সাইফুল ইসলাম পলাশ: “মে ইট প্লিজ ইউর অনার, অত্যন্ত দুঃখের সাথে নিবেদন করছি যে, এই মামলার হাজতি আসামী প্রকৃত আসামী নয়। পুলিশ ভুল করে আসামী ‘সহিদুল’ এর স্থলে নিরপরাধ ‘সাহিদুল’কে গ্রেফতার করেছে। যেকোনো শর্তে জামিনের প্রার্থনা করছি।”
যৌতুকের একটি মামলায় জামিন শুনানীকালে কথাগুলো বলছিলেন রাজশাহী বারের একজন বিজ্ঞ আইনজীবী। আমি তখন সেখানে সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কর্মরত ছিলাম। বিষয়টি যাচাই করার জন্য পরের দিন ফরিয়াদি এবং আসামীর উপস্থিতিতে জামিন শুনানির জন্য রাখা হলো।
পরের দিন কারাগার থেকে আসামীকে আনা হল। ফরিয়াদিও ডাকমতে উপস্থিত। তিনি দেখামাত্রই বললেন, “স্যার, এই আসামী আমার স্বামী নন, তিনি আমার ভাসুর!”
আমি শোনার সাথে সাথে তাৎক্ষণিকভাবে আসামীকে মুক্তি দিলাম। কিন্তু ভিন্ন জেলায় গ্রেফতার হওয়ায় আসামী আসতেই ১০ দিন সময় অতিবাহিত হয়েছে। বিনা অপরাধে একজন নিরীহ মানুষ ১০ দিন হাজতে থাকার কষ্ট দীর্ঘদিন আমাকে কুড়ে কুড়ে খেয়েছে। অথচ ঘটনাস্থলে পুলিশ যদি গ্রেফতারের স্মারকলিপি (Memorandum of Arrest) প্রস্তুত করার কৌশলটা জানত তাহলে এই নিরপরাধ লোকটার ১০ দিন জীবন থেকে চলে যেত না। তবে বিষয়টির জন্য শুধু গ্রেফতারকারী অফিসারের দোষ দেয়া যায় না। কারণ এই বিষয়টির সাথে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো সহ আইনাঙ্গনের অধিকাংশ মানুষ পরিচিত নন।
মেমোরেন্ডাম অব অ্যারেস্ট সংক্ষেপে অ্যারেস্ট মেমো এর অর্থ হচ্ছে গ্রেফতারের স্মারকলিপি। আসামী গ্রেপ্তারকালে গ্রেফতারী অফিসার কর্তৃক প্রস্তুতকৃত কিছু তথ্যের সমাবেশ যা আসামী গ্রেফতার সম্পর্কিত মৌলিক অধিকারসমূহ নিশ্চিত করে। দ্য কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর -এর কোথাও এ সম্পর্কে কিছু বলা নেই। অন্য কোনো আইনে এ সম্পর্কিত নির্দিষ্ট কোনো ফরমেট না থাকলেও বাংলাদেশ ও অন্যান্য বনাম ব্লাস্ট, ৮ এসসিওবি (২০১৬) এডি ১ মামলায় মহামান্য সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগ প্রথম এই বিষয়টির অবতারণা করেন।
উক্ত মামলায় বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের মহামান্য আপীল বিভাগ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর প্রতি যে কয়েকটি নির্দেশনা দিয়েছেন তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে গ্রেফতারকারী অফিসার গ্রেফতার করার সাথে সাথে গ্রেফতারের স্মারকলিপি (Memorandum of Arrest) প্রস্তুত করবেন এবং তাতে গ্রেফতারের তারিখ ও সময় উল্লেখসহ গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির স্বাক্ষর গ্রহন করবেন। গ্রেফতারের পর ১২ ঘণ্টার মধ্যে ধৃত ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ আত্মীয়কে তার বলে দেওয়া কোন বন্ধুকে ওই ব্যক্তিকে গ্রেফতারের তারিখ, সময় ও হেফাজতে রাখার স্থান অবশ্যই অবহিত করবে। বিষয়গুলো সিডিতে লিপিবদ্ধ করার নির্দেশনা রয়েছে। এছাড়া ধৃত ব্যক্তির শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেলে তিনি তার কারণ লিপিবদ্ধ করবেন এবং চিকিৎসার জন্য নিকটস্থ হাসপাতালে পাঠিয়ে চিকিৎসকের প্রত্যয়ন পত্র সংগ্রহ করবেন।
ম্যাজিস্ট্রেসিতে কাজ করার সময় ছুটির দিনগুলোতে প্রায় ‘হলিডে ম্যাজিস্ট্রেট/দায়িত্ব প্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট’ হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। তখন দেখেছি এই সময়গুলোতে অধিক সংখ্যক আসামী গ্রেফতার হত। আমি প্রত্যেক আসামীর সাথে কথা বলতাম। জানার চেষ্টা করতাম গ্রেফতারকৃত আসামীর পরিবার তার গ্রেফতারের বিষয়ে জানে কি না, তাকে কখন ধরা হয়েছে, কেন ধরা হয়েছে, আইনজীবী আছে কি না। কিছু কিছু মামলায় আসামীরা বলত, তার বিরুদ্ধে কি অভিযোগ তা সে জানে না, তার আত্নীয়স্বজনও জানে না। আমি তাৎক্ষণিকভাবে জিআরও -এর মাধ্যমে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাকে/থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে বিষয়টি জানাতাম। তারা পরিবারকে বিষয়টি জানাত।
