অভিজিৎ বিশ্বাস( অঁজিষ্ণু অভি):
সভ্যতার সূচনালগ্ন হতে সমাজকাঠামোর অন্যতম অনুসঙ্গ ধর্ম। ধর্ম কেবল আমাদের বিশ্বাস নয়,এর শিকড় এবং পরিধি আরো গভীরে।ব্যক্তি,পরিবার ও সমাজ নিয়ন্ত্রনের অন্যতম হাতিয়ার ধর্ম। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দে প্রণীত হাম্বুরাবী আইন হতে শুরু করে শতাব্দীর পর শতাব্দীব্যাপী যে শাসন কাঠামো গড়ে উঠেছে প্রত্যেকটি জায়গায় রয়েছে ধর্মের প্রভাব।
ধর্ম এবং ধর্মান্তরের ইতিহাস সুপ্রাচীন। ধর্মান্তরিত ব্যক্তির প্রতি প্রত্যেকটি ধর্ম এবং প্রত্যেক সমাজের অবস্থানই অভিন্ন। ধর্ম এবং ধর্মান্তরের কালানুক্রিমক পর্যায় নয়, আমার আজকের আলোচ্য হিন্দু হতে ধর্মান্তরিত ব্যক্তির সম্পত্তির উত্তরাধিকার-
সম্পত্তর উত্তরাধিকার সংক্রান্ত মোকদ্দমা দেওয়ানি প্রকৃতির মোকদ্দমা। দেওয়ানি মোকদ্দমাসমূহের বিচারকার্য পরিচালনার জন্য ১৮৮৭ সালে ১১মার্চ প্রণয়ন করা হয় The Civil Courts Act-1887। এ আইনের ৩৭ ধারায় কতিপয় বিষয়ে রাষ্ট্রীয় আইন নয় বরং হিন্দু এবং মুসলিমদের ধর্মীয় আইনের বিধানকে সংরক্ষণ করা হয়েছে। ৩৭ ধারায় বলা হয়েছে-” কোন মামলা বা কার্যধারায় দেওয়ানি আদালত কতৃক উত্তরাধিকার ও ওয়ারিশী,বিবাহ বা ব্যক্তিগত ধর্মীয় আচরণ বা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত বিষয়ে পক্ষগন হিন্দু হলে হিন্দু আইন এবং মুসলিম হলে মুসলিম আইন প্রযোজ্য হবে।
হিন্দু এবং মুসলিম উভয় আইন অনুসারে সম্পত্তির উত্তরাধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে অভিন্ন নীতি হলো কেউ যদি ধর্মান্তরিত হয় তবে ঐ ধর্মান্তরিত ব্যক্তি যে ধর্মে ধর্মান্তরিত হবে তার ক্ষেত্রে সেই আইন প্রযোজ্য হবে এবং ঐ ব্যক্তি তার পিতা বা মাতার সম্পত্তির উত্তরাধিকার হতে বঞ্চিত হবে। এখন প্রশ্ন হলো উভয় পার্সোনাল ল অনুসারে যদি ধর্মান্তরিত ব্যক্তি উত্তরাধিকার হতে বঞ্চিত হয় তবে বিভ্রান্তিটা কোথায়? বিভ্রান্তিটা সৃষ্টি করেছে ১৮৫০ সালে প্রণীত Cast Disabilities Removal Act,1850। মুসলিম ল এর উপর বাজারে যত বই আছে কোন বইতে এটা লিখে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হয়নি যে ১৮৫০ সালের আইন প্রণয়নের পর পূর্বে ধর্মান্তরিত ব্যক্তি উত্তরাধিকার বঞ্চিত হলেও এখন কোনো মুসলিম যদি অন্যধর্মে ধর্মান্তরিত হয় তবে তার মা বাবার সম্পত্তি হতে বঞ্চিত হয়না। কিন্ত হিন্দু আইনের ওপর বাজারে যত বই আছে প্রায় প্রত্যেকটা বইয়ের ভাষ্য যে পূর্বে উত্তরাধিকার বঞ্চিত হলেও ১৮৫০ সালের Cast disabilities Removal Act প্রণয়নের পর আর বঞ্চিত হয়না। মাত্র দু একটা বইয়ে হয়তো ব্যতিক্রম রয়েছে। তাই বিভ্রান্তির যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। আমি এই লেখায় হিন্দু শাস্ত্রের বিধান, মুসলিম ধর্মের বিধান, ১৮৫০ সালের আইনের প্রয়োগ এবং বর্তমানে এই আইনের প্রয়োগের ক্রমানুযায়ী আলোচনার মাধ্যমে বিভ্রান্তিটা নিরসনে চেষ্টা করব-
হিন্দুশাস্ত্রে ধর্মান্তরিত ব্যক্তির উত্তরাধিকার সংক্রান্ত বিধান:
হিন্দু আইনে দুটি মতবাদ -দায়ভাগ এবং মিতক্ষরা। বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুগন দায়ভাগ মতবাদ অনুসারী। দায়ভাগ মতবাদের অন্যতম উৎস মনুস্মৃতি এবং যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতি। এবার দেখা যাক তাদের মতে কারা হিন্দু সম্পত্তির উত্তরাধিকার হতে বঞ্চিত হবেন-
