বাংলাদেশ শিল্পী কল্যাণ ট্রাস্ট আইন, ২০০১ একটি সাধারণ আলোচনা
শাহ্ মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান

বাংলা একাডেমির দু’টি আইনের নেপথ্যে…

শাহ্ মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান: সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আইনের অনুশাসন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে আইনের অনুশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে সকল কর্মচারী ও সেবাগ্রহীতা নানা সুযোগ-সুবিধা পেতে পারে। এজন্য প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনার সাথে আইন, প্রবিধানমালা ও বিধিমালা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সে জন্য প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য যুগোপযোগী আইন, প্রবিধানমালা এবং বিধিমালা প্রণয়নের বিকল্প নেই। প্রত্যেক প্রতিষ্ঠান তার কার্যপ্রণালী আইন, প্রবিধান ও বিধি মোতাবেক পরিচালিত হয়। এসব আইন, বিধিমালা, প্রবিধানমলার ক্ষেত্রে বিশেষ সাধারণ নাগরিকের জন্যও প্রযোজ্য হয়। কারণ সেবা প্রত্যাশীদের এসব বিধি-প্রবিধান সম্পর্কে ধারণা না থাকলে তারা সেবা গ্রহণ করবেন কিভাবে। এজন্য বলা হয় হয় সংবিধান যেমন সব নাগরিকের জন্য এসব আইনও সব নাগরিকের জন্য প্রযোজ্য। আইনের দৃষ্টিতে বাংলা একাডেমি একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা। সংবিধিবদ্ধ সংস্থায় নিজস্ব আইন এবং উক্ত আইনের ক্ষমতাবলে বিধি ও প্রবিধানমালা ব্যতীত প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় নানা সমস্যা হয়।

কেননা, প্রাতিষ্ঠানিক আইন রুল বেইজড। প্রতিষ্ঠানের আইনে জেনারেল একটা প্রভিশন লে-ডাউন করে দেওয়া হয়। বাংলা একাডেমির কার্যপ্রণালী পরিচালনার ক্ষেত্রেও উপর্যুক্ত কথাগুলো সমভাবে প্রযোজ্য। বাংলা একাডেমির আইনও রুল বেইজড আইন, একাডেমির আইনের আলোকে প্রসিডিউরুগুলো প্রবিধান বা রুলের মাধ্যমে করতে হয়। বর্তমানে একাডেমি ‘বাংলা একাডেমি আইন, ২০১৩ এবং একাডেমির চাকরি প্রবিধানমালা, ২০২১ ও সরকারের প্রচলিত আইন দ্বারা বাংলা একাডেমি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। এই সকল আইনকে প্রাতিষ্ঠানিক বা প্রশাসনিক আইন বলা হয়। বাংলা একাডেমিতে বর্তমানে প্রবর্তিত এ দুটি আইনের নেপথ্যের কথা আলোচনার আগে এ প্রতিষ্ঠানের আইন বিষয়ে একটু বলা প্রয়োজন।

বাংলা একাডেমি ৩রা ডিসেম্বর ১৯৫৫ সালে প্রতিষ্ঠা যাত্রা শুরুর অনেক পরে এ প্রতিষ্ঠানকে আইনি কাঠামো প্রদান করা হয়েছিল। এটা করা হয়েছিল বাংলা একাডেমি অ্যাক্ট, ১৯৫৭ কার্যকর হওয়ার মাধ্যমে। এদেশের একমাত্র প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমির ক্ষেত্রে এ ঘটনা ঘটেছে- যা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ঘটেনি। উল্লেখ্য, বাংলা একাডেমি বিল, ১৯৫৭ পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদে ০৩.০৪.১৯৫৭ তারিখে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। বিলটি পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদে পাস হওয়ার পর ১০.০৬.১৯৫৭ তারিখে পূর্ব বাংলার গভর্নরের সম্মতি লাভ করে বাংলা একাডেমি আইন, ১৯৫৭ পরিণত হয়। অতঃপর এই আইন ঢাকা গেজেটে প্রকাশিত এক ঘোষণার মাধ্যমে ১০.০৮, ১৯৫৭ তারিখ থেকে কার্যকর হয়।

