ফৌজদারী কার্যবিধিতে ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের ভূমিকা রেললাইনের মত সমান্তরাল

চন্দন কান্তি নাথ:

আসামী গ্রেফতার করে কিংবা কোন জিনিস আটক করে তা ২৪ ঘন্টার মধ্যে সংবিধান ও ফৌজদারী আইন অনুসারে তা ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট সোপর্দ করতে হয়। [গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান, ১৯৭২, অনুচ্ছেদ-৩৩, ফৌজদারী কার্যবিধি, ১৮৯৮, ধারা- ৬১, পুলিশ আইন, ১৮৬১, ধারা-২৫,] তদন্ত ও বিচার সংশ্লিষ্ট পুলিশের সকল কাজের সঙ্গে ম্যাজিস্ট্রেট ওতপোতভাবে জড়িত। পুলিশ মামলা হওয়ার সাথে সাথে ম্যাজিস্ট্রেটকে সিন করাবেন অর্থাৎ উক্ত মামলার কপি ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট প্রদর্শন করবেন। ফৌজদারী কার্যবিধির ১৫৫ ধারা অনুসারে অআমলযোগ্য অপরাধের তথ্য থানায় গেলে তা একটি বইয়ে লিপিবদ্ধ করা হয় এবং তথ্য প্রদানকারীকে ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট প্রেরণ করা হয়। ম্যাজিস্ট্রেট অনুমোদন দিলে মামলার তদন্ত শুরু হয়।

আমলযোগ্য অপরাধ থানায় রেকর্ড হওয়ার সংগে সংগে ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমোদন ব্যতিত পুলিশ তদন্ত শুরু করে। যে ম্যাজিস্ট্রেটের ১৯০ধারার অধীনে আমল গ্রহনের ক্ষমতা আছে, সেই ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে এফআইআর এন্ট্রিপূর্বক পুলিশ মামলা তদন্ত করতে পারেন। (ধারা ১৫৬) আর যেখানে আমলযোগ্য অপরাধের সন্দেহ করা হয়, সেক্ষেত্রে সে থানার অফিসার ইনচার্জ ( সার্কেল এএসপির মাধ্যমে) একটি রিপোর্ট অবশ্যই যে ম্যাজিস্ট্রেট আমল গ্রহণ করেন তার নিকট পাঠাবেন এবং দ্রুত নিজে অথবা তার অধিনস্ত একজন অফিসারকে ঘটনার বিষয়ে তদন্ত ও আসামী গ্রেফতার (যদি দরকার হয়) করতে পাঠাবেন। ঘটনা খুব ঘোরতর না হলে এবং তদন্ত করার মত গুরুত্বপূর্ণ না হলে তিনি কাউকে পাঠাবেন না। না পাঠালে কেন পাঠালেন না তা ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট অবশ্যই রিপোর্টে উল্লেখ করবেন। আর তদন্ত না করলে তথ্য প্রদানকারীকে অবশ্যই এর কারণ জানাবেন। আর ম্যাজিস্ট্রেট উক্ত রিপোর্ট পাওয়ার পর পুলিশকে তদন্ত করার নির্দেশ দিতে পারেন। অথবা নিজে কিংবা কাউকে ফৌজদারী কার্যবিধির অধীনে ইনুকোয়ারী করার জন্য বলতে পারেন। (ধারা ১৫৭, ১৫৮, ১৫৯)

সিআর মামালার ক্ষেত্রেও ম্যাজিস্ট্রেট মামলা আমলে না নিয়ে ১৫৬(৩) অধীনে মামলা তদন্তের জন্য পাঠাতে পারেন অথবা ২০০ ধারার অধীনে জবানবন্দি গ্রহণে পুলিশকে প্রসেস স্থগিত রেখে তদন্তের জন্য পাঠাতে পারেন। আর আসামী চাইলেই ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিতে পারেন। পুলিশ আসামীকে ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট উপস্থাপন করলে ম্যাজিস্ট্রেট ৩৬৪ ধারার বিধান ও ফরম মোতাবেক জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করবেন। তদন্তকারী অফিসার তদন্ত ও অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোন কিছু কারন লিপিবদ্ধ করে কোন প্রকার দেরী ব্যতিত কোন স্থানে তল্লাশী করতে পারেন। সেক্ষেত্রে একটি নোটিশ ঐ থানার অফিসার ইনচার্জকে দিবেন এবং একই সংগে জব্দতালিকার একটি কপি ঐ এলাকার অফিসার ইনচার্জ ও ম্যাজিস্ট্রেটকে পাঠাতে বাধ্য থাকবেন। পুলিশ না দিলে জব্দতালিকার কপি তল্লাশীকৃত স্থানের মালিক বা দখলকার আবেদন করলে ম্যাজিস্ট্রেট তাকে মূল্য দিয়ে বা মূল্য ছাড়া সরবরাহ করতে পারেন।

