চন্দন কান্তি নাথ:
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের আলোকে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, মৌলিক মানবাধিকার স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত করার চেষ্টা করা প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য। সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদে আছে, “(১) সংবিধান ও আইন মান্য করা, শৃঙ্খলা রক্ষা করা, নাগরিক দায়িত্ব পালন করা এবং জাতীয় সম্পত্তি রক্ষা করা প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য। (২) সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য।” সে প্রক্ষাপটে রাষ্ট্রে কোন অপরাধ সংঘটিত হলে পুলিশ সঠিকভাবে সেবার মানসিকতা নিয়ে সংবিধান ও আইন মান্য করে তদন্ত করবে এটাই সবাই আসা করে। ফৌজদারী অপরাধ সংঘটিত হলে মামলা রুজু হওয়ার পর তদন্ত শুরু হয়। আর তদন্তের সফলতা অর্জনের মাফকাঠিতে পুলিশ অফিসারের যোগ্যতা পরিমাপ করা হয়। তদন্ত শুরু হওয়ার পূর্বে এবং ঘটনাস্থলে রওনা হওয়ার পূর্বে তদন্তকারী অফিসার ভিলেজ ক্রাইম নোট বুক ও অন্যান্য রেজিস্ট্রার দেখে থাকেন। (পিআরবির ২৫৬ নং রেগুলেশন) ।
তদন্তকালীন সময়ে হাজির হতে পুলিশ যে কাউকে বাধ্য করতে পারেন। কিন্তুু সংশ্লিষ্ট পক্ষ এবং সাধারণ লোকদের অযথা হয়রানী হতে তদন্তকারী অফিসারকে বিরত থাকতে হয়। তদন্তে যাদের সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে কেবল তাদেরকে ডাকতে হবে। সম্ভব হলে তদন্তকারী অফিসার সাক্ষীদের বাড়ী যাবে। তদন্তকালীন সময়ে পুলিশ কেইস ডায়েরী সংরক্ষণ করবেন। থানায় খবরটি কবে পোঁছাল, কোন সময় তিনি তদন্ত আরম্ভ এবং শেষ করেছেন, কোন কোন স্থান পরিদর্শন করেছেন এবং তদন্তের ফলে যে পরিস্থিতি তিনি দেখতে পেয়েছেন তার একটি বিবরণ লিপিবদ্ধ করবেন। এলাকার মেম্বার, চেয়ারম্যান, পৌরসভার কাউন্সিলর কোন সাহায্য করলে তা লিপিবদ্ধ করবেন। (পিআরবির ২৬৩ এবং ২৬৪ নং রেগুলেশন)
কেউ হাজির না হলে পুলিশ আদালতে জানাতে পারেন। কেননা পিআরবি এর ২১এ নং বিধিতে আছে, ’21 (a) Except as provided in the Code of Criminal Procedure or any other Act, or in any rules made or approved by the Provincial Government, for the time being in force, subordinate Magistrates have no power to interfere in police work. But Magistrates having jurisdiction and empowered to take cognizance of police cases are reminded of their responsibility for watching the course of police investigations in the manner laid down in Chapter XIV of the Code of Criminal Procedure.’
তদন্তকালীন সময়ে কেউ পুলিশের তদন্ত কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারেন না। পুলিশ যে ব্যক্তি ঘটনা সম্পর্কে জানেন তাকে মৌখিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারেন। সে ব্যক্তি পুলিশকে সকল প্রশ্নোত্তর দিতে বাধ্য। ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬১(২) আছে, ‘Such person shall be bound to answer all questions relating to such case put to him by such officer, other than questions the answer to which would have a tendency to expose him to a criminal charge or to a penalty or forfeiture.’ তবে যে প্রশ্ন তাকে ফৌজদারী অভিযোগ, দন্ড এবং বাজেয়াপ্তির দিকে নিয়ে যায় সে সকল প্রশ্ন উত্তর দিতে সে বাধ্য নয়। তদন্তকারী পুলিশ উক্ত জবানবন্দি লিখে নিতে পারেন। তবে লিখিত হলে বিবৃতিদাতা তাতে অবশ্যই স্বাক্ষর করবেন না। কিছু শর্ত ব্যতিত এরুপ বিবৃতি বা রেকর্ড অনুসন্ধান বা বিচারের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যাবে না। তবে এরুপ কোন সাক্ষীকে অনুসন্ধান বা বিচারে রাস্ট্রপক্ষের সাক্ষী হিসাবে তলব করা হলে আসামীর অনুরোধক্রমে আদালত তা উক্ত লিখিত বিবৃতি উল্লেখ করবেন এবং আসামীকে একটি কপি বা নকল প্রদানের নির্দেশ দিবেন। এখানে বিচারের ক্ষেত্রে সাক্ষ্য আইনের ১৪৫ ধারা প্রাসঙ্গিক হবে। উক্ত ধারা অনুসারে একজন সাক্ষীকে তার পূর্ববর্তী লিখিত এবং প্রাসঙ্গিক বিবৃতির জন্য জেরা করা যায়। আর এরুপ ক্ষেত্রে কোন বিবৃতি ব্যবহার করা হলে উক্ত সাক্ষীকে পুন:পরীক্ষার ক্ষেত্রে তা ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে কেবল মাত্র তার জেরায় উল্লেখিত কোন ব্যাখ্যার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। আর এরুপ বিবৃতি অনুসন্ধান বা বিচারের বিষয় বস্তুুর সাথে প্রাসঙ্গিক না হলে অথবা ন্যায় বিচারের স্বার্থে তা আসামীর নিকট প্রকাশ করা অতি আবশ্যক না হলে এবং জনস্বার্থে যুক্তিযুক্ত না হলে আদালত তাঁর মতামত লিপিবদ্ধ করবেন এবং আসামীকে প্রদত্ত বিবৃতির নকল হতে উক্ত অংশ বাদ দিবেন। তবে সাক্ষ্য আইনের ধারা ৩২(১) অনুসারে কোন ব্যক্তি তার মৃত্যুর কারন সম্পর্কে বা প্রেক্ষাপট সম্পর্কে কোন বিবৃতি প্রদান করলে তা প্রাসঙ্গিক হবে। এমনকি সাক্ষ্য আইনের ধারা ২৭ অনুসারে পুলিশ হাজতে থাকা কোন আসামীর কথামত কোন বস্তুু বা তথ্য উদ্ধার হলে সে তথ্য দোষস্বীকারের ভিত্তিতে হোক না হোক অপরাধ প্রমানের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক হবে। (ধারা-১৬১, ১৬২) ফৌজদারী কার্যবিধির ধারা ১৬২(৩) আছে, ‘(2) Nothing in this section shall be deemed to apply to any statement failing within the provisions of section 32, clause (1) , of the Evidence Act, 1872 [or to affect the provisions of section 27 of the Act.’
সাক্ষ্য আইনের ২৭ ধারায় আছে, ‘Provided that, when any fact is deposed to as discovered in consequence of information received from a person accused of any offence, in the custody of a police officer, so much of such information, whether it amounts to a confession or not, as relates distinctly to the fact thereby discovered, may be proved.”
পুলিশ অফিসার কিংবা অন্য কেউ আসামীকে কোন প্রলোভন, হুমকি বা প্রতিশ্রæতি দিয়ে জবানবন্দি নিবেন না। এরুপ দোষ স্বীকারোক্তি উক্ত আসামীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য আইনের ২৪ ধারা অনুসারে আদালতের নিকট গ্রহনযোগ্য হয় না। তবে স্বেচ্ছায় আসামী তদন্তকালীন সময়ের বিবৃতি দিতে চাইলে কেউ তাকে প্রতিহত করবে না। ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৩(২) ধারায় আছে, ‘(2) But no police-officer or other person shall prevent, by any caution or otherwise, any person from making in the course of any investigation under this Chapter any statement which he may be disposed to make of his own free will.’ আর আসামী চাইলেই স্বেচ্ছায় বিনা প্ররোচনায় বিনা আঘাতে এবং বিনা প্রলোভনে ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিতে পারেন। উক্ত জবানবন্দি তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হবে এটাও আসামীকে জানতে হয়। আর চিন্তাভাবনার জন্য আসামীকে সে সময় ৩ ঘন্টা সময় দিতে হয়। ম্যাজিস্ট্রেট ৩৬৪ ধারার বিধান ও ফরম মোতাবেক জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করবেন।