কিন্তু এ আইন জারি হওয়ার পূর্বে ১৯৫৫ সালের তৎকালীন পূর্ব বাংলা সরকারের (পূর্বপাকিস্তান সরকার) এক সিদ্ধান্তের আলোকে বাংলা একাডেমির আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠার পূর্বেই একাডেমিার যাত্রা অনানুষ্ঠানিকভাবে শুরু করেছিল। বলা যায়, তৎকালীন সরকার বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠায় বাধ্য হয়েছিল। একাডেমির আইন কাঠামোর মতোই এটিও ব্যতিক্রমী ঘটনা। এটা সম্ভব হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের অমর শহিদদের চেতনা, যুক্তফ্রন্ট সরকারের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি, ছাত্রদের অব্যাহত চাপ, সাধারণ মানুষের দাবি ইত্যাদি উদ্ভূত প্রেক্ষিতে।

জানা যায়, পূর্ব বাংলা সরকার বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৫৫ সালের ২৬শে নভেম্বর আয়োজক সমিতি (Preparatory Committee) গঠন করেছিলেন। এই আয়োজক সমিতির অন্যতম সদস্য ছিলেন ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ (১৮৮৫-১৯৬৯)। ১৯৫৫ সালের ২রা ডিসেম্বর আয়োজক কমিটি পূর্ব বাংলা সরকারের কাছে একটি প্রতিবেদন প্রদান করেন। এই পরিপ্রেক্ষিতেই ১৯৫৫ সালের ৩রা ডিসেম্বর বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার শুভ উদ্বোধন হয়। একারণে ৩রা ডিসেম্বর বাংলা একাডেমির প্রতিষ্ঠা দিবস পালন করা হয়ে থাকে।

ভাষা আন্দোলনের অমর শহিদের বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে পাওয়া বাংলা একাডেমি। বাংলা একাডেমির জন্ম ও বিকাশ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গঠন প্রক্রিয়ার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করা। এই প্রতিষ্ঠা অর্জনের নেপথ্যে ভাষা আন্দোলন অনুপ্রেরণা ও আদর্শের প্রতীকরূপে কাজ করেছে- আর বাংলা একাডেমি ভাষা আন্দোলনেরই প্রত্যক্ষ ফসল। একুশ আমাদের চেতনা, একুশ আমাদের পরিচয়। এদেশের মানুষের নিজের জাতীয় পরিচয়ের (Identity) উপাদান বাংলা একাডেমিতেই খুঁজতে হয়। বাংলা ভাষা ও বাঙালিত্ব আমাদের পরিচয়। বাংলাদেশ-ভাষা আন্দোলন- বাংলা একাডেমি এই প্রত্যয়গুলো অবিচ্ছিন্ন সত্ত্বা। এ জন্যই বলা হয় বাংলা একাডেমি বাঙালি জাতিসত্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষের প্রতীক, জাতির মননের প্রতীক।

স্বাধীনতার পর নবপ্রসূত দেশ গঠনের সময় একাডেমির জন্য ভালো একটা আইন প্রণয়ন করা হয়। পাকিস্তান আমলের আইন রদ করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বাংলা একাডেমি আদেশ, ১৯৭২ জারি করেছিলেন। এই আদেশটি ছিল উত্তম।

এভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধোত্তরকালে বাংলা একাডেমি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমতুল্য প্রতিষ্ঠানরূপে পুরাদস্তুর যাত্রা শুরু করেছিল। এ সময় একাডেমি ‘The Bangla Academy Order, 1972 (P. O. No. 44 of 1972)’-এই আইন দিয়ে একাডেমির কার্যপ্রণালী পরিচালিত হতে থাকে। এই আইনটি ছিল বিস্তৃত এবং বিশাল পরিসরে। এই উত্তম আইনের মাধ্যমে একাডেমির নির্বাহী প্রধানের পদমর্যাদা মহাপরিচালক, অনেক বিভাগ তৈরি, বিভাগসমূহের দায়িত্ব একাধিক পরিচালকের হাতে অর্পণসহ বিরাট পরিসরে কাজ করার ক্ষেত্র তৈরি হয়।

কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের পুনর্গঠনের সাড়ে তিন বছরের মাথায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে (১৯২০-১৯৭৫) হত্যার মধ্য দিয়ে জাতির অগ্রগতির চাকা উল্টো যাত্রা শুরু হয়। এর প্রভাব বাংলা একাডেমির উপরও পড়েছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের পর বাংলা একাডেমিও গুরুত্বপূর্ণ একটি রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে উঠেছিল। মুক্তিযুদ্ধোত্তরকালে একাডেমির জন্য প্রণীত উৎকৃষ্ট গণতান্ত্রিক আইন বাংলা একাডেমি আদেশ, ১৯৭২ রদ করে যেদিন বাংলা একাডেমি অধ্যাদেশ, ১৯৭৮ জারি করা হলো সেদিনই প্রকারান্তরে বাংলা একাডেমির বিশ্ববিদ্যালয়ের সমতুল্য কাজের গতিশীলতা থেকে সীমিত করা হয়। এই আইনে অনেক বিষয় অস্পষ্ট ছিল। ১৯৭৮ সালের এই আইনে সদস্যভুক্তি কোনো সুষ্ঠু বিধি ছিল না।

বাংলা একাডেমির কার্যনির্বাহী পরিষদের একটি বড় অংশ সদস্যদের মধ্য থেকে নির্বাচনের বিধান ছিল, তাও পরে স্থগিত করা হয় ইত্যাদি নানা সমস্যা ছিল। এই আইনে সদস্যের প্রতিনিধিত্ব সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা হয়নি এবং কার্যনির্বাহী পরিষদের ভূমিকা কম ছিল। ১৯৮৩ সালের ২৫শে মে তারিখের ৬৫০১/৩/বি- একাডেমি/এমএল-২ স্মারকমূলে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের নির্দেশক্রমে একাডমির বিভাগসমূহ বিলুপ্ত করে চারটিতে গঠন করা হয়েছিল। অতঃপর ২৬.১২.১৯৮৩ তারিখে বাংলা একাডেমিতে এনাম কমিটি রিপোর্ট কার্যকর হওয়ার ফলে-এর সাংগঠনিক কাঠামো পুনর্বিন্যাস্ত হলে একাডেমির জনশক্তি ও কার্যপ্রণালী আরও সীমিত পরিসরে নেমে এসেছিল এবং একাডেমির কাজের গতিশীলতাকে বাধাগ্রস্ত করার অপচেষ্টা করা হয়। এই অবস্থার মধ্য দিয়েও একাডেমি বাংলা ভাষা ও বাঙালির অস্তিত্বকে ধারণ করে নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও আরও বিপুল গতি সঞ্চারপূর্বক মাথা উঁচু করে যথাসাধ্য কাজ করেছে।

বাংলা একাডেমি অধ্যাদেশ, ১৯৭৮-এ আইনের আলোকে একাডেমির কার্যপ্রণালী কয়েক ধরে দশক চলেছিল। দীর্ঘ এ কয়েকদশকে অনেক ভালো কাজ হলেও একাডেমির কাঠামো এবং কাজের ধারায় ও একাডেমির চলার পথে নানা সীমাবদ্ধতা ছিল। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে একাধিকবার এই আইন সংশোধনপূর্বক নতুন একটি আইন প্রণয়নের দাবি উঠেছে এবং উক্ত বাংলা একাডেমি আইন সংশোধন করার উদ্যোগ বিভিন্ন সময়ে নেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে এ আইনের সংশোধনসহ খসড়া প্রস্তুত করে প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে। এভাবে একাডমির জন্য ১৯৭৮ সালের অধ্যাদেশটির পরিবর্তে একটি পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণীত হবার কথা বহুকাল থেকে চেষ্টা চলেছিল। কিন্তু আইন প্রণয়ন বিষয়টি জটিল দীর্ঘ সময় সাপেক্ষ এবং ধারাবাহিক প্রক্রিয়া।

বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে আইন প্রণয়ন পদ্ধতি ব্রিটিশ পার্লামেন্টের আইন প্রণয়ন পদ্ধতির মতোই এক্ষেত্রে প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়/বিভাগ, প্রযোজ্য ক্ষেত্রে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, ক্যাবিনেট ডিভিশন, লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগসহ নানা পর্যায় ও প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরামর্শ এবং সুপারিশ গ্রহণ করতে হয়। অতঃপর বিল উত্থাপন, কয়েকটি পাঠ অতিক্রম করে রাষ্ট্রপতির সম্মতি এবং বিলটি আইনে পরিণত হয়। সুতরাং একাডেমির আইনের ক্ষেত্রে বা যে কোনো প্রতিষ্ঠানের আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে শুধু ঐ প্রতিষ্ঠানই যুক্ত থাকেন এমনটি নয়, বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারী জড়িত থাকেন। বাংলা একাডেমির সংশোধিত আকারে নতুন আইন এবং প্রবিধানমালা প্রণয়নের বেলাও একথাটি প্রযোজ্য।