মনু বলেছেন-“ক্লীব,জাতিভ্রষ্ট বা ধর্মান্তরিত, জন্মান্ধ, জন্মবধির, জন্মউন্মাদগ্রস্ত ব্যক্তিগন সম্পত্তির অংশ হতে বঞ্চিত হবে
যাজ্ঞবল্ক্য বলেছেন- “জাতিভ্রষ্ট ব্যক্তি ও তার পুত্র, ক্লীব, উন্মাদগ্রস্ত, অন্ধ ও দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত ব্যক্তি তার সম্পত্তির অংশ হতে বঞ্চিত হবে।”
সুতরাং, এ থেকে দেখা যাচ্ছে ধর্মান্তরিত ব্যক্তির সম্পত্তির উত্তরাধিকার হতে বঞ্চিত হওয়া বিষয়ে সব শাস্ত্রকারই একমত। ধর্মান্তর বাদে অন্য যে সকল কারনে হিন্দুআইনে উত্তরাধিকার বঞ্চিত হবার কথা বলা হয়েছে পরবর্তীতে বিভিন্ন আইন প্রণয়নের মাধ্যমে এ সকল অযোগ্যতা দূর করা হয়েছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে ১৯৫৬ সালে উত্তরাধিকার আইন প্রণয়নের মাধ্যমে নারীকে পুরুষের সমান সম্পত্তির অংশীদার ও করেছে। যদিও এই আইন সহ ১৯৪৭ সালের পর ভারতে আনা আইনসমূহ বাংলাদেশে প্রযোজ্য নয়।
মুসলিম আইনে ধর্মান্তরিত ব্যক্তির অবস্থান:
হিন্দু আইনের মতো একজন মুসলিম ও যদি অন্য কোন ধর্মে ধর্মান্তরিত হন তাহলে তিনি যাদের সম্পত্তিতে ওয়ারিশ হতেন সেখান হতে বঞ্চিত হন। মুসলিমদের কিছু বিষয়ে ধর্মীয় বিধানকে সুরক্ষা দেবার জন্য ১৯৩৭ সালে The Muslim Personal Shariat Application Act, 1937 প্রণীত হয়। এ আইনে যে ১০ টি ক্ষেত্রে শরীয়াহ আইন সংরক্ষণ করে তার মধ্যে অন্যতম একটি বিষয় হলো ফারায়েজ বা উত্তরাধিকার।
সহীহ বুখারী শরীফে উত্তরাধিকার হতে বঞ্চিতকরণ বিষয়ে বলা হয়েছে- একজন মুসলমান কোন অমুসলিম এর সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারী হবেনা এবং একজন মুসলিমের সম্পত্তিতে কোন অমুসলিম ও উত্তরাধিকারী হবেনা। ধর্মান্তরিত হলে ঐ ব্যক্তি মুসলিম আত্মীয়র সম্পত্তি হতে বঞ্চিত হবে। তবে মৃত্যুর পূর্বে আবার মুসলমান হলে সে উত্তরাধিকারী হতে পারবে।
Cast Disabilities Removal Act -1850 এবং এর ফলাফল:
১৮৫০ সালের এই আইনটিকে ধর্মীয় স্বাধীনতা আইনও বলা হয়। এই আইনটি কেবল হিন্দু উত্তরাধিকারের প্রতিষ্ঠিত নীতিতে মৌলিক পরিবর্তন এনেছে তা নয়, এটি মুসলিম উত্তরাধিকার সংক্রান্ত নীতিতেও মৌলিক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। আইনে Caste শব্দটি থাকলেও ভাবার সুযোগ নেই যে এটা শুধু হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন বর্ণপ্রথা আছে তা হতে উদ্ভূত সমস্যা নিরসনকল্পে করা হয়েছে, বরং এ আইনে ধর্মান্তরিত এবং বর্ণচ্যুত উভয় ব্যক্তির অধিকার সুরক্ষিত করা হয়েছে। ১৮৫০ সালের এ আইনটি মূলত মৌলিক বা নতুন আইন নয়, ১৮৩২ সালের যে Bengal Presidency Regulations প্রণীত হয় ১৮৫০ সালের আইনটি এটির বর্ধিত সংস্করণ মাত্র। এ আইনে বলা হয় হিন্দু বা মুসলিম কোন ধর্মান্তরিত ব্যক্তি তার ধর্ম এবং প্রথা অনুসারে যে সকল অধিকার হতে বঞ্চিত হতো এ আইন কার্যকরের পর আর বঞ্চিত হবেনা।পরবর্তীতে ব্রিটিশ শাসকগণ এ আইনটি পুরো ভারত বর্ষে প্রয়োগের চিন্তা করে এবং একইসাথে ভারতের হিন্দুদেরমধ্যে প্রচলিত বিভিন্ন caste বা Sub- caste হতে কোন ব্যক্তি চ্যুত হবার ফলে যে অধিকারসমূহ হারাতো তাদের অধিকারসমূহ সুরক্ষা দেবার উদ্যোগ গ্রহন করে।