তদন্তকারী অফিসার তদন্ত ও অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোন কিছু কারন লিপিবদ্ধ করে কোন প্রকার দেরী ব্যতিত কোন স্থানে তল্লাশী করতে পারেন। তবে ব্যাংকার্স বুক্স এভিডে›স এ্যাক্ট, ১৮৯৮ অনুসারে কিছু ব্যতিক্রম আছে। তিনি অসমর্থ হলে তার অধীনস্ত কোন অফিসারকে লিখিত কারণ উল্লেখপূর্বক তল্লাশী স্থান বা তল্লাশীর বিষয়ে উল্লেখ পূর্বক তল্লাশীর জন্য বলতে পারেন। তবে মহিলাদের তল্লাশীর ক্ষেত্রে অন্য একজন মহিলা দিয়ে অবশ্যই তল্লাশী করতে হবে। (ধারা-৫২) আর তল্লাশীর ক্ষেত্রে পুলিশ ফৌজদারী কার্যবিধির ১০২ এবং ১০৩ অনুসারে ব্যবস্থা নিবেন। সেক্ষেত্রে তল্লাশী করার পূর্বে পুলিশ দুই বা তার অধিক সংশ্লিষ্ট এলাকার সাক্ষী উপস্থিত রাখবেন এবং যে সমস্ত দ্রব্যাদি পাবেন তার তালিকা করে তাদের স্বাক্ষর নেবেন এবং উক্ত তালিকা যার দখলীয় স্থান বা যার নিকট হতে পাওয়া যাবে তার অনুরোধে তার নিকট অবশ্যই একটি কপি প্রদান করতে হবে। আটককৃত মালের ৩(তিন) কপি তালিকা প্রণয়ন করতে হয়। এক কপি তদন্তকারী কর্মকর্তা, আরেক কপি যার বাড়ী হতে উদ্ধার করা হয়েছে তাকে বা তার প্রতিনিধিকে এবং অন্য কপি কোর্ট ইন্সপেক্টর এর মাধ্যমে ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর উপস্থাপন করতে হয়। সার্চ ওয়ারেন্ট সহ বা ওয়ারেন্ট ব্যতিত তল্লাশী হয়। ওয়ারেন্ট যিনি কার্যকর করবেন তাকে সম্পূর্ণরুপে সকল সন্দেহের উর্ধ্বে থাকতে হবে। যুক্তিসঙ্গতভাবে সন্দেহ হলে পুলিশ অফিসার তার ডায়েরীতে উল্লেখ পূর্বক তল্লাশী পরিচালনা করতে পারেন। সেক্ষেত্রে ওয়ারেন্টের দরকার হয় না।
তদন্তকারী কর্মকর্তা এক থানা হতে অন্য থানায় তল্লাশীর জন্য রিকুইজিশান দিতে পারেন। রিকুইজিশন অনুমোদনে দেরী হচ্ছে মনে হলে সরাসরি তল্লাশী করা যাবে। সেক্ষেত্রে একটি নোটিশ ঐ থানার অফিসার ইনচার্জকে দিবেন এবং একই সংগে জব্দতালিকার একটি কপি ঐ এলাকার অফিসার ইনচার্জ ও ম্যাজিস্ট্রেটকে পাঠাতে বাধ্য থাকবেন। কোন ব্যক্তি উক্ত তল্লাশীতে হাজির না হলে বা সাক্ষী না থাকলে সে দন্ডবিধির ১৮৭ ধারা আইন অনুসারে কোন সরকারী কর্মকর্তাকে সহযোগিতা না করার অপরাধে অপরাধী হবেন। আর সকল ক্ষেত্রে তল্লাশীর জব্দতালিকার একটি কপি যে ম্যাজিস্ট্রেট আমল গ্রহণ করেন তার নিকট একটি কপি অবশ্যই পাঠাতে হবে। পুলিশ না দিলে উক্ত কপি তল্লাশীকৃত স্থানের মালিক বা দখলকার আবেদন করলে ম্যাজিস্ট্রেট তাকে মূল্য দিয়ে বা মূল্য ছাড়া সরবরাহ করতে পারেন।
আর তদন্তের প্রয়োজনে আমলযোগ্য মামলায় পুলিশ যে কাউকে গ্রেফতার করতে পারেন। তবে মনে রাখতে হবে আগে সাক্ষ্য সংগ্রহ পরে ১৬৭ (১) অনুসারে গ্রেফতার করতে হয়। বিনা কারনে কাউকে গ্রেফতার উচিত নয়। এজন্য তদন্তকারী কর্মকর্তা মাজিস্ট্রেটের নিকট জবাবদিহিতার মধ্যে পড়তে পারেন।
আর এভাবেই উপরোক্ত প্রক্রিয়া অবলম্বন করে পুলিশ ফৌজদারী কার্যবিধির ১৭৩ ধারা অনুসারে, পক্ষদের নাম, তথ্যের ধরন, সাক্ষীদের নাম ও সাক্ষ্য, আসামীদের নাম, মালামাল সহ পিআরবি অনুসারে ঘটনাস্থলের স্ক্যাচম্যাপ, খসড়ামানচিত্র সূচী এবং অন্যান্য সাক্ষ্য সহ কার বিরুদ্ধে কি অপরাধ সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখপূর্বক আদালতে রিপোর্ট প্রদান করবেন যাতে ম্যাজিস্ট্রেট ধারা ১৯০(১) অনুসারে মামলা আমলে নিতে পারেন। পুলিশ একই সাথে বাদীকেও মামলার ফলাফল জানাবেন। তবে রিপোর্ট দেয়ার পরও থানার অফিসার ইনচার্জ অতিরিক্ত সাক্ষ্য পেলে (মৌখিক বা দালিলিক) একটি অধিকতর রিপোর্ট প্রদান করতে পারবেন কিন্তুু তাও বাদীকে জানাবেন। আর আসামী দরখাস্তের ভিত্তিতে এ রিপোর্টের একটি কপি পেতে হকদার হয়।
পুলিশ যথাযথ তদন্ত করলে ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৭(১) ধারা অনুসারে ২৪ ঘন্টায় শেষ করতে না পারলে পিআরবির ২৬১(সি) এর প্রবিধান অনুসারে সর্বোচ্চ ১৫ পনের দিনের মধ্যে পুলিশ তদন্তÍ শেষ করতে পারে। পুলিশ সাক্ষ্য গ্রহণে ও তল্লাশি সংক্রান্তে তার ক্ষমতাও সীমাবদ্ধতা জেনে তদন্ত করলে, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৫(৩) অনুসারে দ্রæত তদন্ত ও বিচারের মাধ্যমে ন্যায় বিচার নিশ্চিত হবে।
লেখক: সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, কুমিল্লা।