বাংলা একাডেমির জন্য একটি নতুন আইন এবং একাডেমির জন্য কর্মচারী চাকরি প্রবিধানমালা এই দুটি আইন প্রণয়নের জন্য দীর্ঘ ৩৫ বছরের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মহাপরিচালকগণ কার্যকর উদ্যোগ নিয়েছেন- কোনো কোনো মহাপরিচালকের সময় এ কাজ দুটি ছিল কখনও বেগবান, কখনও শ্লথ। তাঁরা কেউই একাজটি সম্পন্ন করতে বা প্রক্রিয়াটি শেষ করতে পারেননি। যদিও তাঁরা এ কাজটি সম্পন্ন বা শেষ করতে বিভিন্ন সময়ে কমিটি গঠন করেছিলেন, একাধিক বৈঠক করেছেন এবং নতুন আইন ও প্রবিধানমালার খসড়া মন্ত্রণালয়ের প্রেরণ করেছেন কিন্তু সদিচ্ছা সত্ত্বেও প্রক্রিয়াটি চূড়ান্ত রূপ লাভ করেনি।

পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দীর্ঘ ৩৫ বছর পর শেষ পর্যন্ত ২২.০৯.২০১৩ তারিখে বাংলা একাডেমির জন্য প্রবর্তিত বাংলা একাডেমি আইন, ২০১৩ (২০১৩ সালের ৩৩নং আইন) এবং এ আইনের ৪১ ধারায় প্রবিধানমালা প্রণয়নের ক্ষমতাবলে ০৩.০৩.২০২১ তারিখে বাংলা একাডেমির চাকরি প্রবিধানমালা, ২০২১ প্রজ্ঞাপন আকারে জারি করা হয়েছে। একাডেমির বর্তমান এ দুটি আইনের নেপথ্যে অনেকের সহযোগিতা রয়েছে। তবে বাংলা একাডেমির বিশাল এ দুটি আইনের কাজের নেপথ্যে দুজন মহাপরিচালকের নাম অন্যতম। এঁদের একজন অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান (১৯৩৭-২০২১) এবং অন্যজন হলেন কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী (১৯৪৮-২০২১)।

উল্লেখ্য, একাডেমির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক হিসেবে প্রত্যেক মহাপরিচালকই একাডেমিকে নিয়ে গেছেন এক অনন্য উচ্চতায়, তাঁরা প্রত্যেকেই একাডেমির জন্য গর্ব, আমাদের অহঙ্কার। তাঁরা অনেকেই একাডেমির জন্য ভালো কাজ করেছেন। তবে অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান ও কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী একাডেমির এ দুটি আইনের কাজে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। তাঁরা দুজনই এ কাজটি সম্পন্ন করতে কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন। একাজ দুটির প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার ধারাবাহিক বিবরণ দেওয়া কষ্টসাধ্য। তবে এ কাজ দুটি পূর্বাপর সহযোগিতার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁদের দুজনের পরিকল্পনায় এগিয়েছে।

২০০৯ সালের ২৪শে মে অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান একাডেমির মহাপরিচালক হয়ে এলে তিনি একাডেমির জন্য নতুন আইন প্রণয়নের বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্বের সাথে নিয়েছিলেন। উল্লেখ্য, শামসুজ্জামান খান ছিলেন একাডেমিরই একজন সাবেক কর্মকর্তা। তিনি ১৯৭৩-১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বাংলা একাডেমির একজন কর্মকর্তা ছিলেন বলে একাডেমির আইনের বিষয়টি সম্পর্কে তাঁর পূর্বাপর অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েছিলেন। একাডেমির মহাপরিচালক হওয়ার পূর্বে তিনি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক হিসেবে কাজ করেছিলেন। তিনি একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে যোগদান করার পর থেকেই একাডেমির নতুন আইন নিয়ে চিন্তা ভাবনা, মতামত বিনিময় করেন। একাজে তিনি একাডেমির তৎকালীন সচিব মোঃ আলতাফ হোসেন-সহ একাডেমির সর্বস্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সহযোগিতা পেয়েছিলেন। বাংলা একাডেমির প্রশাসনিক মন্ত্রণালয় সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন মন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ এম. পি. এবং মন্ত্রণালয়ের সর্বস্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণ এ আইনের খসড়া প্রণয়নে সহায়ক ভূমিকা রেখেছেন। শামসুজ্জামান খান বাংলা একাডেমির বর্তমান এ আইনটির খসড়া একাডেমিতে থেকে প্রণয়ন করে প্রেরণ করার জন্য বিশিষ্ট আইনজ্ঞ, সাবেক বিচারপতিদের সঙ্গে কথা বলেছেন, সহযোগিতা গ্রহণ করেছিলেন। এঁদের মধ্যে বিচারপতি কাজী এবাদুল হক, অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম প্রমুখ অন্যতম।

বাংলা একাডেমির জন্য প্রবর্তিত বর্তমান আইনটি তাঁর আমলে প্রণীত খসড়া আইনটি একাডেমিতে তাঁর সময়কালেই পরিমার্জিত হয়ে জাতীয় সংসদে পাশ হয়। বর্তমানে প্রচলিত বাংলা একাডেমি আইন, ২০১৩-এ আইনটি সর্বতোভাবে নিখুঁত একটি আইন। এ আইনে একাডেমিতে ৮টি বিভাগ তৈরি হয়েছে এবং প্রয়োজনে সরকারের অনুমোদনক্রমে একাডেমির নির্বাহী পরিষদ আরও অতিরিক্ত বিভাগ গঠন করা যাবে। একাডেমিতে এই আইন প্রবর্তনের মাধ্যমে বাংলা একাডেমি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমতুল্য একটি প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা পেয়েছে। বাংলা একাডেমি আইন, ২০১৩- বাংলা একাডেমির জন্য একটি ল্যান্ড মার্ক আইন। আইন জারি হলেও আইনের ক্ষমতাবলে প্রবিধানমালা প্রণয়নে এক নতুন বাস্তবতা মুখোমুখি হতে হয়।

আলোচনার এ পর্যায়ে বাংলা একাডেমির চাকরি প্রবিধানমালা বিষয়ে দুটি কথা বলা আবশ্যক। প্রবিধানমালা ব্যতীত আইন বাস্তবায়নে নানা সমস্যা সৃষ্টি হয়। ১৯৭৮ সালের বাংলা একাডেমির আইনের একটি ধারায় প্রবিধানমালা সরকারের অনুমতিতে প্রণয়নের ক্ষমতা একাডেমিকে প্রদান করা হয়েছিল কিন্তু একাডেমির চাকরি প্রবিধানমালা উক্ত আইনের বলে প্রণয়ন করা হলেও তা প্রজ্ঞাপন আকারে জারি করা হয়নি। অথচ প্রবিধানমালা তৈরি হলে একাডেমির কার্যসাধন বন্ধনমুক্ত হয় না। বাংলা একাডেমির প্রবিধানমালার কাজ অনেক বছর ধরেই চলেছিল। সুদীর্ঘ ৩৫ বছর পর ২০১৩ সালে বাংলা একাডেমি আইন, ২০১৩ প্রবর্তিত হলে একাডেমির জন্য প্রবিধানমালা প্রণয়ন আবশ্যক হয়ে পড়ে। ২০১৩ সালের বাংলা একাডেমির এই আইনের ৪১ ধারায় একাডেমিকে সরকারের পূর্বানুমোদনক্রমে প্রবিধানমালা প্রণয়নের ক্ষমতা প্রদান করেছে। একাডেমির আইনের উক্ত ধারার আলোকে অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান তাঁর সময়কালে এ প্রবিধানমালা প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন- কিন্তু তা চূড়ান্ত রূপ লাভ করেনি। ইতোমধ্যে তাঁর মহাপরিচালকের সময়ও শেষ হয়। অতঃপর ২০১৮ সালের ২০শে ডিসেম্বর কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী (১৯৪৮-২০২১) বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর তিনি একাডেমির চাকরি প্রবিধানমালা প্রণয়নের কাজে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেন।

তিনি একাডেমির প্রবিধানমালা প্রণয়নের এ উদ্দেশ্য সফল করার জন্য কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি পেশায় ইঞ্জিনিয়ার হলেও একাডেমির মহাপরিচালক হয়ে এসে এ কাজটি সম্পূর্ণ করার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন। বাংলা একাডেমি আইন, ২০১৩-এর ৪১ ধারার বিধান অনুযায়ী যাতে স্বল্প সময়ের মধ্যে একাডেমির কর্মচারী চাকরি প্রবিধানমালা প্রণয়ন হয়- এ জন্য তিনি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের নিয়ে একাধিক সভা করেন। এ কাজে তিনি একাডেমির কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সহযোগিতা, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পরামর্শ এবং সহযোগিতা লাভ করেছিলেন। পূর্বাপর অনেক চেষ্টার পর ১৮ই ফাল্গুন ১৪২৭ বঙ্গাব্দ মোতাবেক ৩রা মার্চ ২০২১ তারিখে এস আরও নং ৫৫-আইন/২০২১-মূলে বাংলা একাডেমি আইন, ২০১৩-এর ৪১ ধারার প্রদত্ত ক্ষমতাবলে একাডেমির, আদেশক্রমে মহাপরিচালক বাংলা একাডেমি সরকারের পূর্বানুমোদনক্রমে বাংলা একাডেমির কর্মচারী চাকরি প্রবিধানমালা, ২০২১ প্রজ্ঞাপন আকারে জারি করা হয়। অতঃপর এই আইন বাংলাদেশ গেজেট, অতিরিক্ত সংখ্যায় প্রকাশিত এক ঘোষণার মাধ্যমে ৪ঠা মার্চ ২০২১ তারিখ থেকে কার্যকর হয়। বাংলা একাডেমির জন্য প্রবর্তিত বর্তমান প্রবিধানমালাটি তাঁর সময়কালে প্রণীত হলেও পূর্বে প্রণীত খসড়া প্রবিধানমালা পরিমার্জিত হয়ে প্রজ্ঞাপন আকারে জারি হয়। লক্ষণীয় যে একাডেমির জন্য জারিকৃত এ প্রবিধানমলায় বাংলা একাডেমি আইন, ২০১৩-তে বর্ণিত বিভাগ-উপবিভাগের কোনো স্বীকৃতি নেই। ফলে বাংলা একাডেমিতে নিয়োগ, পদোন্নতি, অনুবাদ গবেষণাকর্ম প্রভৃতি নিয়ে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এ বিষয়ে আইনগতভাবেও বাধা আছে। সঙ্গতকারণে বাংলা একাডেমির ২০১৩ সালের আইন অনুযায়ী উক্ত প্রবিধানমালাটি দ্রুত সময়ের মধ্যে সংশোধনের প্রয়োজন। এ প্রবিধানমালা উক্ত আইন অনুযায়ী সংশোধিত হলে গবেষণার ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমি আন্তর্জাতিক মাত্রা লাভ করবে।

অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান ও কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী এ দুজন মহাপরিচালকের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এবং আগ্রহে বাংলা একাডেমির বিরাট এ দুটি আইনের ম্যাগনাম ওপাস কাজ সম্পন্ন হয়। বাংলা একাডেমি আইন, ২০১৩ এবং বাংলা একাডেমির কর্মচারী চাকরি প্রবিধানমালা, ২০২১- এ দুটি আইন বাংলা একাডেমির সুদৃঢ় ভিত্তি। বর্তমানে বাংলা একাডেমি উক্ত দুটি আইন ও সরকারের প্রচলিত আইন অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে। এ দুটি আইন প্রণয়ন ও প্রবর্তিত হওয়ার মাধ্যমে একাডেমির মর্যাদা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমতুল্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং বাংলা একাডেমি এখন এদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে মর্যাদার। বর্তমানে বিদ্যমান বাংলা একাডেমির জন্য এ আইন দুটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ধারা, সাংবিধানিক আইন ও আইনের শাসন এবং মৌলিক মানবাধিকারকে সমুন্নত করেছে। এই দুটি আইন প্রবর্তিত হওয়ার মধ্য দিয়ে একাডেমি একুশের চেতনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নিরিখে জাতির জাতীয় প্রত্যাশা পূরণের লক্ষ্যে নিয়ত গৌরবোজ্জল ভূমিকা পালন করা যাবে।

বাংলা একাডেমির ইতিহাসে এ দুটি আইনের নেপথ্যের কর্মের জন্য অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান ও কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তাঁরা বাংলা একাডেমির সকল কর্মকা- একটি অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন।

লেখক: গবেষক