আমানতকারীর মৃত্যুর পর ব্যাংক বা অন্য কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানে গচ্ছিত অর্থ ও সম্পদের অধিকারী হবেন নমিনি মর্মে একটি রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট।
বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের এর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ নমিনি সংক্রান্ত একটি রীট আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের ২৭ আগস্ট এই রায় দেন। সম্প্রতি এ সংক্রান্ত একটি পূর্নাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছে।
২৩ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ে হাইকোর্ট বলেছেন, নমিনি সংক্রান্ত আইন, বিধি-বিধান মেনে যদি কোথাও নমিনি থাকে তাহলে আমানতকারী, বন্ডধারী, শেয়ারহোল্ডার, পেনশনধারী ইত্যাদি ব্যক্তির মৃত্যুর পর সংশ্লিষ্ট নমিনি আমানতকৃত সকল অর্থ বা অন্যান্য সুবিধাদির অধিকারী হবেন। রায়ে উল্লেখ করা হয়, বিদ্যমান সকল আইন ও বিধিবিধানে বলা হয়েছে আমানতকারীর মৃত্যুর পর নমিনিকৃত আমানত বা সুবিধাদি গ্রহণে নমিনিই অধিকারী হবেন এবং অন্যান্য সকল ব্যক্তি এই অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন। (73 DLR, April 2021 Issue).
এর আগে নমিনি থাকা সত্ত্বেও রীটের আবেদনকারীকে তার পাওনা পরিশোধে বিলম্বকে কেন অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণা এবং আবেদনকারীকে তার পাওনা পরিশোধের জন্য নির্দেশ দেয়া হবে না তা জানতে চেয়ে হাইকোর্ট রুল দেন।
আদালত রীটের আবেদনকারী, প্রতিপক্ষসমূহ, ইতিপূর্বে নমিনি বিষয়ে ২০১৬ সালের ৩ এপ্রিল হাইকোর্টের অন্য একটি বেঞ্চ এর ২০১৫ সালের ১৬৮২ নম্বর সিভিল রিভিশন মামলার রায়, এটর্নি জেনারেল অফিসের বক্তব্য এবং নমিনি বিষয়ে দেশের প্রচলিত আইন ও যুক্তিতর্ক বিশ্লেষণ করে নমিনির অধিকার ও দাবী এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের করনীয় বিষয়ে এই রায় ও দিকনির্দেশনা প্রদান করেন।
রায়ের নোটিশ পাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট নমিনিকে নমিনিকৃত অর্থ বা সম্পদের শতভাগ প্রদানের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির ওয়ারিশদের কোনো দাবী আমানতকৃত অর্থ বা সম্পত্তি নমিনিকে বুঝিয়ে দিতে ব্যাংক বা কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য বাধা হিসেবে পরিগনিত হবে না।
উল্লেখ্য, নমিনি হিসেবে নিযুক্ত থাকা এবং বারবার আবেদন সত্ত্বেও পাওনা বুঝিয়ে না দেয়া ও শরিকরা আদালতে উত্তরাধিকার আইনে মামলার আশ্রয় নিলে রুপালী ব্যাংকের মৃত প্রাক্তন প্রিন্সিপাল অফিসার এর দ্বিতীয় স্ত্রী মোসাম্মত ফিরোজা বেগম সংক্ষুব্ধ হয়ে নমিনি অনুযায়ী পাওনা পরিশোধের জন্য বাংলাদেশ সরকার, সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও অন্যান্য প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে এই রীট পিটিশন দায়ের করেন।
হাইকোর্ট রায়ে আরো উল্লেখ করেন , ব্যাংক কোম্পানী আইন, ১৯৯১ অনুযায়ী নমিনিকে তার পাওনা বুঝিয়ে দেয়া ব্যাংকের দায়িত্ব। পাওনা বিতরন করা হয়ে গেলে ব্যাংক তার দায়িত্ব থেকে মুক্ত হয়ে যায়। জমাকৃত অর্থের বিষয়ে কোনো বিরোধ কিংবা কোনো ব্যক্তির কোনোরূপ দাবী বিষয়ে ব্যাংকের কিছুই করণীয় নেই। কোনোরূপ মামলা-মোকদ্দমাকে আমন্ত্রন জানানো কিংবা মৃতের অর্থ বা সম্পদ বিষয়ে কোনো ব্যক্তির দাবী উপস্থাপনের জন্য ব্যাংকের অপেক্ষা করা উচিত নয়। যদি কারো কোনো দাবী থেকে থাকে তাহলে সেটা উপযুক্ত ফোরামে সমাধানের দায়িত্ব নমিনির, যিনি অর্থ গ্রহণ করেছেন।
এ ব্যাপারে রীটকারীর আইনজীবী ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, মাননীয় হাইকোর্ট বলেছেন নমিনি সিস্টেমটা বৈধ এবং নমিনী সিস্টেমটাই থাকবে। ব্যাংক কোম্পানী আইন ১৯৯১, ইন্সুরেন্স অ্যাক্ট, গভর্নমেন্ট সেভিং ব্যাংকস অ্যাক্ট ১৮৭৩, পোস্ট অফিস ন্যাশনাল সেভিংস সার্টিফিকেট অধ্যাদেশ ১৯৪৪, ইন্সুরেন্স অ্যাক্ট ২০১০, কো-অপারেটিভ সোসাইটিস অ্যাক্ট ২০০১, পেনশন সহজীকরন বিধিমালাসহ পার্লামেন্ট কর্তৃক পাশ করা বহু আইন আছে যেখানে বলা আছে আমানতকারীর ইচ্ছা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট নমিনি এই অর্থ বা সুবিধা পাবেন। এই ধরনের কোনো আইন বা এর কোনো অংশকে কোনো মামলায় কখনো অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হয়নি।
এর আগে ২০১৬ সালের ৩ এপ্রিল হাইকোর্ট এর একটি বেঞ্চ ২০১৫ সালের ১৬৮২ নম্বর সিভিল রিভিশন মামলায় আমানতকারীর মৃত্যুর পর তার জমাকৃত অর্থ উত্তরাধিকারীগণ পাবেন মর্মে একটি রায় প্রদান করেছিলেন।
উক্ত রায়ের পর বিভিন্ন আর্থিক ও বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানে নমিনি ও উত্তরাধিকার বিষয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হলে বাংলাদেশ ব্যাংক আমানতকারীর মৃত্যুর পর নমিনি বা নমিনিগনকে অর্থ প্রদানের নির্দেশনা দিয়ে ২০১৭ সালের ১৯ এপ্রিল বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ’ কর্তৃক বিআরপিডি সার্কুলার নম্বর ৬ এবং ২০১৭ সালের ১২ জুন আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগ’ কর্তৃক ডিএফআইএম সার্কুলার নম্বর ২ জারী করে। উক্ত সার্কুলার দেশের সকল ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ নমিনি আছে এমন সব প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রযোজ্য।
এই প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার শামীম হায়দায় পাটোয়ারী বলেন, হাইকোর্টের উক্ত রায়ে নমিনি সংক্তান্ত সংশ্লিষ্ট আইন বা আইনের কোনো প্রভিশনকেও বাতিল করা হয়নি। উক্ত রায়টি ছিল দেওয়ানি প্রকৃতির। সেখানে কোনো আইনকে অবৈধ বা অসাংবিধানিক ঘোষণা করার এখতিয়ার উক্ত বেঞ্চের ছিল না। প্রতিটি রায়ের একটি নির্দেশনামূলক ও একটি ব্যাখ্যামূলক অংশ থাকে। উক্ত বেঞ্চ যে রায় দিয়েছিলেন সেটা শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট মামলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল বলে আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয়।
তিনি আরো বলেন, নমিনি সংক্রান্ত বিদ্যমান সকল আইনই বর্তমানে বহাল আছে। কোনো কারণে যদি নমিনি সিস্টেমটা বন্ধ বা বাতিল করা হয় তাহলে দেশের অর্থনৈতিক সেক্টরে সেটার একটা ব্যাপক প্রভাব পড়বে। কারন, বিভিন্ন সেক্টরে দেশে লক্ষ লক্ষ নমিনি বর্তমানে পেন্ডিং আছে এবং আমানতকারী ছাড়া তাদেরকে পরিবর্তন করা যাবে না।
উল্লেখ্য, দেশের সকল সরকারী চাকুরী, প্রভিডেন্ট ফান্ড সিস্টেম আছে এমন বেসরকারী অফিস, ব্যাংক, বীমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, লগ্নীকারী প্রতিষ্ঠান, রিয়েল এস্টেট কোম্পানী, সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতিসহ প্রায় সব প্রতিষ্ঠানে নমিনি ফর্ম পূরণ করা বাধ্যতামূলক।
: অ্যাডভোকেট তানবীর সিদ্দিকী