মহামারি করোনা ভাইরাসের নতুন ধরণ ওমিক্রনের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় প্রভাব পড়েছে বিচার বিভাগে। অধস্তন ও উচ্চ আদালতের বেশ কয়েকজন বিচারক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। ইতোমধ্যে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে ১১ দফা বিধিনিষেধ জারি করেছে সরকার।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আগামীকাল রোববার (১৬ জানুয়ারি) থেকে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের চেম্বার জজ আদালত ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে পরিচালিত হবে। সপ্তাহে চার দিন শুধু তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার করে চেম্বার আদালতের বিচারিক কার্যক্রম পরিচালিত হবে। গত বুধবার এ বিষয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন।
করোনা সংক্রমণ আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেলে বিচারিক কার্যক্রম ফের পুরোপুরি ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে পরিচালিত হতে পারে। তবে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা ভার্চুয়াল এবং ফিজিক্যাল কোর্টের বিষয়ে দ্বিধাবিভক্ত মতামত দিয়েছেন।
হাইকোর্টে ভার্চুয়াল নয়, শারীরিক উপস্থিতিতেই বিচারকাজ পরিচালনার পক্ষের আইনজীবীরা মনে করেন, করোনার কারণে অন্যান্য পেশার মতো আইনজীবী এবং বিচার বিভাগ উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই পরিস্থিতি বিবেচনা করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শেষ দিন পর্যন্ত শারীরিক উপস্থিতিতে বিদ্যমান আদালতের পক্ষে তাঁরা।
অন্য দিকে বিচারপতিদের অনেকেই করোনা আক্রান্ত হওয়ায় এবং সিনিয়র আইনজীবীদের কথা বিবেচনা করে কেউ কেউ ভার্চুয়াল আদালতের পক্ষেও মত দিয়েছেন। তারা মনে করেন, পরিস্থিতি অনুকূলে থাকতেই ভার্চুয়াল আদালতে ফিরে যাওয়া উত্তম।
ফিজিক্যাল কোর্টের পক্ষে আইনজীবীদের বক্তব্য
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটির সাবেক সদস্য অ্যাডভোকেট কুমার দেবুল দে ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমকে বলেন, আমি মনে করি আরও দেড় থেকে দুই মাস পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা উচিত। মাত্রই তো শারীরিক উপস্থিতিতে আইনজীবীরা নতুন করে অভ্যস্ত হতে শুরু করলেন। এরপর অবস্থা বুঝে প্রয়োজন হলে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনিরুজ্জামান লিংকন ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমকে বলেন, দীর্ঘদিন আদালত বন্ধ ছিল, অল্প কিছুদিন হল শারীরিক উপস্থিতিতে বিচারিক কার্যক্রম চলছে। এ মূহুর্তে আবারো ভার্চুয়ালে পদ্ধিতে ফিরে গেলে আইনজীবীরা বিশেষত জুনিয়র আইনজীবীরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কারণ এর সাথে আইনজীবীদের জীবন-জীবিকার বিষয়টি জড়িত রয়েছে।
তিনি আরো বলেন, আইনজীবীরা সচেতন সমাজ। এছাড়া প্রায় সকলেরই টিকা নেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে সকলের জন্য বুস্টার ডোজের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কিন্তু আদালত ভার্চুয়াল অবস্থায় ফিরে গেলে জটিলতা তৈরি হবে। এছাড়া ভার্চুয়াল কোর্টেরও নানা মুখী সমস্যা রয়েছে যা এখনো সমাধান করা যায়নি।
আইনজীবী লিংকন বলেন, আমি বলব স্বাস্থ্য বিধি কঠোরভাবে পালন করে এখন শারীরিক উপস্থিতিতেই বিচারকাজ পরিচালনা করা দরকার। পরে অবস্থা বুঝে কিংবা পরিস্থিতি চরম পর্যায়ে যাওয়ার উপক্রম হলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ তো রয়েছে।
ভার্চুয়াল কোর্টের পক্ষে আইনজীবীদের বক্তব্য
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট তানজিম আল ইসলাম ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমকে বলেন, করোনা পরিস্থিতি আবারও যেদিকে যাচ্ছে আমার মনে হয় এখনই আবার ভার্চুয়াল কোর্ট চালু দরকার। ১ লা ডিসেম্বর থেকে যখন একচুয়াল কোর্ট শুরু হল এর পর কিন্তু অনেক বিচারপতি করোনা আক্রান্ত হলেন। বিচারকবৃন্দ আক্রান্ত হয়ে ছুটিতে গেলে কিন্তু মামলা নিষ্পত্তিতে ব্যাঘাত ঘটে। এতে করে সাধারণ বিচারপ্রার্থীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আইনজীবীরা অসুবিধায় পড়েন।
অ্যাডভোকেট তানজিম বলেন, তাই এই মহামারিতে বিচার বিভাগ কার্যকর অর্থে সচল রাখতে হলে এই ভার্চুয়াল কোর্টের বিকল্প দেখিনা। তবে কিছু বিষয় নজরে রাখা দরকার। শুধু শুনানি ভার্চুয়াল করলে হবেনা। আদালতে লোকসমাগম কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে।বিশেষ করে এফিডেভিট এর ক্ষেত্রে শিথিলতা আনতে হবে। বারের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ এখানে। জনসমাগম কমাতে কার্যকর উদ্যোগ নেয়া দরকার।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট রাশিদা সুলতানা নিলু ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমকে বলেন, গণমাধ্যমে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী উচ্চ আদালতের ১৭-১৮ জন বিচারপতি ইতোমধ্যে করোনা আক্রান্ত হয়েছে। এছাড়া বিগত সময়ে করোনা আক্রান্ত হয়ে উচ্চ আদালতের বিচারকসহ বেশ কিছু সিনিয়র আইনজীবী মৃত্যুবরণ করেছেন। এজন্য সময় খারাপ হওয়ার আগে ভার্চুয়াল করতেই ফিরে যাওয়া উচিত বলে মনে করি।
