স্যার দিনশাহ্ ফারদুনজী মুল্লা উপমহাদেশের আইন জগতের এক কিংবদন্তি। সব্যসাচী এই ক্ষণজন্মা মানুষটির জন্ম ১৮৬৮ সালে ভারতের এক সম্ভ্রান্ত পারসিক পরিবারে। তিনি জরথ্রুস্ট ধর্মানুসারী ছিলেন। আইনাঙ্গনে তার গগনতুল্য সুখ্যাতি ছিলো, ছিলেন একাধারে আইনের অধ্যাপক, লেখক, এটর্নী, বিচারক ও আইন প্রণেতা। মাত্র ছেষট্টি বছরের জীবনে তিনি আইনাঙ্গনকে এতটাই ঋদ্ধ করেছেন যা বর্ণনাতীত।
স্যার ডিএফ মুল্লা অসংখ্য প্রণিধানযোগ্য আইনগ্রন্থ প্রণেতা। আইনশাস্ত্রের এমন কোনো শাখা নেই যেটি তাঁর জাদুস্পর্শে সমৃদ্ধ হয়নি। জরথ্রুষ্ট ধর্মানুসারী হওয়া সত্ত্বেও মুসলিম ও হিন্দু আইনে তার অসাধারণ ব্যুৎপত্তি ছিলো। তারই প্রথম পরিচয় মেলে ১৯০৫ সালে, তিনি রচনা করলেন তার সুবিখ্যাত আইনগ্রন্থ ‘Principles of Mahomedan Law’। ভারতবর্ষে তখন তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে বইটি। পরবর্তীতে তিনি স্যার ফ্রেডরিক পোলকের সাথে যৌথভাবে ভারতীয় চুক্তি আইনের ওপর এক ভাষ্য লিখেন যা লন্ডনের বিখ্যাত সুইট এ্যান্ড ম্যাক্সওয়েল থেকে ১৯০৯ সালে প্রকাশিত হয়। এটি আইন জগতে মুল্লার জনপ্রিয়তাকে ভারতবর্ষ ছাড়িয়ে সুদূর বিলেতেও ছড়িয়ে দেয়। চুক্তি আইনের এ ভাষ্যের মুখবন্ধে স্যার পোলক ডিএফ মুল্লার কাজের ভূয়সী প্রশংসা করেন। উল্লেখ্য প্রখ্যাত ব্রিটিশ আইনবিদ স্যার পোলক অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন। চুক্তি আইনে তার অগাধ পাণ্ডিত্য ছিলো। তবে ইংলিশ আইনের ইতিহাস লিখে তিনি সর্বাধিক প্রসিদ্ধি লাভ করেন।
মুসলিম আইনের পরে স্যার মুল্লা হাত দিলেন হিন্দু আইনে। ১৯১২ সালে তিনি রচনা করলেন আরেক অনন্য আইনগ্রন্থ ‘Principles of Hindu Law’। এছাড়া A Commentary on the Code of Civil Procedure নামে দেওয়ানী আইনের ওপরও তার অসাধারণ এক লেখনী খুঁজে পাওয়া যায়। ১৯২৪ সালে তিনি এডওয়ার্ড মিলার্ড প্রাটের সাথে যৌথভাবে ভারতীয় স্ট্যাম্প আইনের ওপর একটি চমৎকার বই লিখেন। অধিকন্তু সম্পত্তি হস্তান্তর আইন, দেউলিয়া আইন, রেজিস্ট্রেশন আইনের ওপরও তিনি বই লিখেছেন যেগুলো সুখ্যাতি পেয়েছে।
