শিশির মনির: মৃত্যুদণ্ড চূড়ান্ত সাজা হিসেবে থাকা উচিত কি না এই মর্মে পৃথিবী জুড়ে বিতর্ক রয়েছে। অনেক রাষ্ট্রই মৃত্যুদণ্ডের সাজা ইতোমধ্যে বিলুপ্ত করেছে। আবার অনেকেই বহাল রেখেছে। মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে কিছু কিছু অপরাধের সাজা চূড়ান্ত প্রমাণ সাপেক্ষে মৃত্যুদণ্ড প্রস্তাব করা হয়েছে। ব্রুনাই, পাকিস্তান ও নাইজেরিয়ার দণ্ডবিধিতে বিস্তারিত বিধান রয়েছে। বিগত কয়েকদিনে দেশে অর্ধ শতাধিক লোককে বিচারিক আদালত মৃত্যুদণ্ডের সাজা দিয়েছে। একটি মামলায় ২/৪/৬/১৬/১৩/১৮/২০ জনকে পর্যন্ত মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী প্রায় ৮০০ মৃত্যুদণ্ডের মামলা আমাদের হাইকোর্টে শুনানির জন্য অপেক্ষমাণ। বর্তমানে তিনটি দ্বৈত বেঞ্চে মৃত্যুদণ্ডের মামলা শুনানি চলছে। তবুও অধস্তন আদালতের সাথে পাল্লা দিয়ে চলা যাচ্ছে না। প্রতি বছর মামলার পাহাড় জমেই চলছে। ২০১৪ সাল থেকে ২০১৯ সালে উদ্বৃত্ত হওয়া মৃত্যুদণ্ডের মামলা যথাক্রমে ৩৬৩-৪১৯-৪৩৫-৬৪০-৭১১-৭৫০টি। অধস্তন আদালতের বন্ধুদের অভিজ্ঞতা শুনে খুবই অবাক হই। কোন কোন জজের আদালতে মামলা গেলে তারা চিন্তিত হয়ে পরেন কারণ ‘মৃত্যুদণ্ড’ অনিবার্য। হাইকোর্টেও এই ধরণের মুখরোচক কৌতুক চালু আছে। সর্বোচ্চ এই সাজা অনেক সময় কপালের ব্যাপার। কারা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরের ২০ তারিখ পর্যন্ত মৃত্যুর সেলে বন্দী মোট আসামী সংখ্যা ১৯৮৭ জন। তন্মধ্যে পুরুষ ১৯৩৩ জন ও মহিলা ৫৪ জন।
সারাদেশে প্রায় ৩৯ লক্ষ মামলা বিচারাধীন। আইনজীবী-মক্কেল-বিচারক সবাই মিলে চেষ্টা করেও এই সমস্যার তড়িৎ কোন সমাধান আপাতত করা সম্ভব নয়। মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রাপ্ত একজন বন্দীকে প্রায় ১৪-১৮ বছর মৃত্যুর সেলে থাকতে হচ্ছে। আইনের সকল প্রক্রিয়া শেষ করতে এই সময় লেগে যায়। ফলে বন্দীদের মাঝে নানান ধরণের শারীরিক ও মানসিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে। অধস্তন আদালত প্রদত্ত মৃত্যুদণ্ডের আদেশের প্রায় ৭০ শতাংশ হাইকোর্টে বাতিল হয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ খালাস পাচ্ছেন আবার কারও কারও সাজা কমে যাচ্ছে। আপিল বিভাগে শুনানির পর আরও খালাস পাচ্ছেন। বেশির ভাগেরই সাজা কমে যাচ্ছে।
মানুষের বিচার কখনই পরিপূর্ণ নয়। সাক্ষ্য-প্রমাণের বাইরে আমরা যেতে পারি না। মানুষের বিচারের এটাই সীমাবদ্ধতা। এই বিচারের জন্য প্রয়োজন যথাযথ তদন্ত (Investigation)। তদন্তের মাধ্যমেই সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করতে হয়। মৌখিক সাক্ষ্য-দালিলিক সাক্ষ্য-পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যের ভিত্তিতেই সাজা প্রদান করা হয়। জজ সাহেবের নিজের কোন চোখ নাই। তিনি সাক্ষ্য প্রমাণের উপর নির্ভরশীল। আমরা সবাই জানি তদন্ত ও বিচারের ক্ষেত্রে নানান ধরণের অভিযোগ উঠে। যেমন: নির্যাতন করে স্বীকারোক্তি আদায়, একজনের নামে আরেকজন বছরের পর বছর জেলে, সাক্ষীদের ভয়-ভীতি দেখানো, তদন্তের দুর্বলতা, তদন্তের ক্ষেত্রে পক্ষপাতী (bias) হওয়া, উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রভাবিত হওয়া, বিচারকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, সুনির্দিষ্ট সাজা নীতি (Sentencing Policy) না থাকা, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সাক্ষ্য সংগ্রহ করতে না পারা ইত্যাদি।