অভিজ্ঞতায় দেখেছি এই আসামীদের পরিবার না জানার কারণে তারা মামলায় তদবির করতে পারে না, আইনজীবী নিয়োগ করতে পারে না। তাদের মামলার তারিখও লম্বা হয়, সঙ্গত কারণে হাজতবাসও দীর্ঘ হয়। যে অপরাধের কারণে আসামী ধৃত হয়েছে, হয়তো ৭ দিন পরেই তার জামিন হয়ে যেত; কিন্তু সময় মত তদবির গ্রহণ না করার কারণে এক মাসের অধিককাল হাজতে থেকেছে। এতে একদিকে সে আইনজীবীর সাথে পরামর্শ না করার কারণে তার যেমন মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে, অন্যদিকে অপ্রয়োজনীয় হাজতবাসের কারণে কারা ব্যবস্থাপনায় রাষ্ট্রীয় ব্যয়ও বেড়েছে।
আমি অত্যন্ত সৌভাগ্যবান যে আমি রাজশাহীর বর্তমান মাননীয় চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ইকবাল বাহার স্যারের সাথে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। স্যারকে কয়েকটি ঘটনা বলতেই তিনি আমাকে এ বিষয়ে পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেসি মিটিংয়ে কথা বলার সুযোগ দিলেন। নিজেই সভাপতির আসন থেকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর প্রতি ঘটনাস্থলে অ্যারেস্ট মেমো প্রস্তুত করার নির্দেশনা দিলেন। জেলার পুলিশ সহ অন্যান্য সংস্থাগুলো সুপ্রীম কোর্টের এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করার জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ হলেন। কিন্তু নির্দিষ্ট ফরমেট না থাকায় একটি মডেল মেমো অ্যারেস্ট প্রস্তুত করার জন্য আমার উপর দায়িত্ব পড়ল।
বিষয়টি নিয়ে আমি কয়েকটি জেলার পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেটদের সাথে কথা বললাম। দেখলাম, অধিকাংশ জেলায় এটি করা হচ্ছে না। একটি জেলায় করা হলেও সেটা পুরোটা টাইপ করা এবং থানায় বসে প্রস্তুত করা। সেখানে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তি ও সনাক্তকারীর স্বাক্ষর নেই। জানার চেষ্টা করলাম বিশ্বের অন্যান্য দেশে এ বিষয়ে কি রকম ব্যবস্থা আছে।
জানতে পারলাম, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে সুপ্রীম কোর্টের D.K Basu vs. State of West Bengal, AIR 1997 SC 610 এবং Joginder Kumar vs. State of UP, AIR 1994 SC 1349 দুটি মামলার নির্দেশনার প্রেক্ষিতে ২০০৯ সালে গ্রেফতারের পদ্ধতি ও গ্রেফতারকারী অফিসারের করণীয় সম্পর্কে The Code of Criminal Procedure, 1973 এর ৪১বি ধারা সংশোধন করা হয়। ধারাটি নিম্নরূপ –
Section 41B. Procedure of arrest and duties of officer making arrest.
Every police officer while making an arrest shall–
(a) bear an accurate, visible and clear identification of his name which will facilitate easy identification;
(b) prepare a memorandum of arrest which shall be–
(i) attested by at least one witness, who is a member of the family of the person arrested or a respectable member of the locality where the arrest is made;
(ii) countersigned by the person arrested; and
(c) inform the person arrested, unless the memorandum is attested by a member of his family, that he has a right to have a relative or a friend named by him to be informed of his arrest.