গত এক বছরে আইনজীবীরাও তথ্য-প্রযুক্তির মাধ্যমে আদালতের কার্যক্রমে অনেকটা অভ্যস্ত হয়েছেন মন্তব্য করে আইনজীবী রাশিদা চৌধুরী আরও বলেন, এখন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ওকালতনামাও ডিজিটাল করেছে। তাছাড়া এক বছরের মতো সময় তো ভার্চুয়াল কোর্ট চলল। ফলে আগের চেয়ে আইনজীবীরা এখন এ পদ্ধতির সাথে বেশ পরিচিত এবং অভ্যস্ত আমি বলব। এজন্য মহাসংকটের পূর্বেই ভার্চুয়ালে ফিরে যাওয়া উত্তম বলে মনে করি।
উচ্চ আদালতে করোনার হানা
বিচার বিভাগে হানা দিয়েছে মহামারি করোনা ভাইরাস। ইতোমধ্যে উচ্চ আদালতের ১৭ জন বিচারক করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের একাধিক বিশ্বস্ত সূত্র ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমকে এ তথ্য জানা গেছে। অবশ্য তারা করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত বিচারপতিদের নাম প্রকাশে অপারগতা জানান।
সম্প্রতি আপীল বিভাগের বিচারক হিসেবে নিয়োগ পাওয়া বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান শপথ অনুষ্ঠানে আসতে পারেননি। করোনা আক্রান্ত হয়ে এই বিচারপতি বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। এছাড়া করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলাম। যুক্তরাষ্ট্রে বড় ছেলের কাছে অবকাশযাপনে গিয়ে করোনা আক্রান্ত হন তিনি। করোনা আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছেন হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম।
অধস্তন আদালতেও করোনার থাবা
চট্টগ্রাম আদালতের জেলা ও দায়রা জজ মো. ইসমাইল হোসেনসহ তিন বিচারক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্ত অন্য দু’জন হলেন- দ্বিতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. সরোয়ার আলম এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২-এর বিচারক মাইন উদ্দিন।
প্রথম যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ খাইরুল আমীনের সই করা সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে মঙ্গলবার (১১ জানুয়ারি) এ তথ্য জানানো হয়।
এতে বলা হয়, জেলা জজ মো. ইসমাইল হোসেন সপরিবারে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এছাড়া নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২-এর বিচারক মাইন উদ্দিন এবং দ্বিতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. সরোয়ার আলম করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। তারা সবাই চিকিৎসা নিচ্ছেন।
এছাড়া সুনামগঞ্জের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. জাকির হোসেনও করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। বর্তমানে তিনি চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
বিষয়টি ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমকে নিশ্চিত করেছেন জেলা আইনজীবী সমিতির পাঠাগার সম্পাদক মো. গিয়াস উদ্দিন।
চেম্বার আদালত চলবে ভার্চুয়ালি
এদিকে করোনার ভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন সংক্রমণ বৃদ্ধিজনিত উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের চেম্বার জজ আদালতের বিচারিক কার্যক্রম ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে পরিচালিত হবে। আগামী রোববার (১৬ জানুয়ারি) থেকে এটি কার্যকর হবে।
আগামী ১৬ জানুয়ারি থেকে সপ্তাহে চারদিন (রবি, সোম, মঙ্গল ও বুধবার) দুপুর আড়াইটা থেকে চেম্বার জজ আদালতের বিচারিক কাজ পরিচালিত হবে। শুধু তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভার্চুয়াল উপস্থিতির মাধ্যমে বিচারপতি ওবায়দুল হাসান আপীল বিভাগের মামলা সংক্রান্ত জরুরি বিষয়াদির শুনানি গ্রহণ করবেন।
প্রসঙ্গত, করোনা মহামারির নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন প্রতিরোধে ১১ দফা বিধিনিষেধ আরোপ করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। যা আগামীকাল বৃহস্পতিবার (১৩ জানুয়ারি) থেকে কার্যকর হবে। গত সোমবার (১০ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, মহামারি করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের সময় ভার্চ্যুয়ালি এবং ক্ষেত্র বিশেষে শারীরিক উপস্থিতিতে আদালতের কার্যক্রম চলে আসছিল। এর মধ্যে গত ২৯ নভেম্বর একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়।
ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, প্রধান বিচারপতি জ্যেষ্ঠ বিচারপতিদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, আগামী ১ ডিসেম্বর থেকে স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে অনুসরণ করে শারীরিক উপস্থিতিতে সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারিক কার্যক্রম পরিচালিত হবে।
এরপর গত বছরের ১ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগে শারীরিক উপস্থিতিতে বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়।