উল্লেখ্য, ১৯০৫ সালে বোম্বে থেকে প্রকাশিত ডিএফ মুল্লার বিখ্যাত বই Principles of Mahomedan Law তে মোট তেরটি অধ্যায় রয়েছে। কালোত্তীর্ণ এ লিগ্যাল ক্ল্যাসিকটি মুসলিম আইনের এক শ্রেষ্ঠ ভাষ্য হিসেবে উপমহাদেশে সমৃাদত হয়ে আসছে। এটি ডিএফ মুল্লার magnum opus বা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কর্ম হিসেবে সর্বজনবিদিত। শিক্ষার্থীবান্ধব এ বইটির মূল্য তখন ছিলো তিন রুপি। মুল্লা তার জীবদ্দশাতেই এ বইটির দশটি সংস্করণ বের করেন। সর্বশেষ ১৯৩৩ সালে বইটির দশম সংস্করণ বের করেন তিনি। তুমুল জনপ্রিয় এ বইটির অদ্যাবধি নব নব সংস্করণ বের হচ্ছে। সম্প্রতি ভারতের বিখ্যাত প্রকাশনী Lexis Nexis এ বইটির ২২ তম সংস্করণ বের করেছে। মুল্লা তার এ বইটি লেখার পেছনে অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন হেদায়া, ফতোয়ায়ে আলমগীরীর মতো শ্রেষ্ঠ মুসলিম আইনতত্ত্বগুলো থেকে। তবে অধ্যাপক রামসের লেখা Mahommedan Law of Inheritance তাকে বেশ প্রভাবিত করেছিলো। উল্লেখ্য,আলমারিক রামসে ছিলেন লন্ডনের কিংস কলেজের প্রথিতযশা আইনের অধ্যাপক। এছাড়া হিন্দু আইনের ওপর মুল্লার লেখা Principles of Hindu Law বইটি দীর্ঘায়তনের এক বিশ্লেষণাত্মক ও অত্যন্ত পাণ্ডিত্যপূর্ণ লেখনী। ৭৪৮ পৃষ্ঠার এ সুবিশাল বইটিতে তার আইনী জ্ঞানের গভীরতার ছাপ সুস্পষ্ট।
স্যার ডিএফ মুল্লার বইগুলো আজ অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে গেছে। সত্যিই তার জুড়ি মেলা ভার। মুসলিম আইন ও হিন্দু আইনের উপর প্রণীত তাঁর গ্রন্থদ্বয় আজও আমাদের আইন শিক্ষায় অতি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে। প্রজন্ম-প্রজন্মান্তরে উপমহাদেশের আইনের শিক্ষার্থী ও আইন পেশার সাথে সম্পৃক্ত প্রতিটি ব্যক্তির কাছে ডিএফ মুল্লা এক সুপরিচিত বিদগ্ধজন। আইনজীবী ও বিচারকমহলে স্যার ডিএফ মুল্লার লেখনী সুগভীর ছাপ ফেলেছে। বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের আদালতসমূহে আজও স্যার মুল্লার আইনের ভাষ্যকে অত্যন্ত গুরুত্বের চোখে দেখা হয়। এইতো অতি সম্প্রতি ভারতের পাঞ্জাব ও হরিয়ানা হাইকোর্ট এক মামলার রায়ে অভিমত দেন যে, একজন মুসলিম নারী বয়ঃসন্ধিকালে উপনীত হলে তার পছন্দসই কাউকে মুসলিম পারিবারিক আইন অনুসারে বিয়ে করতে পারেন। উল্লেখ্য, স্যার ডিএফ মুল্লার Principles of Mahomedan Law গ্রন্থের ১৯৫ নং অনুচ্ছেদের আলোকে আদালত এ ঐতিহাসিক রায় দেন।
সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও দারিদ্রতার সাথে সংগ্রাম করতে হয়েছে মুল্লাকে। তবে পড়াশোনায় ছিলো তার অদম্য আগ্রহ। শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তিনি পড়াশোনা চালিয়ে যান এবং সাফল্যের সাথে তার শিক্ষাজীবনের প্রতিটি ধাপ সমাপ্ত করেন। ডিএফ মুল্লার আইন পেশায় আগমনের এক চমকপ্রদ ইতিহাস রয়েছে। ২০১০ সালে প্রকাশিত সাড়া জাগানো আত্মজীবনী গ্রন্থ ‘Before Memory Fades’-এ প্রখ্যাত আইনবিদ ও ভারতের সুপ্রীম কোর্টের সিনিয়র এ্যাডভোকেট ফালি সাম নারিমান মুল্লার আইন পেশায় আগমনের সেই সরস ইতিহাস তুলে ধরেছেন।
নারিমান তার বইতে লিখেছেন- মুল্লা কলেজে ইংরেজি বিষয়ে অধ্যয়ন কালে নিয়মিত ইংরেজি কবিতা লিখতেন। তিনি নিজেকে কবি ভাবতেও শুরু করে দিয়েছিলেন। ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক শেষে তিনি মনস্থির করেন যে কবি হবেন, কবিতা লিখেই বাকী জীবনটা কাটিয়ে দেবেন। কিন্তু তার এক শুভাকাঙ্খী তাকে আইন পেশায় সম্পৃক্ত হওয়ার পরামর্শ দেন। ফলে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়লেন মুল্লা, কাগজ-কলম হাতে নিলেন, অকস্মাৎ তিনি এক পত্র লিখলেন সেই সময়ের ব্রিটিশ রাজকবি লর্ড টেনিসনের কাছে, পত্রের সাথে মুল্লা তার নিজের লেখা পছন্দসই কিছু কবিতাও পাঠালেন। অতঃপর মুল্লা উৎকন্ঠিত চিত্তে তার লেখা পত্রের উত্তরের অপেক্ষায় দিন কাটাতে থাকলেন। সেই সময়ে কেবলমাত্র সমুদ্রপথেই ভারত হতে ইংল্যান্ডে চিঠি যেতো। অবশেষে বেশ কিছুদিন বাদে মুল্লা সেই চিঠির উত্তর পেলেন। তাও আবার স্বয়ং টেনিসনের লেখা চিঠি। প্রত্যুত্তরে বেশ সরলভাবেই টেনিসন লিখেছিলেন- প্রিয় মুল্লা, আমি অত্যন্ত সতর্কতার সাথে তোমার পাঠানো সবগুলো কবিতা পড়েছি। আমার মনে হয় কাব্যচর্চার পরিবর্তে তোমার আইন বেছে নেওয়া উচিত। মুল্লার দ্বিধা কেটে গেলো। পরবর্তীকালে তিনি বোম্বে হাইকোর্টে আইনজীবী হিসেবে যোগদান করলেন। সেদিন টেনিসন যদি মুল্লাকে কাব্যচর্চায় উৎসাহিত করতেন তাহলে ভারতবর্ষ তার এক সেরা আইনরত্ন হারাতো।
বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবন ছিলো স্যার মুল্লার। পেশাজীবনে একদা তিনি বোম্বে হাইকোর্টের একজন এটর্নী ছিলেন আবার সেই আদালতেরই পরবর্তীতে বিচারক হন। স্যার মুল্লা ১৯২৮ সালে তৎকালীন ভারতবর্ষের গভর্নর জেনারেলের কাউন্সিলের আইন সদস্য মনোনীত হন। এছাড়া তিনি এশিয়ার অন্যতম পুরোনো, ঐতিহ্যবাহী বোম্বে সরকারী আইন মহাবিদ্যালয়ের প্রিন্সিপাল ও একজন স্বনামধন্য অধ্যাপক হিসেবে খ্যাতি কুড়িয়েছেন। তবে তার সাফল্যের ঝুড়িতে স্বর্ণপালক হিসেবে যেটি জ্বলজ্বল করছে সেটি হলো তিনি ১৯৩০ সালে তৎকালীন প্রিভি কাউন্সিলের