ভারতের আদালতগুলোতে গ্রেফতারের স্মারকলিপির উপর যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হয়। Shri Subhash Namdev Desai Vs. The State of Maharashtra, 2013 (4) Bom CR (Cri)207 মামলায় ডি.কে বসু মামলার অ্যারেস্ট মেমোসহ গ্রেফতার সংক্রান্ত নির্দেশনা না মানার কারণে এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটের ১৫১ ধারার প্রসিডিংস বাতিল করেন এবং রাজ্য সরকারকে আসামীদের প্রত্যেককে ২০,০০০ টাকা করে ক্ষতিপূরণ প্রদানের নির্দেশ দেয়।
Laxmi Sardar Vs. The State of West Bengal (2015) 3 CALLT 623 (HC) মামলায় দেখা যায়, অ্যারেস্ট মেমোতে সাক্ষীর স্বাক্ষর না থাকার কারণে আসামীকে ঘটনাস্থল থেকে গ্রেফতার করা হয়নি মর্মে আদালত সন্দেহ প্রকাশ করেন। আদালত এই কারণ ও অন্যান্য বিষয় বিবেচনায় আসামীর আপীল মঞ্জুর করে খালাস প্রদান করেন।
এভাবে একটু প্রস্তুতি নিয়ে পরের পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেসি মিটিংয়ে এর ফরমেট সবাইকে দিলাম। এরপর বাস্তবায়নে গিয়ে দেখি নানা রকম সমস্যা। অধিকাংশজনই ভাবছে এটা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা করবে। কেউ কেউ পুরোটা টাইপ করে শুধু নিজের নাম স্বাক্ষর করছে। কেউ কেউ আবার কোন কোন ঘর পূরণও করছে না। তারপর এক ছুটির দিনে একদিনের সমস্ত নথি নিয়ে জরিপ করলাম।
জরিপে দেখা গেল, মাত্র ৪৯ শতাংশ অ্যারেস্ট মেমো প্রস্তুত করেছে। বাকীরা কেন করেননি সেজন্য তাৎক্ষণিকভাবে সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ফোন করেছি। তাছাড়া যারা অ্যারেস্ট মেমো পূরণ করেছে এদের মধ্যে মাত্র ১ জন সঠিকভাবে পূরণ করেছে। বিষয়গুলো নিয়ে পরের পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেসি মিটিংয়ে উপস্থাপন করলাম। নিজেদের ভুল-ত্রুটিগুলো নিয়ে কথা বললাম। পরের মিটিংয়ে আগে আবারও জরিপ করলাম। দেখলাম, রাজশাহী জেলায় যত আসামী গ্রেফতার হয়েছে তাদের সবারই অ্যারেস্ট মেমো প্রস্তুত করা হয়েছে। এই শতভাগ সফলতার পিছনে মূল মন্ত্র ছিল রাজশাহীর পুলিশ ও বিচার বিভাগের মধ্যে নিয়মিত মিটিং, ফলোআপ ও সুসমন্বয়।
শুধু গ্রেফতারকারী অফিসার নন ধৃত আসামীকে বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে প্রথম উপস্থাপন (First Production) করার সময় ম্যাজিস্ট্রেটের ভূমিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সময় তাকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। অ্যারেস্ট মেমো দ্রুত পরীক্ষার মাধ্যমে ম্যাজিস্ট্রেট তাতে বর্ণিত বিষয়াবলী দ্রুত চেক করতে পারেন। এখানে ম্যাজিস্ট্রেট নিশ্চিত করবেন যে গ্রেফতারটি আইনানুগ ছিল এবং তাতে সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে। এই সময় ধৃত আসামীকে ২৪ ঘন্টার মধ্যে তার সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে কিনা, গ্রেফতারকালে জখমপ্রাপ্ত হয়েছে কিনা, জখমপ্রাপ্ত হলে চিকিৎসকের কাছে নেয়া হয়েছে কিনা, তার আত্নীয়- স্বজন জানে কিনা, তার আইনজীবী আছে কিনা, তার একজন লিগ্যাল এইড আইনজীবীর প্রয়োজন আছে কিনা এবং জামিন বা হাজতবাস কোনটি যথাযথ ইত্যাদি বিষয়গুলো দেখতে হবে।
বাংলাদেশের ফৌজদারী বিচার ব্যবস্থায় অ্যারেস্ট মেমোর গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ এটি যেমন নানাভাবে ধৃত আসামীকে সুরক্ষা দেয় ঠিক তেমনি গ্রেফতারকারী অফিসারেরও জবাবদিহীতা নিশ্চিত করে। ভারতের মত বাংলাদেশেও গ্রেফতারের পদ্ধতি সম্পর্কে আইন সংশোধন ও বিভাগীয় সার্কুলার ইস্যু করা এখন সময়ের দাবী। আইন সংশোধন করা হলে প্রতি বছর লাখো মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
লেখক: যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ, কুড়িগ্রাম