পুলিশ কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘন: ক্ষতিপূরণ দিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, যা বললেন আইনজীবী

বরিশালের ভান্ডারিয়া থানা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে পুলিশ কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার গৃহকর্মী খাদিজাকে ৫০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হয়েছে। গত ৫ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক পরিশোধ করা এই ক্ষতিপূরণ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় দেশের ইতিহাসে সর্বপ্রথম। দীর্ঘ ৯ বছরের এই লড়াইয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুল হালিম। কখনো খাদিজাকে সামনাসামনি না দেখা ব্যারিস্টার হালিম শিশু গৃহকর্মীর (নয় বছর আগে) বুকে জমে থাকা কষ্ট অনুভব করতে পেরেছিলেন নিশ্চয়ই। তাইতো খাজিদা ক্ষতিপূরণ পাওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে শেয়ার করেছেন আইনি লড়াইয়ের সেই কন্টকাকীর্ণ গল্প। ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম পাঠকদের জন্য ব্যারিস্টার আবদুল হালিমের ফেসবুক পোস্ট হুবহু তুলে ধরা হল-

এই সেই খাদিজা যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বপ্রথম মানবাধিকার লংঘনের জন্য ৫০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ গ্রহণ করল। ২০১৩ সাল থেকে ২০২২ সাল- ৯ বছরের অনবরত সংগ্রাম শেষে আজ প্রমাণিত যে, মানবাধিকার কমিশনের ক্ষমতা আছে এবং সে চাইলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য সরকার এবং অন্যান্য কর্তৃপক্ষকে দায়বদ্ধতার আওতায় নিয়ে আসতে পারে। খাদিজাকে কোনোদিন সামনাসামনি দেখিনি, কেবল তার বুকে জমানো কষ্ট ধারণ করে ৯ বছর ধরে অনবরত কমিশনে একের পর এক চিঠি দিয়েছি, শুনানি করেছি, একের পর এক তাগিদপত্র দিয়েছি, কমিশনকে একাধিকবার আইনি নোটিশ পাঠিয়েছি; পুনঃগঠিত কমিশনকে নতুন করে স্মরণ করিয়ে তাগিদপত্র দিয়েছি।

২০১৮ সালে কমিশনের গাফিলতি চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেছি; দীর্ঘদিন শুনানি করেছি; কমিশনের আগের চেয়ারম্যানের সম্মানের হানি ঘটে- তাই শুনানি এবং রায় উভয়ই বার বার পিছিয়েছে। অবশেষে ২০১৯ সালে হাইকোর্টের রায় পেলাম। আবার সেই ইঁদুর দৌড়! সেই কমিশনে আবার দীর্ঘ শুনানি করা, ২২ পাতার লিখিত সাবমিশন উপস্থাপন করা; কমিশনের একাধিক সদস্যের ভ্রূকুটি আর ট্যারা চোখের খোঁড়া যুক্তি খণ্ডন করে মানবাধিকারের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের রায় পাওয়া।

রায়ের পরেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় সুপারিশ মানলো না; ঘাড় ত্যাড়া মহিষের মত কেবল ঘোঁৎ ঘোঁৎ করতে লাগল। কমিশনের বেঁধে দেওয়া সময় পেরিয়ে যায়; মন্ত্রণালয়ের ঘুম ভাঙে না। কমিশনও এক সময় ঝিমিয়ে পড়ার মত! আবার দে ধাক্কা! কমিশনকে আবার তাগাদাপত্র দিলাম। কারোর কোনো খবর নেই। প্রায় বছর পেরিয়ে যায়। অবশেষে কমিশনকে আদালত অবমাননার নোটিশ দিলাম। এবার কমিশন নড়ে চড়ে বসল। কমিশন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে আবার শুনানিতে তলব করে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় এবারও নিশ্চুপ থাকে। অবশেষে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের আইনজীবীর কাছে পরামর্শ চায়, ‘কমিশনের সুপারিশ না মানলে কমিশন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে কি করতে পারে? সে খবর আমার কানেও চলে আসে। অবশেষে ডিসেম্বরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় (৯ ডিসেম্বর ২০২১) খাদিজা বরাবর ৫০ হাজার টাকার চেক ইস্যু করে।

২০১৩ সালের এগারো বছর বয়সী সেই শিশুটি যাকে না খেতে দেওয়ায় অপুষ্টির শিকার হয়েছিল, যার জিহ্বা কেটে দেয়া হয়েছিল, পিঠে গরম আয়রনের (ইস্ত্রি) সেঁক দেয়া হয়েছিল, কঙ্কালসার সেই শিশুটি এখন একজন মা। সে মানবাধিকার বুঝুক বা নাই বুঝুক – অন্তত এটুকু জেনেছে যে, তার নির্যাতনকারীদের বিচার না করার জন্য রাষ্ট্র তাকে ৫০ হাজার টাকার ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। মৃত গাছের কোটর থেকে কাঠঠোকরার ছানা যেমন উঁকি দেয়, বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দে সে একটুও ভয় পায় না; ঠিক তেমনি নিপীড়িত কিন্তু দুঃসাহসী খাদিজার হাত ধরে মানবাধিকার বাস্তবায়নের যে আলোটুকু আমরা দেখলাম তা অগ্ন্যুৎপাতের লাভার মত না হোক, অন্তত যেন কাঠঠোকরার সেই ছোট্ট ছানাটির দু’চোখে নির্ভীক বিশ্ব দেখার আশ্বাস যোগায়।

অনেক দেরিতে হলেও মানবাধিকার কমিশনের সামনে পথ এখন অনেক খোলা। প্রতিদিন দেশে যে সব মারাত্মক মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ঘটছে, তার কিছু কিছু ক্ষেত্রে কমিশন এ ধরণের সুপারিশ করলে এক সময় মানবাধিকার ঠিকই তার পথ খুঁজে পাবে।

প্রসঙ্গত, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার খাত ছিল না। তারা আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অর্থ মন্ত্রণালয়ে সুনির্দিষ্ট খাত সৃষ্টির তাগাদা দেন। এরপরই ক্ষতিপূরণ দিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ।