এমবিবিএস এবং বিডিএস ডিগ্রিধারী ছাড়া অন্য কেউ নামের আগে ডাক্তার পদবি ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে উচ্চ আদালতের রায় বাস্তবায়নে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে সরকার। সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আইন শাখা থেকে এ সংক্রান্ত স্মারক সারাদেশের সিভিল সার্জনের প্রতি প্রেরণ করা হয়।
অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের পক্ষে আইন শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক ডা: পরিমল কুমার পাল স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তি গত ৫ জানুয়ারি জারি করা হয়।
এতে বলা হয়, সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের রিট পিটিশন (নং ৫৩৫/২০১৯) মোকদ্দমার রায় অনুযায়ী বিকল্প ধারার চিকিৎসা পদ্ধতির পেশাধারীরা নামের পূর্বে ডাক্তার লিখতে পারবেন না। বিএমডিসি আইন ২০১০ -এর ২৯ ধারা মোতাবেক নিবন্ধনভুক্ত মেডিক্যাল বা ডেন্টাল ইন্সটিটিউট কর্তৃক এমবিবিএস অথবা বিডিএস ডিগ্রিধারী ছাড়া কেউ নামের আগে ডাক্তার পদবি ব্যবহার করতে পারবেন না।
তবে বিকল্প ধারার চিকিৎসা পদ্ধতির পেশাধারীরা নামের পূর্বে- ইন্টিগ্রেটেড ফিজিশিয়ান, কমপ্লিমেন্টারি ফিজিশিয়ান, ইন্টিগ্রেটেড মেডিসিন প্র্যাকটিশনার এবং কমপ্লিমেন্টারি মেডিসিন প্র্যাকটিশনার পদবি ব্যবহার করতে পারবেন বলে স্মারকে উল্লেখ করা হয়।
এ সংক্রান্ত আপীল মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত রিট পিটিশন (নং ৫৩৫/২০১৯) মোকদ্দমার রায় বহাল থাকবে।
উচ্চ আদালতের রায়
এমবিবিএস ও বিডিএস ডিগ্রিধারী ছাড়া অন্য কেউ ডাক্তার পদবি ব্যবহার করতে পারবেন না বলে একটি রায় দিয়েছিল হাইকোর্ট। এতে বলা হয়, হোমিওপ্যাথি, ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক কর্মকর্তাদের নামের আগে ডাক্তার পদবি সংযোজনের অনুমতি দেওয়া বেআইনি।
২০২০ সালের ১৯ নভেম্বর বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই রায় দেন। ৭১ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টি গত বছর অর্থাৎ ২০২১ সালের ১২ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়।
বিকল্প চিকিৎসাব্যবস্থার জন্য পৃথক নিয়ন্ত্রণ সংস্থা গঠন ও বিকল্প চিকিৎসাব্যবস্থায় ডিগ্রিধারীদের নামের আগে ডাক্তার ব্যবহার করতে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়নের নির্দেশনা চেয়ে করা রিট খারিজ (রুল খারিজ) করে দেওয়া রায়ে এই অভিমত দিয়েছেন আদালত। প্রয়োজনে বিকল্প ধারার চিকিৎসাপদ্ধতির পৃথক মন্ত্রণালয় তথা ‘ভারত সরকারের আয়ুশ মন্ত্রণালয়’–এর আদলে দেশে একটি পৃথক মন্ত্রণালয় গঠন করাসহ চার দফা পরামর্শ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
রায়ে বলা হয়, দুঃখজনকভাবে এটি লক্ষণীয় যে এখানে ২০১০ সালের বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল আইনের ২৯ ধারা অনুযায়ী বিএমডিসির নিবন্ধনভুক্ত মেডিকেল বা ডেন্টাল ইনস্টিটিউট থেকে এমবিবিএস অথবা বিডিএস ডিগ্রিধারী ছাড়া অন্য কেউ তাদের নামের আগে ডাক্তার (Dr.) পদবি ব্যবহার করতে পারবেন না। সেখানে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের ২০১৪ সালের ৩ সেপ্টেম্বরের সংশোধিত বিজ্ঞপ্তিতে ‘অল্টারনেটিভ মেডিকেল কেয়ার’ শীর্ষক অপারেশনাল প্ল্যানের বিভিন্ন পদে কর্মরত হোমিওপ্যাথি, ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক কর্মকর্তাদের নিজ নিজ নামের আগে ডাক্তার পদবি সংযোজনের অনুমতি প্রদান করেছে, যা এককথায় আইনের কর্তৃত্ব ব্যতীত তথা বেআইনি। এ ছাড়া বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক বোর্ড থেকে ২০২০ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি জারি করা বিজ্ঞপ্তিতে বিভিন্ন শাখায় হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকদের তাঁদের নামের আগে পদবি হিসেবে ডাক্তার ব্যবহারের অনুমতি প্রদান করাও বেআইনি।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, বিকল্প ধারার চিকিৎসাপদ্ধতির পেশাধারীরা নামের আগে ইন্টিগ্রেটেড ফিজিশিয়ান, কমপ্লিমেন্টারি ফিজিশিয়ান, ইন্টিগ্রেটেড মেডিসিন প্র্যাকটিশনার এবং কমপ্লিমেন্টারি মেডিসিন প্র্যাকটিশনার পদবি ব্যবহার করতে পারেন। ভারতেও বিকল্প ধারার চিকিৎসকেরাও ডাক্তার লিখতে পারেন না।