মাননীয় আপীল বিভাগের ব্লাস্ট  বনাম বাংলাদেশ মামলায় আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য নীতিমালার দফা নং-৯ এ যা বলা হয়েছে, “ফৌজদারি কার্যবিধির ৬১ ধারা অনুযায়ী যখন কোনো ব্যক্তিকে নিকটস্থ ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করা হয়, তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা তাঁর প্রতিবেদনে কেন ২৪ ঘন্টার মধ্যে তদন্ত কর্যক্রম শেষ করা সম্ভব হয়নি, তা ১৬৭(১) ধারায় বর্ণনা করবেন। ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ কেন সুনির্দিষ্ট বলে মনে করছেন, তাও উল্লেখ করতে হবে। কর্মকর্তা সংশিষ্ট কেস ডায়েরিও ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হস্তান্তর করবেন।”

ক্রিমিনাল রুলস এন্ড অর্ডারস বিধি ৭৫(২) এ যা বলা হয়েছে ম্যাজিস্ট্রেট তদন্ত শেষ করার জন্য অবশ্যই সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী কর্মকর্তাকে চাপ দেবেন।

পি.আর.বি ২১এ প্রবিধানে বলা হয়েছে যে ম্যাজিস্ট্রেট আমল গ্রহণ করে সে তদন্ত প্রক্রিয়া তদারকি করবে।
সাইফুজ্জামান বনাম রাস্ট্র ৫৬ ডিএলআর (২০০৪) পৃষ্ঠা-৩২৪, প্যারা-৫৬, দফা-৭ তে বলা হয় ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট জেল কাস্টডি অথবা পুলিশ কাস্টডিতে রাখার জন্য প্রার্থনা করা হলে পুলিশ অবশ্যই কেইস ডায়েরী সহ আসামী উপস্থাপন করবেন। অন্যথায় ম্যাজিস্ট্রেট তাকে ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৯ ধারায় বন্ড নিয়ে অবশ্যই ছেড়ে দেবেন। উক্ত মামলায় প্যারা ৫৭, লাইন ১৭, ১৮ তে বলা হয় ম্যাজিস্ট্রেট এবং পুলিশগন আদালতের নির্দেশনা অমান্য করলে এবং এতে মানুষের মৌলিক অধিকার লংঘিত হলে উক্ত ম্যাজিস্ট্রেট এবং পুলিশকে আদালত অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত করা হবে।

ক্রিমিনাল রুলস্ এন্ড অর্ডারের ৭৫ (১) বিধিতে আছে যখনই আসামীকে ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট উপস্থাপন করা হবে তখনই কেইস ডায়েরী সহ আসামীকে উপস্থাপন করতে হবে।

বাংলাদেশের সুপ্রীমকোর্টের মাননীয় আপীল বিভাগ ৬৯ ডিএলআর (এডি), পৃষ্টা ৬৩ তে পুলিশের প্রতি নির্দেশনার বলা হয়, পুলিশ আসামীকে অবশ্যই তার নিকট আত্মীয় বা আইনজীবীর সংগে পরামর্শ করার সুযোগ দিবেন। ম্যাজিস্ট্রেটের প্রতি নির্দেশনার বলা হয় কোন পুলিশ কোন আসামীকে অবৈধভাবে আটক রেখেছে মনে হলে ম্যাজিস্ট্রেট উক্ত পুলিশের বিরুদ্ধে  দণ্ডবিধির ২২০ ধারায় অবশ্যই মামলা নেওয়ার জন্য অগ্রসর হবেন।

পুলিশ ধারা ১৭৩ ধারা অনুসারে, পক্ষদের নাম, তথ্যের ধরন, সাক্ষীদের নাম ও সাক্ষ্য, আসামীদের নাম, মালামাল সহ পিআরবি অনুসারে ঘটনাস্থলের স্ক্যাচম্যাপ, খসড়ামানচিত্র সূচী এবং অন্যান্য সাক্ষ্য সহ কার বিরুদ্ধে কি অপরাধ সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখপূর্বক আদালতে রিপোর্ট প্রদান করবেন যাতে ম্যাজিস্ট্রেট ধারা ১৯০(১) অনুসারে মামলা আমলে নিতে পারেন। রাসায়নিক পরীক্ষার রিপোর্টের জন্য পুলিশ রিপোর্ট স্থগিত থাকবেনা। পলাতক আসামী থাকলে তাদেরকে গ্রেফতার ব্যতিত পুলিশ রিপোর্ট আদালতে পাঠাতে হবে। সেই ক্ষেত্রে তাদের সম্পত্তির তালিকাও রিপোর্টে উল্লেখ করতে হবে। (পিআরবির বিধান ২৭২) পুলিশ একই সাথে বাদীকেও মামলার ফলাফল জানাবেন। তবে রিপোর্ট দেয়ার পরও থানার অফিসার ইনচার্জ অতিরিক্ত সাক্ষ্য পেলে (মৌখিক বা দালিলিক) একটি অধিকতর রিপোর্ট প্রদান করতে পারবেন কিন্তুু তাও বাদীকে জানাবেন। আর আসামী দরখাস্তের ভিত্তিতে এ রিপোর্টের একটি কপি পেতে হকদার হয়।

আর পুলিশ ফাইনাল রিপোর্ট প্রদান করলে ক্রিমিনাল রুলস্ এন্ড অর্ডারের রুল ৭৬ অনুসারে কারন উল্লেখ পূর্বক মামলাটি ট্রু, ফলস্, মিসটেক অব ফ্যাক্ট, মিসটেক অব ল, অআমলযোগ্য কিনা রিপোর্ট প্রদান করবেন। আর ম্যাজিস্ট্রেট উক্ত রুল অনুসারে হয়ত ফৌজদারী কার্যবিধির ১৫৬ (৩) অনুসারে অধিকতর তদন্তের আদেশ দিবেন, অথবা মামলাটির অপরাধ ১৯০(১) (বি) অনুসারে কেইস ডকেটের তথ্যাদির ভিত্তিতে ম্যাজিস্ট্রেট আমলে নিতে পারেন এবং ২০৪ ধারার অধীতে প্রসেস ইস্যু করতে পারেন। আর তদন্তকারী অফিসারকে সাক্ষীদের নাম ঠিকানা জমা দিতে বলতে পারেন। এক্ষেত্রে আব্দুল সালাম মাস্টার বনাম রাস্ট্র ,৩৬ ডিএলআর (এডি) ,পৃষ্ঠা ৫৮ এবং সামছুন্নাহার বনাম রাস্ট্র, ৪ বিএলডি, পৃষ্ঠা ২০৬ অনুসরন করতে উক্ত রুলে বলা হয়েছে।

ক্রিমিনাল রুল্স এন্ড অর্ডার এর রুল ৬৮ অনুসারে সংশ্লিষ্ট থানার অফিসার ইনচার্জ সকল পেন্ডিং প্রসেস কারন উল্লেখপূর্বক এনইআর (নন এক্সিকিউটিং রিপোর্ট) প্রদান করতে বাধ্য থাকবেন। রুল ৬৫(২) অনুসারে পুলিশ কোন প্রসেস জারী ব্যতিত কোন ভাবেই ফেলে রাখতে পারবেন না। রুল ২১০ অনুসারে সকল ধ্বংসের সময় একজন ম্যাজিস্ট্রেট উপস্থিত থাকবেন।

সংশ্লিষ্ট চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মহোদয় রুলের ৮৫(৩) বিধি অনুসারে প্রসেস যথাযথ দ্রুত গতিতে জারী হচ্ছে কিনা, ম্যাজিস্ট্রেটদের আদেশ যথাযথ পালন হচ্ছে কিনা, ফৌজদারী কার্যবিধির অধীনে পুলিশ অফিসাররা পুলিশ ফাইলের মামলায় যথাযথ ভূমিকা ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট রাখছে কিনা তার জন্য ইন্সপেকশন সহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে থাকেন এবং সংশ্লিস্ট অফিসারদের বিষয়ে একটি রিপোর্ট তৈরী করেন ও তা এসপি ও মাননীয় সেশন জজ মহোদয়কে পাঠান।

তাই উপরোক্ত আলোচনার আলোকে বলা যায় ফৌজদারী কার্যবিধির অধীনে ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ রেললাইনের মত সমান্তরালভাবে কাজ করে।

লেখক- সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, কুমিল্লা।