বিচারক হিসেবে মনোনীত হন। প্রথম পারসিক বিচারক হিসেবে ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। উল্লেখ্য, ১৯৩০ সালের ৫ এপ্রিল বাকিংহাম প্যালেসে তিনি ব্রিটিশ সম্রাট পঞ্চম জর্জের নিকট হতে অত্যন্ত সম্মানজনক খেতাব ‘নাইট’ উপাধিতে ভূষিত হন। ডিএফ মুল্লা বোম্বে হাইকোর্টে আইনজীবী হিসেবে দুর্দান্ত ছিলেন, তার ভাই রুস্তমজি মুল্লাকে সাথে নিয়ে ১৮৯৫ সালে তারা ‘মুল্লা এ্যান্ড মুল্লা’ নামে এক ল’ ফার্ম প্রতিষ্ঠা করেন। ১২৬ বছরের পুরোনো এ ল’ ফার্মটি এখন ভারতের অন্যতম সেরা ল’ ফার্ম।
আরেকটি তথ্য এখানে যোগ করতে চাই, লন্ডনের ন্যাশনাল পোট্রেইট গ্যালারীতে বিখ্যাত ব্রিটিশ ফটোগ্রাফার ওয়াল্টার আর্নেস্ট স্টোনম্যানের তোলা ডিএফ মুল্লার ছবিটি দেখে বোঝা যায় যে, প্রৌঢ়ত্বে হালকা-পাতলা গড়নের ছিলেন তিনি এবং তখন নিয়মিত চশমা পড়তেন। ছবিটি ১৯৩১ সালে তোলা হয়েছিল। এখানে বলে রাখা আবশ্যক যে, ১৮৫৬ সালে প্রতিষ্ঠিত লন্ডনের ন্যাশনাল পোট্রেইট গ্যালারী বিশ্বের প্রথম পোট্রেইট গ্যালারী। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যাধীন তৎকালীন বিখ্যাত ব্রিটিশ ব্যক্তিত্বের প্রতিকৃতিসমূহ সেই আর্ট গ্যালারীতে রাখা হতো। ১৬৫ বছর যাবত অদ্যাবধি সগৌরবে এ আর্ট গ্যালারীটি টিকে আছে। নিকোলাস কালিনান বর্তমানে এটির পরিচালক। সেই গ্যালারীতে আজও স্যার মুল্লার ছবিটি দেখতে পাওয়া যায়।
স্যার মুল্লার বইগুলো আজ আবশ্যকীয় পাঠ্যবই হিসেবে আইনের শিক্ষার্থীদের বইয়ের টেবিলে পৌঁছে গেছে। টেক্সট বুক হিসেবে তাঁর বইগুলো আজ আইনাঙ্গনে সমাদৃত। বলে রাখা ভালো যে, তাঁর লেখনীর আলোকেই আজ শত শত মুসলিম আইনের বই বের হচ্ছে। সমকালীন আইনের লেখকগণের কাছে তাই মুল্লা এক বিশ্বস্ত নাম। এমন কোনো আইনের মানুষ আজ খুঁজে পাওয়া যাবে না যিনি মুল্লার বই পড়েন না।
প্রাতঃস্মরণীয় এ মানুষটি গত হয়েছেন ১৯৩৪ সালে। আজ স্যার মুল্লা আমাদের মাঝে নেই কিন্তু তার রেখে যাওয়া অমূল্য উপহার, তার চিন্তা ও শ্রমের ফসল, তার শ্রেষ্ঠ লেখনীগুলো আজও আমাদেরকে প্রতিনিয়ত ঋদ্ধ করছে। উপমহাদেশের আইনাঙ্গনকে যে কজন ক্ষণজন্মা মানুষ চিরসমৃদ্ধ করেছেন এ মহান আইনবিদ তাদেরই একজন। আইন পরিবারের প্রতিটি মানুষ তাই আজ তার কাছে চিরঋণী। প্রথিতযশা এ আইনজ্ঞের পূন্যস্মৃতির তরে হৃদয়ার্ঘ্য নিবেদন করছি।
লেখক- মো: সালাউদ্দিন সাইমুম: সহকারী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।