শরীয়া একটি বিস্তৃত ব্যাপার। মানুষের ব্যক্তিগত-পারিবারিক-সামাজিক সকল বিষয় শরীয়ার অন্তর্ভুক্ত। তন্মধ্যে শাস্তির সুনির্দিষ্ট মেয়াদ ঠিক করে বেশ কিছু আয়াত আল-কুরআনে আছে। সেখানে ভুক্তভোগী (victim) পরিবার চাইলে ক্ষমাও করে দিতে পারে। আবার আর্থিক পণ গ্রহণ করতে পারে। ব্রুনাই, পাকিস্তান ও নাইজেরিয়ার দণ্ডবিধিতে এই মর্মে বিস্তারিত বিধান আছে। সেখানেও অনেক ব্যতিক্রম তুলে ধরা হয়েছে। শরীয়া আদালতসমূহ বিচার করার ক্ষেত্রে অনেক ব্যতিক্রম ব্যাখ্যা দিয়েছে। কারণ মানব জীবনের ঘটনা প্রবাহ পূর্ব নির্ধারিত নিয়ম মেনে হয় না। প্রত্যেকটি ঘটনায় থাকে ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য (exceptional features)। একটি ঘটনা থেকে আরেকটি ঘটনা আলাদা। ফলে বিচারের ক্ষেত্রে শরীয়া আদালত সেগুলো বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকে। এগুলোও আপিলে অনেক পরিবর্তন হয়। শরীয়া আদালত হলেও বিচারক তো মানুষ। ভুল হতে পারে। তাই আছে আপিল আদালত। এটাই মানুষের বিচারের নমুনা। তারপরও আইনের অপপ্রয়োগ (miscarriage of justice) হতে পারে।
গভীর পড়াশুনায় বুঝা যায় দুনিয়ার বহু জায়গায় ভুল লোককে বা ভুলভাবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। দণ্ড কার্যকরের ৫০/৬০/৭০ বছর পর ভুল ধরা পরেছে। তখন আর কিছুই করার নেই। শুধু অনুশোচনাই একমাত্র পথ। এই জন্য মৃত্যুদণ্ডকে বলা হয় অপরিবর্তনীয় শাস্তি (irreversible punishment)।
বিচার খুবই সুক্ষ বিষয়। সাক্ষ্য প্রমাণ মূল্যায়নের বিষয়। চুলচেরা বিশ্লেষণের ব্যাপার। হুজুগে পড়ে বিচার হয় না। অনুরাগ-বিরাগের বশবর্তী হয়ে বিচার করা যায় না। আপাত অর্থে বিচার মনে হলেও এটা ন্যায় বিচার হতে পারে না। একজন ন্যায় বিচারক জনমতের তোয়াক্কা করতে পারেন না। এমনকি নিজের বিরুদ্ধে গেলেও স্বাধীনভাবে বিচার কাজ সম্পন্ন করতে হবে। এটাই ন্যায় বিচারের মূলমন্ত্র। এখানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-শ্রেনি কোন বিবেচ্য বিষয় নয়। উঁচু-নিচু-ধনী-গরীব মোটেও বিবেচনা যোগ্য নয়। এই ধরণের বিচার করতে হলে প্রয়োজন যথাযথ ব্যক্তিত্ব এবং গভীর পড়াশুনা। লোভ-লালসা-প্রভাব-প্রতিপত্তি-জনমত তার কাছে মোটেও বিবেচ্য বিষয় হতে পারে না।
সাজা বাড়িয়ে দিলেই অপরাধ কমে যাবে এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। পৃথিবীর কোনো গবেষণা (Study) এই ধারণা সমর্থন করে না। অপরাধ নানান কারণে হয়ে থাকে। সেই কারণগুলো দূরীভূত করতে না পারলে অপরাধ কোনদিন কমে না। সামাজিক-সাংস্কৃতিক-আর্থিক-এমনকি রাজনৈতিক বহুমাত্রিক কারণ বিভিন্ন মাত্রায় দায়ী। নিজের সন্তানকে দিয়ে উদাহরণ দেয়া যায়। একটি সন্তান নানান পালন করতে বহুমাত্রিক বিবেচনা প্রয়োজন। শুধু শাস্তি দিয়ে সন্তানকে সঠিক পথে রাখা যাবে? সেজন্য প্রয়োজন সঠিক পরিচর্যা। পরিচর্যা অর্থ আদর, অভিভাবকত্ব, শাসন, সঠিক শিক্ষা, সুস্থ সংস্কৃতি, মানসিক খোরাক আরও কত কী?
তাই বলছি সরলীকরণ বন্ধ করতে হবে। সমন্বিতভাবে চিন্তা করতে হবে। অন্যথায় সমস্যা দিন দিন বেড়েই চলবে। শুভ বুদ্ধির উদয় হোক। চিন্তার দরজা উন্মুক্ত হউক। এই প্রত্যাশা।
লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট