চন্দন কান্তি নাথ: দ্রুত বিচার পাওয়া বাংলাদেশের নাগরিকদের মৌলিক অধিকার। এটা এমনকি বাংলাদেশে বসবাসরত সকল ব্যক্তির মৌলিক অধিকার। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সংবিধানে এটা স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। আর সকল নাগরিকের কর্তব্য যে তারা সংবিধান মান্য করবে। আবার প্রজাতন্ত্রের সকল ব্যক্তির সকল সময়ে জনগণের সেবা করার কথা আছে। তথাপি বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য নাগরিকদের বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয়।
বিচার বিভাগে বর্তমানে প্রায় ৪০ লক্ষ মামলার বোঝা প্রমাণ করে মানুষ বিচারের জন্য বছরের পর বছর ঘুরছে। ফৌজদারি কার্যবিধিতে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে একদিনেই সাক্ষ্যগ্রহণ ও বিচার নিষ্পত্তির কথা আছে। দেশে সেশন আদালতেও একদিনে কিংবা লাগাতার সাক্ষ্যগ্রহণে দ্রুততার সাথে বিচার নিষ্পত্তির কথা আছে। কিন্তু পর্যাপ্ত বিচারকের অভাবে এবং যথাযথ তদারকি না থাকার কারণে বিচারের জন্য মানুষ দ্বারে দ্বারে ঘুরছে। দেওয়ানি বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য বছরের পর বছর মানুষ আদালতের বারান্দায় ঘুরছে। একজন বিচারকের শুনানির পর্যায়ে ১০০ দেওয়ানি মামলা থাকার কথা। বাস্তবে হাজার হাজার মামলা বিদ্যমান। আমাদের বিজ্ঞজনেরা সুযোগ পেলেই ব্রিটিশ আইনের বারোটা বাজিয়ে দেন। কিন্তু এই বিধান ১৯০৮ সনেই সন্নিবেশিত হয়েছে।
ফৌজদারি মামলার তদন্ত ১৮৯৮ সনের আইনেই ২৪ ঘণ্টায় শেষ করার কথা লেখা আছে। এমনকি সবচেয়ে কঠিন মামলাও ১৫ দিনে তদন্ত শেষ করার কথা পিআরবিতে সন্নিবেশিত করা হয়েছে। আইনে সংশ্লিষ্ট কগনিজেন্স ম্যাজিস্ট্রেটের তদারকি করার কথা স্পষ্ট করা আছে। আইন আছে আইনের জায়গায়, আর বাস্তবতা অন্য জায়গায়।
সোনার বাংলার রূপকার বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় আছেন। কখনো শুনি নাই প্রশাসনিক কারণে কিংবা অন্য কোন দপ্তর হতে এ বিষয়ে বাধা দেওয়া হয়েছে। তাহলে সংবিধানে বর্ণিত সকল সময়ে জনগণের সেবা করার নীতি বাস্তবায়ন হচ্ছে কই!
সে যাই হোক দেওয়ানী মামলার ক্ষেত্রেও লাগাতার সাক্ষ্যগ্রহণের মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তি করার কথা আছে। অথচ বাস্তবে হচ্ছে না দেখা যায় এবং দেওয়ানী আইনের দীর্ঘসূত্রিতা জন্মগত প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেয়ার কারণেই বঙ্গবন্ধুকন্যা মানুষের ন্যায়বিচার নিষ্পত্তির জন্য আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০ এর মাধ্যমে জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার নিয়োগ দিয়েছেন। আইন করে বাধ্যতামূলকভাবে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি করার জন্য বিধান করেছে। সংশ্লিষ্ট জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার, আইনজীবী, অবসরপ্রাপ্ত বিচারক, আপোষকারীদের আইনের মাধ্যমে অন্তর্ভুক্ত করে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তিতে কাজে লাগানোর ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু বাস্তবে এই যুগান্তকারী আইন মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। কোন কিছুতেই কোন কিছু হচ্ছে না।
উন্নত বিশ্বে কয়েক মিনিটে একটা বিরোধ নিষ্পত্তি হয়। আর আমাদের দেশের যুগের পর যুগ মানুষ নিষ্পত্তির জন্য অপেক্ষা করে। নব নিযুক্ত বাংলাদেশের বিচার বিভাগ এর কর্ণধার মাননীয় প্রধান বিচারপতি মামলাজট এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। বর্তমানে বিচার বিভাগে একজন সৈনিক হিসেবে বিরতি দিয়ে আবার সে কারণে কয়েকটা লাইন লিখতে বসলাম। কি কারনে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি আলোর মুখ দেখছে না এবং মুখ থুবড়ে পড়ছে তা একটি মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন বটে!
আমাদের দেশের মানুষ আপোষকামী নয় একথা অনেকে বলার চেষ্টা করেন।এমনকি কেউ কেউ বলেন বিজ্ঞ আইনজীবী আগ্রহী নয় বিধায় বিকল্প বিরোধ হচ্ছে না। বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখেছি অধিকাংশ মামলায় পক্ষগণ আপোষ করেন এবং বিরোধ নিস্পত্তি চান ও আইনজীবীগণ সহায়তা করেন। তবে এতে সংশ্লিষ্ট বিচারকের ভূমিকা আছে। তিনি একটি মামলা সহজেই বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি করতে পারেন। আইনজীবীগণকে আদালতের অফিসার মনে করা হয়। বিচার বিভাগের পাখির অপর ডানা বিজ্ঞ আইনজীবীগণ। ত্রিশ লক্ষ মামলার বোঝা শুধুমাত্র বিচারকদের ঘাড়ে নয় বরং এটি আইনজীবীদের ঘাড়েও রয়েছে মনে করা উচিত। এটা স্মরণ করিয়ে দিলে বিজ্ঞ আইনজীবী আদালতে মামলা নিষ্পত্তিতে ভূমিকা রাখতে দেখেছি। তবে বিজ্ঞ আইনজীবীগণের ফি এর একটা বিষয় আছে। কেননা এটা তাদের স্বাধীন পেশা। বিচারকগণের মতো তারা মাসে মাসে বেতন পান না। তাই বর্তমানে আইন করে তাদের ফি এর বিধান রাখা হয়েছে। তার পরেও কেন বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি হবে না!
সংশ্লিষ্ট জেলাগুলোতে আদালতের টেবিলে নিষ্পত্তিকারির একটা তালিকা থাকার কথা। বাস্তবে অনেক জায়গায় তা নেই। থাকলেও তাদের ভূমিকা কি কিংবা বিচারকগণ তাদের নিয়ে কী করবেন তা অনেকেই জানেন না। ট্রেনিং একটা বড় বিষয় হতে পারে। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট গত ২০২১ সনেও বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য নির্দেশনা জারি করেছেন। তারপরও বাস্তবায়ন সেভাবে হচ্ছে না। আবার সব মামলা বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি করতে হবে তাও নয় সেজন্য প্রচলিত পদ্ধতিতে দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য অনেক সংশোধনী আনা হয়েছে। যে মামলা বিকল্প উপায়ে নিষ্পত্তি হবে না সেটি সংশোধনী ধারা প্রয়োগ করে দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করতে হবে। বিজ্ঞ আইনজীবী আইনের বাইরে কাজ করতে পারেন না এবং তারা করেন না। বিজ্ঞ আইনজীবীগণ আইন চর্চা করে তাদের জীবন নির্বাহ করেন। তাই আইন প্রয়োগে কোন আইনজীবী বাধা হতে পারে না। বর্তমান দেওয়ানী আইনে যখন তখন যেনতেন আরজি কিংবা জবাবে সংশোধনী আনার সুযোগ নেই। পর্যাপ্ত খরচ দেয়ার বিধান সন্নিবেশিত করা হয়েছে। শুনানির পর্যায়ে তিনবার করে মোট ছয়বার এর অধিক সময় নেয়ার সুযোগ নেই। এতে ও খরচ দেয়ার করার বিধান রাখা হয়েছে।লাগাতার শুনানির বিধান ইতিমধ্যেই আছে। অন্যসব ক্ষেত্রেও সময় সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। তাই যে সমস্ত মামলা বিকল্প উপায়ে নিষ্পত্তি করা যাবেনা, আইন প্রয়োগ করে দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে এবং তা সম্ভব। তবে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি কেই সাধারণ নিয়ম মনে করতে হবে এবং সেভাবে কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। মামলার জট তাই নির্দেশ করে। প্রচলিত পদ্ধতি হতে হবে ব্যতিক্রম।
তবে বিকল্প বিরোধ যে কারণে অকার্যকর হচ্ছে তাতে মনোযোগ দিতে হবে। বিচারকের সংখ্যা অবশ্যই দ্বিগুণ করতে হবে। আনন্দের বিষয় যে বঙ্গবন্ধু কন্যা বিচার বিভাগ স্বাধীন করার পর ২০০৮ সন হতে ইতিমধ্যে বিচারকের সংখ্যা দ্বিগুণ করা হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ বিচারক সহকারি জজ এবং সিনিয়র সহকারী জজ পর্যায়ের বিচারক। আর চলমান প্রক্রিয়ায় এই শ্রেণীতে প্রতিবছর এই বিচারকের সংখ্যা বাড়ছে। তবে যুগ্ন জেলা জজ,অতিরিক্ত জেলা জজ ও জেলা জজ কোর্টের বিচারকের পদ বাড়াতে হবে।না হয় সহকারি জজ এবং সিনিয়র সহকারী জজ পর্যায়ের ১২০০-১৩০০ জন বিচারকের মধ্যে হতাশা আসবে। একবার নিষ্পত্তি হয়ে গেলে অধিকাংশ মামলাতে আপিল কিংবা রিভিশন হতে পারে।ত্রুটি বিচ্যুতি সারাতে অবশ্যই এ পর্যায়ে বিচারকের পদ বাড়াতে হবে।দরকার হলে যুগ্ন জেলা জজ, অতিরিক্ত জেলা জজ ও জেলা জজ পর্যায়ের বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি আদালত বাড়াতে হবে। বিকল্প বিরোধ নিস্পত্তির জন্যে প্রয়োজনে বিভিন্ন রকম আর্থিক ও মানসিক প্রণোদনা দিতে হবে। এটি মূলত বিচারককে দিতে হবে। দরকার হলে যিনি বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি করবেন তাকে দিতে হবে।
বাংলাদেশ ইতিমধ্যে উন্নত বিশ্বে পরিণত হতে যাচ্ছে। অথচ বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে এটা হয় না। আইনের শাসন ও মানবাধিকার এর অন্যতম হাতিয়ার নিরপেক্ষ ও স্বাধীন এবং দ্রুত ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা। এটা না হলে বিনিয়োগ পরিস্থিতি থেকে শুরু করে সকল কিছুই মুখ থুবড়ে পড়বে। বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘ হলে, সে দেশে বিনিয়োগ আসে না। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি দ্রুত নিষ্পত্তির জন্যে দেশের সকল নাগরিকের আগ্রহ আছে। অনেক সময় প্রচলিত পদ্ধতির সুবিধা নিয়ে বিজ্ঞ আইনজীবীগণ মামলায় মেরিট না থাকলে আগাতে চান না। সে কারণে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তিতে পক্ষদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। সেক্ষেত্রে শিঘ্রই আইন করা না গেলেও বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট সার্কুলার দিয়ে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
বাংলাদেশে আইন বাস্তবায়নের জন্য তদারকি প্রয়োজন। যেহেতু ইতিমধ্যেই মাননীয় প্রধান বিচারপতি মামলা জটের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন, সেহেতু তাঁর নেতৃত্বেই আমলাতান্ত্রিক বাধা ও জটিলতা নিরসনে যুগ্ন জেলা জজ, অতিরিক্ত জেলা জজ ও জেলা জজ পর্যায়ের বিচারকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে আশা করা যায়। আরো আশা কিরা যায়, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য নির্ধারিত তারিখে পক্ষদের উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়ার জন্য অতিসত্বর বিধান জারি হবে। বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি বেড়ে গেলে এবং প্রচলিত পদ্ধতিতে ও দ্রুততার নিষ্পত্তি হলে সংবিধানে বর্ণিত মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষা পাবে। আর এটাই সবাই কামনা করে।
লেখক: সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, কুমিল্লা।