বহুল আলোচিত সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছে। রায়ে বিচারক বলেন, কক্সবাজারের টেকনাফ মডেল থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ ও পরিদর্শক মো. লিয়াকত আলী যে অপরাধ করেছে; তাতে তারা মৃত্যুদণ্ডের হকদার।
কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল স্বাক্ষরিত রায়ের ২৮৮ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি রোববার (৬ ফেব্রুয়ারি) প্রকাশিত হয়েছে। রায়ের শেষ পৃষ্ঠায় পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেছেন, ষড়যন্ত্রমূলক পূর্বপরিকল্পিত চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আসামি মো. লিয়াকত আলী ও প্রদীপ কুমার দাশ আগাগোড়া নেতৃত্ব দিয়েছে; তাই তারা সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার হকদার।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি সম্পর্কে আদালতের পর্যবেক্ষণ
মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত প্রধান আসামি মো. লিয়াকত আলীর সাজার বিষয়ে রায়ের শেষ পৃষ্ঠায় বিচারক বলেন, আসামি মো. লিয়াকত আলী মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খানকে হত্যার উদ্দেশ্যে অপর আসামি প্রদীপ কুমার দাশের সঙ্গে অপরাধজনক ষড়যন্ত্র করেছে এবং উপর্যপুরি গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে মারাত্মক আহত সিনহা মো. রাশেদ খানকে হাসপাতালে পাঠাতে দেরি করে। পরে এ হত্যার দায় থেকে বাঁচার জন্য এবং অপরাধের ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে মামলার আলামত ধ্বংস করে ফেলে। নিহত সিনহা মো. রাশেদ খান ও ভিকটিম সাহেদুল ইসলাম সিফাতের বিরুদ্ধে খুনের ও মাদকের দুটি মিথ্যা মামলা দায়ের করে শাস্তিযোগ্য অপরাধ সংঘটন করেছে। রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুজনসহ সকল আসামির অপরাধের বর্ণনা দেওয়া হয়।
একইভাবে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত অপর আসামি প্রদীপ কুমার দাশের অপরাধের বর্ণনা দিয়ে বিচারক বলেন, প্রদীপ কুমার মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খানকে হত্যার উদ্দেশ্যে অপর আসামিদের সঙ্গে অপরাধজনক ষড়যন্ত্র করেন। পরিকল্পনামতো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে অপর আসামিদের সহায়তা করে গুলি করে সিনহা মো. রাশেদ খানকে হত্যা করে আহত সিনহা মো. রাশেদ খানের বুকের বাম পাশে লাথি মেরে পাঁজরের দুটি হাড় ভেঙে ফেলে এবং পা দিয়ে গলা চেপে ধরে সিনহার মৃত্যু নিশ্চিত করে।
রায়ে বলা হয়, ওসি প্রদীপ কুমার দাশ পরক্ষণে মৃত্যু নিশ্চিত করতে মারাত্মক আহত সিনহা মো. রাশেদ খানকে ইচ্ছাকৃতভাবে হাসপাতালে পাঠাতে দেরি করে। হত্যার দায় থেকে বাঁচার জন্য এবং অপরাধের ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য মামলার আলামত ধ্বংস করে এবং নিহত সিনহা মো. রাশেদ খান ও ভিকটিম সাহেদুল ইসলাম সিফাতের বিরুদ্ধে খুনের ও মাদকের দুটি মিথ্যা মামলা রেকর্ড করে শাস্তিযোগ্য অপরাধ সংঘটন করেছে।
যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত আসামিদের নিয়ে আদালতের পর্যবেক্ষণ
যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত তিন আসামি নন্দ দুলাল রক্ষিত, সাগর দেব, রুবেল শর্মাকে সাজা প্রদানের ব্যাখ্যা করে বিচারক রায়ে উল্লেখ করেন, অপরাধের বিষয়ে পূর্ব থেকে জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও অসৎ উদ্দেশ্যে অপরাধজনক ষড়যন্ত্র ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সহযোগিতা করে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছে। পরবর্তীতে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে হত্যার দায় থেকে বাঁচার জন্য এবং অপরাধের ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে মামলার আলামত ধ্বংস করে ফেলে। এ ছাড়া নিহত সিনহা মো. রাশেদ খানের গাড়িতে অবৈধ মাদক রেখে নিহত সিনহা মো. রাশেদ খান ও ভিকটিম সাহেদুল ইসলাম সিফাত এর নামে খুনের ও মাদকের দুটি মিথ্যা মামলায় সহযোগিতা করে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছে।
যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত অপর তিন আসামি মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন, মোহাম্মদ আইয়াজ, মো. নূরুল আমিনের অপরাধের বর্ণনা দিয়ে বিচারক রায়ের শেষ পৃষ্ঠায় বলেন, আসামি মোহাম্মদ আইয়াজ মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খানকে হত্যার উদ্দেশ্যে অপর আসামিদের সাথে অপরাধজনক ষড়যন্ত্র করে। কক্সবাজার টেকনাফের মারিশবুনিয়া গ্রামের মুইন্না পাহাড়ে ডাকাত হিসাবে মাইকিং করে গণপিটুনি দিয়ে মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খানকে হত্যার চেষ্টা করে। কিন্তু সেখানে হত্যা করতে ব্যর্থ হয়ে আসামি প্রদীপ কুমার দাশ ও মো. লিয়াকত আলীকে সিনহা মো. রাশেদ খানের গতিবিধি অবগত করে। উক্ত তথ্য প্রদান করে ও অপরাধজনক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে অপর আসামিদের সহায়তায় গুলি করে সিনহা মো. রাশেদ খানকে হত্যা করার জন্য প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছে।
সর্বোপরি, আলোচ্য মামলার ষড়যন্ত্রমূলক পূর্বপরিকল্পিত চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আসামি মো. লিয়াকত আলী ও প্রদীপ কুমার দাশ আগাগোড়া নেতৃত্ব প্রদান করায়, তারা সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার হকদার।
রায় ঘোষণা
২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কে গুলিতে নৃশংসভাবে খুন হন মেধাবী সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা মো. রাশেদ খান। এ ঘটনায় সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। নড়েচড়ে বসে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীও। হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে নানা অপচেষ্টা চালানো হলেও তদন্তে বেরিয়ে আসে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের নাম ও তাদের নৃশংসতার কাহিনী।
এ মামলায় গত ৩১ জানুয়ারি রায় ঘোষণা করেন কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল। রায়ে মেজর (অব.) সিনহা হত্যা মামলায় দুইজনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ছয়জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত। অন্যদিকে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় বেকসুর খালাস পেয়েছেন মামলার সাত আসামি।