বিকল্প চিকিৎসাপদ্ধতি পাঁচ হাজার বছরের প্রাচীন
বিকল্প চিকিৎসাপদ্ধতি পাঁচ হাজার বছরের প্রাচীন উল্লেখ করে রায়ে বলা হয়, সুতরাং পাঁচ হাজার বছর যাবৎ সমগ্র পৃথিবীতে চলে আসা প্রাচীন বিকল্প চিকিৎসাপদ্ধতির যথাযথ এবং সঠিকভাবে পঠন এবং প্রশিক্ষণ জনমানুষের সামগ্রিক চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নয়ন করবে। প্রচলিত চিকিৎসাপদ্ধতি তথা পশ্চিমা চিকিৎসাপদ্ধতি আইনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হওয়া শুরু হয় আজ থেকে ১৬২ বছর আগে। পৃথিবীর প্রথম প্রচলিত চিকিৎসাপদ্ধতির আইনটির নাম ‘দ্য মেডিকেল অ্যাক্ট, ১৮৫৮’, যা ইংল্যান্ডের সংসদ পাস করেছিল। অর্থাৎ ১৮৫৮ সালের আগে চিকিৎসাব্যবস্থা আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল না। অন্যদিকে পাঁচ হাজার বছর আগে থেকে মানুষ বিকল্প চিকিৎসাপদ্ধতি গ্রহণ করে আসছে।
চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক্-স্বাধীনতাসংক্রান্ত সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ তুলে ধরে রায়ে বলা হয়, প্রত্যেক নাগরিক তার বিবেকের মাধ্যমে এবং চিন্তার মাধ্যমে কোন পদ্ধতির চিকিৎসা তথা প্রচলিত বা পশ্চিমা বা অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা গ্রহণ করবে নাকি বিকল্প চিকিৎসাপদ্ধতি গ্রহণ করবেন, এটি সম্পূর্ণ তার মৌলিক অধিকার। পেশা বা বৃত্তির স্বাধীনতাসংক্রান্ত সংবিধানের ৪০ অনুচ্ছেদ উল্লেখ করে রায়ে বলা হয়, একজন নাগরিক প্রচলিত চিকিৎসক হবেন, না বিকল্প ধারার চিকিৎসক হবেন, এটি তাঁর মৌলিক অধিকার।
রায়ে আদালত বলেছেন, সুতরাং বিকল্প ধারার কিংবা প্রচলিত চিকিৎসক হওয়ার নিমিত্তে প্রয়োজনীয় আইনি কাঠামো প্রস্তুত করে দেওয়া সরকারের অন্যতম দায়িত্ব। বিকল্পধারার চিকিৎসা ব্যবস্থা শুধুমাত্র হোমিওপ্যাথি, ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক–এর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।
পৃথক মন্ত্রণালয় গঠনসহ চার দফা পরামর্শ
রায়ে বলা হয়, সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদ অনুসারে চিকিৎসা পাওয়া প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকার। সে কারণে নিম্নবর্ণিত পরামর্শ প্রদান করা হলো।
প্রথম দফায় বলা হয়, ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে ‘কাজাখাস্তান ঘোষণা’ থেকে ‘আলমাআটা ঘোষণা’ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সার্বিক পরিকল্পনা, নীতিমালা এবং প্রয়োজনীয় আইন দ্রুত প্রণয়নের জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে পরামর্শ দেওয়া হলো।
দ্বিতীয় দফায় বলা হয়, সার্বিক চিকিৎসাব্যবস্থাপনায় তথা প্রচলিত এবং বিকল্প ধারার চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় ‘রোগীকেন্দ্রিক চিকিৎসা সেবা’ নীতিমালা অনুসরণের পরামর্শ দেওয়া হলো।
তৃতীয় দফায় বলা হয়, প্রয়োজনে বিকল্প ধারার চিকিৎসাপদ্ধতির পৃথক মন্ত্রণালয় তথা ‘মিনিস্ট্রি অব আয়ুশ গর্ভনমেন্ট অব ইন্ডিয়া’–এর আদলে বাংলাদেশে একটি পৃথক মন্ত্রণালয় সৃষ্টি করার পরামর্শ দেওয়া হলো।
চতুর্থ দফায় বলা হয়, বিকল্প ধারার চিকিৎসাশাস্ত্র সম্পর্কিত শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও সেবার মান নির্ধারণ ও উন্নয়ন এবং বিকল্প ধারার চিকিৎসাশাস্ত্র সংশ্লিষ্ট বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও প্রদত্ত ডিগ্রিগুলোকে স্বীকৃতি প্রদান করার পদ্ধতি নির্ধারণ করার পরামর্শ দেওয়া হলো।
প্রসঙ্গত, ন্যাশনাল মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশসহ ৯৭ ব্যক্তি ২০১৯ সালে ওই রিট আবেদন করেন। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ওই বছরের ২১ জানুয়ারি হাইকোর্ট রুল দেন। চূড়ান্ত শুনানি শেষে রুল খারিজ করে হাইকোর্ট ২০২০ সালের ১৯ নভেম্বর ওই রায় দেন।
রিটের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী রাশনা ইমাম ও খন্দকার নীলিমা ইয়াসমিন। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের পক্ষে ছিলেন তানজিব উল আলম, সাকিবুজ্জামান ও ইমরান আনোয়ার। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ওয়ায়েস আল হারুনী। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী তাপস কুমার বিশ্বাস।