Cast Disabilities Removal Act -1850 আইনে ১ টি প্রস্তাবনা এবং মাত্র ১ টি ধারা আছে।যেটা পড়লে আপনি পুরোপুরি নিশ্চিৎ হয়ে যাবেন এই আইনটি কেবল মাত্র হিন্দুদের বর্ণচ্যুতি দূর করার জন্য নয় বরং ধর্ম এবং বর্ণ উভয় চ্যুতির ফলে বঞ্চিতদের অধিকার রক্ষায় করা হয়েছে। এ আইনে change of Religion শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে,কোন নির্দিষ্ট Religion নয়। ১৮৩২ সালের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি রেগুলেশন এ কেবল হিন্দু ও মুসলিম দের ধর্ম পরিবর্তন বিষয় বলা হলেও এ আইনে Religion শব্দ ব্যবহার করে সকল ধর্ম হতে ধর্মান্তরিত ব্যক্তিদের অধিকার সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে। এই আইন প্রয়োগের ফলে হিন্দু,মুসলিম,বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, জৈন,শিখ প্রত্যেকেই ধর্মান্তরিত হলেও তার মা- বাবার সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারী হবার অধিকার লাভ করেছিল।
১৮৫০ সালের আইনের বর্তমান প্রয়োগ:
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জারী হয়, এই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র আমাদের প্রথম অন্তবর্তীকালীন সংবিধান ও। এই ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসন হতে শুরু করে পাকিস্তান ভূখন্ডে যতগুলো আইন প্রচলিত ছিল তা ২৬ শে মার্চ হতে Retrospective Effect দিয়ে বৈধতা দেওয়া হয়। ফলে ১৮৫০ সালের আইন ও বাংলাদেশে কার্যকর হয়।কিন্ত এই কার্যকারিতা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি বেশি দিন। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু সরকার বাংলাদেশ স্বাধীনের পূর্বের প্রচলিত আইনসমূহ পর্যালোচনার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৭৩ সালে Bangladesh Laws Revision And Declaration Act,1973 প্রণীত হয়। এ আইনে ২ টি schedule বা তফশীল আছে।প্রথম schedule এ বাংলাদেশের ভূখন্ডে প্রচলিত কোন কোন আইনগুলো বাতিল করা হলো তার তালিকা এবং দ্বিতীয় schedule এ কোন কোন আইনগুলো গ্রহন করা হলো এবং কোন সংশোধনী থাকলে তা উল্লেখ করা হয়েছে।
এই আইনের প্রথম শিডিউলের যে বাতিলকৃত আইনসমূহের তালিকা দেওয়া হয়েছে তার ৮ নাম্বার ক্রমে The Cast disabilities Removal Act-1850 সালের আইনটি রয়েছে। এই আইনটি যে কেবল বাংলাদেশে বাতিল তা নয় ভারতেও এই আইনটি ২০১৭ সালে বাতিল করে দেওয়া হয়েছে।বাংলাদেশ সরকার সুচিন্তিতভাবেই ১৯৭৩ এ আইনটিকে বৈধতা দেয়নি। বৈধতা দিলে কেবল ধর্মান্তরিত হিন্দু ব্যক্তি যে তার পিতা মাতার সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারী হতো তা নয়, একজন মুসলিম ও যদি অন্য ধর্মে ধর্মান্তরিত হতো তারপরও তার মা বাবার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতো যা কোরআন এবং হাদিসের বিধান বিরোধী হতো।
সুতরাং,১৯৭৩ সালের Bangladesh Laws Revision and declaration আইনের পর হতে ১৮৫০সালের Cast Removal and disabilities Act এর কোন প্রয়োগ নেই, ফলে পূর্বের যে পার্সোনাল আইন তা ই বহাল থাকছে।হিন্দু বা মুসলিম যে হোক ধর্মান্তরিত হলে সম্পত্তির উত্তরাধিকার হতে বঞ্চিত হচ্ছে। ১৮৫০ সালের যে আইন ১৯৭৩ এ বাতিল করে দিয়েছে বাতিলের ৪৮ বছর পরও সেই আইনের রেফারেন্স দিয়ে হিন্দু আইনের ওপর বাজারে প্রচলিত সিংহভাগ বই ই আইন শিক্ষার্থীদের মিসলিড বা বিভ্রান্ত করছে যা দু:খজনক। আইনকে সম্যকভাবে সর্বশেষ সংশোধনীসহ পাঠকদের জানানোর দায়বদ্ধতা লেখকের রয়েছে।
লেখক: এল এল.বি, এল এল.এম,জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষানবীশ আইনজীবি,ঢাকা জজকোর্ট