয়ে করবেন বলে আশ্বাস দেন। সর্বশেষ গত ১ মার্চ মোসারাতকে প্ররোচিত করে ঢাকায় এনে আসামী গুলশানের ১২০ নম্বর সড়কে বাসা ভাড়া করে দেন। ফ্ল্যাটের একটি কক্ষে আসামি ও মেয়েটির ছবি তুলে তা বাঁধিয়ে রাখা হয়। হঠাৎ আনভীর অর্থাৎ আসামী তাঁকে বকা দিয়ে বলেছেন, কেন তিনি ফ্ল্যাটের মালিকের বাসায় গিয়ে ইফতার করেছেন, ছবি তুলেছেন। ফ্ল্যাটের মালিকের স্ত্রী ফেসবুকে ছবি পোস্ট করেছেন। এ ছবি পিয়াসা দেখেছেন। পিয়াসা মালিকের স্ত্রীর ফেসবুক বন্ধু। এখন পিয়াসা তাঁর মাকে সবকিছু জানিয়ে দেবেন। তিনি (আসামি) দুবাই যাচ্ছেন, মোসারাত যেন কুমিল্লায় চলে যান। আসামির মা জানতে পারলে তাঁকে (মোসারাত) মেরে ফেলবেন। মোসারাত চিৎকার করে বলেন, আসামি তাঁকে ধোঁকা দিয়েছেন। যেকোনো সময় তাঁর বড় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। এরপর মেয়েটির আত্মহত্যা।
আলামত হিসেবে আসামির সঙ্গে ছবি, আসামির সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে লেখা ডায়েরি ও তাঁর ব্যবহৃত দুটি মুঠোফোন নিয়ে যায় পুলিশ। পুলিশ সূত্র বলছে, আসামির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্ররোচনায় ২৬ এপ্রিল বেলা ১১টা থেকে বিকেল সোয়া ৪টার মধ্যে যেকোনো সময় মোসারাত মারা যান।
এখন আমাদের জানার বিষয় আত্মহত্যায় প্ররোচনা কি, কেন, কখন কিভাবে। এ মামলার শাস্তিই বা কি, প্রমাণের দায়িত্ব কার। প্রায়ই শুনে থাকি এভাবেই একে অপরকে আত্মহত্যার প্ররোচনা দেয় যে, ‘তোর বেঁচে থাকাটা অর্থহীন। তুই একটা কলংক, অভিশাপ, তুই মরে গেলেই শান্তি।’ আবার “তুমি তো পাগল, বেঁচে থাকলেই কি আর মরলেই কি। তোমার উচিত ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দেয়া, একটা বোঝা দূর হবে।”
আবার সুইসাইড নোট লিখে যায়, এতদিন আমায় ভালবাসলে, আজ বিয়ে না করে অন্য নারীতে মজলে। এত আশা স্বপ্ন দেখিয়ে দুরদুর করে তাড়িয়ে দিলে, এ জীবন রেখে লাভ কি! মনে রেখ আমার মৃত্যুর জন্য তুমিই দায়ী থাকবে। যখন কোনো ব্যক্তি তার মৃত্যুর পূর্বে মৃত্যুর কারণ সংবলিত কোনো বক্তব্য লিখে যান, ওই বক্তব্যকেই সুইসাইড নোট বলে।
এর সাথে সম্পৃক্ত থাকে মৃত্যুতে সহযোগিতা বা আত্মহত্যার প্ররোচনা। তবে সহযোগী বা প্ররোচনার বিষয়টি প্রমাণের দাবি রাখে। বাংলাদেশে প্রচলিত সাক্ষ্য আইন-১৮৭২ এর ৩২ ধারা অনুযায়ী উক্ত সুইসাইড নোট প্রাসঙ্গিক সাক্ষ্য হিসেবে গণ্য হবে। তবে শুধুমাত্র একটি সুইসাইড নোটের ভিত্তিতে কাউকে শাস্তি দেওয়া যাবে না। যখন উক্ত সুইসাইড নোটের সমর্থনে অপরাধের সাক্ষ্য উপস্থাপন এর মাধ্যমে কারো বিরুদ্ধে আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হবে তখনই শাস্তি প্রদান করা যাবে। আইনের মূলনীতি হচ্ছে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তাকে নির্দোষ বলে গণ্য করতে হবে। আর মামলার যে পক্ষ কোন অধিকার বা দাবী প্রতিষ্ঠা করতে চায় তাকে সেটা প্রমান করতে হবে। মামলার শুরুতে প্রমানের দায়িত্ব যে কোন এক পক্ষের উপর থাকলেও পরবর্তীকালে সেটা অন্য পক্ষের উপর অর্পিত হতে পারে। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে। ক আদালতে এই মর্মে দাবী করে যে, খ একটি অপরাধ করেছে এবং সেই অপরাধে খ এর সাজা হওয়া উচিত এ ক্ষেত্রে প্রমানের দায়িত্ব ক এর উপর পরে।
বাংলদেশ দণ্ডবিধি, ১৮৬০ এর ৩০৬ ধারা অনুযায়ী ব্যক্তির আত্মহত্যায় প্ররোচনার শাস্তি ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং জরিমানা। তবে আত্মহত্যা করতে গিয়ে না মরলে আপনাকে আত্মহত্যা বা নিজেকে ধ্বংস করার অপচেষ্টার অপরাধে ১ বছরের জেলে যেতে হতে পারে। দণ্ডবিধির ৩০৯ ধারা মতে, যদি আপনি আত্মহত্যা করার উদ্যোগ নেন এবং অনুরুপ অপরাধ অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে কোনো কাজ করেন তাহলে আপনার ১ বছর পযর্ন্ত কারাদণ্ড বা জরিমানা হতে পারে বা উভয় শাস্তিই হতে পারে।
আরেকটি বিষয়, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০৩ এর ৯(ক) ধারা মতে কোনো নারীর সম্মতি ছাড়া বা ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো ব্যক্তির ইচ্ছাকৃত কোনো কাজ দ্বারা সম্ভ্রমহানি হওয়ার প্রত্যক্ষ কারণে কোনো নারী আত্মহত্যা করলে তা আত্মহত্যা করতে প্ররোচনার অপরাধ হবে। যার জন্য সে ব্যক্তির অনধিক ১০ বছর কিন্তু অন্যূন পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দন্ডিত হবে।
লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও আইন গবেষক। E-mail: seraj.pramanik@gmail.com